বৃহস্পতিবার, ৮ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

আমার দেখা কাজী আরেফ আহমেদ

মহম্মদ আলী নওয়াজ

আমার দেখা কাজী আরেফ আহমেদ

আজ ৮ এপ্রিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, জাসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কাজী আরেফ আহমেদের ৭৯তম জন্মদিন। কাজী আরেফ আহমেদ মুক্তিযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক, ’৬৯-এর আগরতলা মামলা উপলক্ষে যে গণঅভ্যুত্থান ও ছাত্রসমাজের ১১ দফার অন্যতম প্রণেতা ছিলেন। কাজী আরেফের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় সিরাজুল আলম খানের মাধ্যমে। সিরাজুল আলম খান ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার ৩৩ নম্বর অভিযুক্ত ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোহাম্মদ আলী রেজার সঙ্গে কাজ করতেন এবং ছাত্রসমাজকে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। কাজী আরেফ ছিলেন সিরাজুল আলম খানের ছায়াস্বরূপ। পরে আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ায় দেশের প্রচলিত রাজনীতি নিয়ে নানা আলোচনা হতো।

১৯৬২ সালে কাজী আরেফের নেতৃত্বে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন গঠিত হয় যা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, শিক্ষা ও গণতন্ত্রের আন্দোলনসহ ছয় দফা, জাতীয় পতাকার নকশা প্রণয়ন ও উত্তোলন এবং মুজিব বাহিনী গঠনে যে রাজনৈতিক বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল সে সময় তার উৎস বা কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন আমাদের এই নেতা কাজী আরেফ।

১৯৬৩-১৯৭০ পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। কাজী আরেফ ১৯৬২-এর দিকে আরেকটি কাজ করেছিলেন তা হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ। তিনি ‘ইন্টার ডিগ্রি ছাত্র ফোরাম’ গঠন করে তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিলেন। সে সময় কাজী আরেফই প্রথম মানুষ যিনি ১৯৬৬-তে সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার-উদ্যোগী নেতা হিসেবে ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৬-তে বঙ্গবন্ধু-ঘোষিত ছয় দফার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন।

কাজী আরেফ ‘বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’ (মুজিব বাহিনী) গঠনে একজন অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি বৃহত্তর পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রিক্রুটমেন্ট প্রধান হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি জাতীয় কৃষক লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি দৈনিক গণকণ্ঠ নামক এক পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের দায়িত্ব কিছু দিন পালন করেন। তারপর ১৯৭০-এর দশকে তিনি সমাজতন্ত্রকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে শোষণমুক্ত এক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ’ নামের রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি জাসদের ভিত্তি প্রস্তুতকারী এক সমাজতান্ত্রিক নেতা। তিনি অবৈধ সামরিক শাসন, যুদ্ধাপরাধ, মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার সাহসী কণ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে ১৯৯২ সালে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠনে কাজী আরেফ কার্যকর ভূমিকা রাখেন। ’৬০-এর দশক থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত সমাজের নিম্ন শ্রেণির পেশার মানুষের অধিকার, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন কাজী আরেফ।

১৯৭৩ সালে জাসদ গঠন করা হয়। কাজী আরেফ, সিরাজুল আলম খান, অ স ম রব প্রায়ই আমার বাসায় আসতেন এবং রাজনীতি ছাড়া আওর অনেক বিষয় আলোচনা হতো। কাজী আরেফের স্ত্রীও প্রায়ই আমার বাসায় আসতেন এবং একপর্যায়ে সবাই আমার পরিবারের অংশে পরিণত হয়ে যান। আরেফ এবং তার স্ত্রী রওশন জাহান সাথী অত্যন্ত সৎজীবন যাপন করতেন। কাজী আরেফকে আমি অনেকবার বলেছি জীবিকার জন্য কিছু একটা কর আমি যতটা পারি সহায়তা করব। আরেফের সঙ্গে আমার শেষ দেখা দৌলতপুর মিটিংয়ে যাওয়ার আগের দিন। তিনি আমার মতিঝিল অফিসে আসেন এবং তাঁর অর্থনৈতিক অনেক অসুবিধার কথা আমাকে বললে আমি তাকে বলেছিলাম তোমার কি দৌলতপুর না গেলে হয় না। উত্তরে তিনি বললেন, একদিন পরই আবার ফিরে এসে দেখা করব। আরেফ দৌলতপুর যাওয়ার পর আমি একটা সংবাদ পাই সঙ্গে সঙ্গে তার স্ত্রীকে জানাই- যে করেই হোক আরেফকে যেতে মানা করবে। কিন্তু তার স্ত্রীর ভাইয়ের ইলেকশনের জন্য তিনি রওনা হয়ে গেছেন বলে আমাকে জানান। ১৬ ফেব্রুয়ারি আমি রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে আগরতলা মামলার অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করি। মিটিংয়ে তোফায়েল আহমেদসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ মিটিংয়ের মধ্যে একটা ছোট কাগজে চিঠি পাই তাতে লেখা আরেফ দৌলতপুর মিটিংয়ে গুলিবদ্ধ হয়েছেন। সংবাদ পেয়ে আমরা সবাই নির্বাক হয়ে পড়ি এবং তাড়াতাড়ি মিটিং শেষ করে কাজী আরেফের শেষ সংবাদ পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯ সালে কালিদাসপুরে কাজী আরেফ আহমেদসহ পাঁচ নেতাকে হত্যা করা হয়। সেদিনের এ ভয়াবহ দুর্ঘটনার একমাত্র জীবিত ব্যক্তি মিটিং পরিচালনাকারী সাবেক ছাত্রনেতা কারশেদ আলম পরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন বলে আমি শুনেছি। এ মামলার বিচার নিয়ে অনেক মিটিং-মিছিল আন্দোলন সংগ্রামের রাজপথের সাহসী সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন। তাকে অনেকবার খুন করারও পরিকল্পনা হয়। খুনিরা ব্যর্থ হয়ে কারশেদ আলমকে ওই এলাকার একটি হত্যা মামলার আসামি করে প্রতিশোধ নেওয়ার অপচেষ্টা চালায়। বর্তমানে মামলাটি কুষ্টিয়া জেলা জজ আদালত দ্বিতীয়তে বিচারাধীন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আমি আশা করব রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগ বিষয়টি সুবিবেচনা করবে। হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা কাজী আরেফের জন্য। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।

লেখক : ঐতিহাসিক আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা।

সর্বশেষ খবর