শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

মোদি মতুয়া এবং পশ্চিমবঙ্গের ভোট

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মোদি মতুয়া এবং পশ্চিমবঙ্গের ভোট

হিটলার বেঁচে থাকলে মোদিকে বলতেন আমার একজন গোয়েবলস ছিল, আর আপনার হাতে ডজন ডজন গোয়েবলস আছে। এটা আপনার কৃতিত্ব। এ প্রসঙ্গ নিয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গে জোর চর্চা চলছে। বিশেষ করে শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দলগুলো মনে করেন নমশূদ্র মতুয়াদের ভোট পাওয়ার জন্য মোদি মন্ত্রিসভার অন্তত ৫০ জন মন্ত্রী, রাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা গোয়েবলসের কায়দায় সারা পশ্চিমবঙ্গ চষে বেড়াচ্ছেন। হিটলারের গোয়েবলস জার্মানির ভোটারদের টাকা দিয়েছিলেন কি না সে ব্যাপারে কোনো ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়নি। আর মোদির গোয়েবলসরা শুধু ঠারেঠোরে নয়, প্রকাশ্যে প্রচার করছেন তারা মতুয়াদের জন্য আলাদা রাজ্য করে দেবেন। শুধু মমতা ব্যানার্জিই নন, পশ্চিমবঙ্গের সংযুক্ত মোর্চার (বামফ্রন্ট, কংগ্রেস, আইএসএফ) নেতারাও পাল্টা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছেন, আসুন আর একবার বাংলা ভাগ করার স্পর্ধা দেখান। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী, সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র মনে করেন, ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন ক্ষমতায় এসেই ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ করে টাকা আর ২ কোটি বেকারকে চাকরি দেওয়া হবে- সেটা ছিল গুজরাটি বেনিয়ার ধূর্তামি। এবারের ‘মতুয়া রাজ্য’ হলো নমশূদ্র সম্প্রদায়কে ললিপপ দেখানো। ধরা পড়ে গেছেন তিনি মতুয়াদের কাছে। এমনকি তাঁর ঢাকা সফরের আগে সমস্ত ব্যবস্থা করার জন্য তিনি পাঠিয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরকে। শান্তনু ঠাকুর একটি বেসরকারি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, ওরা মতুয়াদের জন্য কিছুই করবে না। এটা ভোট পাওয়ার জন্য একটা চমক ছাড়া আর কিছুই নয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহল উষ্মা প্রকাশ করে বলেছে, মোদি-শাহের এ ধরনের চটকদারি প্রতিশ্রুতি মতুয়ারা আর বিশ্বাস করছে না। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ আরএসএসের সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক রেখে চলেছে। সম্প্রতি ঢাকার একটি হোটেলে হেফাজত নেতার কান্ডকারখানা ভারতের সোশ্যাল মিডিয়ায় ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর শুধু ক্ষুব্ধই নয়, আরএসএসের সব শাখা সংগঠন দীর্ঘকাল ধরে দিল্লিতে এসে নাগপুর হয়ে সর্বত্র একই প্রচার করছে। নির্বাচনভিত্তিক এসব কান্ডকারখানা দেখে ইতিহাসবিদরা মনে করেন, মোদি-অমিত শাহ-মোহন ভাগবতরা ভারতকে কোনো দিনই হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারবেন না। সম্প্রতি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত ইতিহাসবিদ ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকায় এক প্রবন্ধ লিখে বলেছেন, ওঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করেন। পার্থবাবু আরও বলেছেন, ভারত বরাবরই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ছিল, আছে এবং থাকবেও। যে মমতা ব্যানার্জি এখন লম্ফঝম্প করছেন, তিনি নিজেই যে বিজেপিকে এ রাজ্যে টেনে এনেছিলেন সে ইতিহাস সবাই জানেন। কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে নতুন দল গড়ে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলায় তাদের মাটি শক্ত করেছিলেন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে দলে দলে যে হিন্দু শরণার্থী আশ্রয়ের সন্ধানে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলেন তাদের সঙ্গে বরিশাল, ফরিদপুর, যশোর, খুলনার নমশূদ্ররাও আসেন। তবে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা যে সংখ্যায় এসেছেন তার চেয়ে সংখ্যায় কম ছিলেন নমশূদ্ররা। ভারত সরকার সব শ্রেণির মানুষকেই সীমান্তে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকত্বের কাগজপত্র হাতে তুলে দেয়। সরকারি তথ্যানুযায়ী সে সময় পূর্ববঙ্গে নমশূদ্রদের নেতা ছিলেন যোগেন মন্ডল। যোগেনবাবু ১৯৪৭ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মন্ত্রিসভার সদস্যও হন। যোগেন মন্ডল দাবি তুলেছিলেন নমশূদ্রদের জন্য পৃথক রাজ্য গঠনের। এ দাবিতে ক্ষুব্ধ জিন্নাহ তাঁর মন্ত্রিসভা থেকে যোগেন মন্ডলকে সরিয়ে দেন। ঢাকায় ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েন যোগেন মন্ডল। পরে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আসেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান নমশূদ্রের পরিবর্তে তাদের নামকরণ করেন মতুয়া। আজও তারা ‘মতুয়া’ নামেই পরিচিত। অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন মতুয়ারা। ভারত সরকার এদের নানাভাবে সাহায্য করে। পেশাগতভাবে এরা চাষবাস ছাড়াও রজকের পেশা গ্রহণ করেন, যে পেশায় তারা পূর্ববঙ্গেও ছিলেন। এ নমশূদ্রদের নেতা হিসেবে উঠে আসেন একজন, তাঁর নাম প্রমথরঞ্জন ঠাকুর (পি আর ঠাকুর)। তিনি বনগাঁ, বাগদা অঞ্চলে মতুয়াদের নিয়ে বিভিন্ন ক্লাব তৈরি করেন। বর্তমানে যাকে বলা হয় মতুয়া মহাসংঘ। পাঁচ দশকে এই পি আর ঠাকুর কংগ্রেসের টিকিটে বিধায়ক হন এবং বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিসভায় তাঁকে ডেপুটি মিনিস্টার পদে নিয়োগ করা হয়। বিধান রায়ের মন্ত্রিসভার উপমন্ত্রী থাকার সময় তিনিও যোগেন মন্ডলের মতো মতুয়াদের জন্য আলাদা রাজ্যের দাবি তোলেন। ক্ষুব্ধ বিধানচন্দ্র তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেন। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতারা পি আর ঠাকুরকে মদদ দিতে থাকেন পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন করার জন্য। মুসলিম লীগ নেতারা প্রমথরঞ্জন ও তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ে নিযুক্ত করেন। বনগাঁর কাছে ঠাকুরনগরে এরা একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

জিয়াউর রহমান এবং তার বিধবা স্ত্রীর শাসনকালে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করে বহু লোক কোটিপতি হয়ে যান, যার নেতৃত্বে ছিল ঠাকুর পরিবার। এ ঠাকুর পরিবারের (পি আর ঠাকুর) ছেলেমেয়েরাই দুই বাংলার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ব্যাপারে সব রকম সাহায্য পায় কলকাতার মার্কিন দূতাবাস থেকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় নমশূদ্র ও আধুনিক মতুয়ারা আর্থিক দিক থেকে শুধু ফুলে-ফেঁপেই ওঠেননি, তাদের পুরনো দাবি আদায়ের জন্য সোচ্চার হন। অর্থাৎ এক কথায় তারা বাংলাদেশের হাসিনা সরকারকে ব্ল্যাকমেইলিং শুরু করেন।

১৯৯৭-৯৮ সালে মমতা ব্যানার্জি কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে নতুন দল গঠন করে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলান এবং অটল বিহারি বাজপেয়ির মন্ত্রিসভার সদস্য হন। সে থেকেই মমতার নজর মতুয়া ভোট। মতুয়া অধ্যুষিত দুটি জেলায় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার মোট ৪৮টি আসন আছে, যার অধিকাংশ ভোটারই মতুয়া বা নমশূদ্র। মমতা তৃণমূল নেত্রী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে ওইসব এলাকায় ঘন ঘন যাতায়াত শুরু করেন এবং বিভিন্ন এলাকায় তাদের মন্দির গড়ে তোলার জন্য প্রচুর দান-ধ্যানও করেন। মমতার সঙ্গে বিজেপির বিচ্ছেদ হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের নজর পড়ে সীমান্ত এলাকার ওই মতুয়া ভোটের ওপর। মোদি-শাহ, দুজনই ওইসব এলাকায় ঘন ঘন সভা-সমিতি করে মতুয়াদের তাদের দিকে টানার চেষ্টা করেন। এর ফলও তারা পান। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে দুটি আসন মমতার হাত থেকে বিজেপির হাতে চলে যায়। আর মতুয়ারা এমন একটি গোষ্ঠী যারা নিজেদের স্বার্থে চলেন। ২০১৪ সালে বিজেপি ভারতবর্ষে ক্ষমতায় আসার পর থেকে দলে দলে মতুয়ারা নাগপুরে আরএসএসের সদর দফতরে গিয়ে মোহন ভাগবতসহ প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে থাকেন। তারা যোগাযোগ করেন আরএসএসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাম মাধবের সঙ্গেও।

মতুয়া মহাসংঘ (যার সদর দফতর ওয়াশিংটন) রাজনৈতিক দল নয়, একটি বড় মাপের স্বার্থান্বেষী দল। মোদি-মমতারা আশ্বস্ত করছেন তারা এ দেশে এলেই তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। আর তা শুনে তারা তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছেন। আরএসএস নেতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ মাগুরা, বাগেরহাট, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে জনসভাও করে এসেছেন মতুয়াদের নিয়ে। তাকে বাংলাদেশে গিয়ে মতুয়াদের নিয়ে সভা করার অনুমতি কে দিল, সে নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। এই মতুয়াদের জড়িয়ে গরু পাচারের অনেক ঘটনাও ঘটেছে, যা গোয়েন্দা অফিসাররা চাকরি হারানোর ভয়ে বলতে চান না। মতুয়া মহাসংঘ কোনো রাজনৈতিক দল নয়, একটি বড় মাপের ক্লাব, তারা বাংলাদেশেও তৎপর। গত সাত বছরে বাংলাদেশে এমন কোনো জেলা নেই যেখানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অফিস খোলা হয়নি। এ অফিস খোলার জন্য নাগপুরের আরএসএসের সদর দফতর থেকে ঘন ঘন ওইসব এলাকায় লোক পাঠানো হচ্ছে। কেন পাঠানো হচ্ছে তা বাংলাদেশ সরকারের নজরে এনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। যদি আরএসএস এবং মতুয়াদের এ বাড়াবাড়ি চলতে থাকে তবে অদূর ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হতে পারে বলে দুই দেশের বিশেষ মহলের অভিমত।

লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক [ভারত]।

সর্বশেষ খবর