শিরোনাম
শনিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

১৯৭১ সালের এই দিনে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জাতিরাষ্ট্র গঠনের সব আকাক্সক্ষার পূর্ণতা দিয়েছে এবং এ ঘোষণাপত্রে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সব উপাদান বিদ্যমান। নজিরবিহীন বর্বর গণহত্যাসহ অন্যায় যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বীরত্ব ও বিপ্লবী উদ্দীপনায় জনগণ বাংলাদেশের ভূখন্ডের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে ঘোষণাপত্র যা নিশ্চিত করে। স্বাধীনতা ও আত্মবিকাশের প্রশ্নে এটি বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘোষণা। বাঙালির জীবনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই বাংলাদেশ ভূগোল ও ইতিহাসে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর অগ্নিঝরা মার্চে গণবিস্ফোরণ, গণঅভ্যুত্থান ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং নিউক্লিয়াসের পরিকল্পনায় জাতির রাজনৈতিক চেতনায় বড় ধরনের মৌলিক রূপান্তর ঘটে। স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চের গণহত্যার প্রথম প্রহরেই গ্রেফতার করা হয়। তারপর হানাদার বাহিনী গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, লুণ্ঠন ও নারী নির্যাতনের ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করে। একদিকে প্রাণ রক্ষার জন্য লাখ লাখ ভীতসন্ত্রস্ত ও অসহায় নারী-পুরুষ প্রাণের চেয়ে আপন ভিটামাটি ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে, অন্যদিকে শত্রুকে প্রতিরোধ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরের বিদ্রোহী বাঙালি সৈনিকরা এবং সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর বীর জওয়ানরা।

পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত প্রতিরোধযোদ্ধাদের অধিনায়করা ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের মাধবপুরের তেলিয়াপাড়ায় এক বৈঠক করেন। বৈঠকে বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এ অবস্থায় গণহত্যার শিকার বাঙালি জাতিকে হানাদার বাহিনী থেকে রক্ষা ও প্রতিরোধ করা এবং স্বাধীনতা অর্জনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় যথাসম্ভব দ্রুত একটি সরকার গঠন অনিবার্য হয়ে পড়ে। এ স্বীয় বিবেচনায় ভবিষ্যতের রূপরেখা প্রণয়নে তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছেন : ‘... যাবার পথে এদেশের মানুষের স্বাধীনতালাভের যে চেতনার উন্মেষ দেখে গিয়েছিলাম সেটাই আমাকে আমার ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে অনিবার্য সুযোগ করে দিয়েছিল। জীবননগরের কাছে সীমান্তবর্তী টঙ্গী নামক স্থানে একটি সেতুর নিচে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা হলো- একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করা।’

প্রবাসী সরকার গঠনের এটাই প্রথম কার্যকর উদ্যোগ। তখন বৃহত্তর পরিসরে প্রবাসী সরকার গঠনে আলোচনারও কোনো সুযোগ ছিল না।

ভয়ংকর বিপৎসংকুল ও সংকটপূর্ণ পরিবেশে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এবং অভাবনীয় পরিস্থিতিতে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশ সরকার গঠন প্রশ্নে ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল প্রথম দিনের আলোচনাতেই তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তাজউদ্দীন আহমদেরই সুতীক্ষ্ণ কূটনৈতিক তৎপরতায় দ্রুত প্রবাসী সরকার গঠন সম্ভব হয়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট বাঙালি অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান ‘উতল রোমন্থন পূর্ণতার সেই বছরগুলো’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘আমার সঙ্গে বৈঠকে হাকসার আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য নেতাদের ব্যাপারে জানতে চান যারা বঙ্গবন্ধুর মতো উঁচুমাপের নেতার অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারবে। তাজউদ্দীন সেই সময় দিল্লিতে এসেছেন এটা না জেনেই আমি বলেছিলাম এই ভূমিকা সম্ভবত তাজউদ্দীন আহমদই পালন করতে পারেন।’

পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ মোকাবিলা, সুনিয়ন্ত্রিত এবং সুসংগঠিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রবাসী সরকার গঠন ছাড়া তাজউদ্দীন আহমদের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না। জাতির ক্রান্তিলগ্নে বহুমাত্রিক জটিল সংকট ও সমস্যাসংকুল অবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ অপরিসীম গুরুদায়িত্ব বহন করে সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি পূরণ করেছেন। ফলে মুক্তিসংগ্রামে অসামান্য প্রেরণা সংযোজিত হয় এবং বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে আবিভর্‚ত হওয়ার সম্ভাবনা অনিবার্য হয়ে ওঠে।

প্রবাসী সরকারের অধীনেই ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করা হয়। প্রবাসী সরকার গঠিত হওয়ার কারণেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ, দেশের অভ্যন্তরে অসহযোগ আন্দোলন সক্রিয় রাখা এবং বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক স্বীকৃতিলাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রবাসী সরকার গঠন এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং রেহমান সোবহান। জাতীয়, আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের ভূখন্ডে প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভা প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, মুনসুর আলী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান অর্থমন্ত্রী ও খন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করে প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হয়। স্বাধীনতা অর্জনের সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। তাই প্রবাসী সরকারের উজ্জ্বল কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ- ১. প্রবাসী সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারির দিন ১০ এপ্রিল বা প্রবাসী সরকারের শপথ গ্রহণের দিন ১৭ এপ্রিলকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ ঘোষণা ২. প্রজাতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে ঢাকায় ‘প্রজাতন্ত্র স্তম্ভ’ নির্মাণ ৩. স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এ তিনটিকে ‘প্রজাতন্ত্রের আদর্শ’ ঘোষণা ৪. রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও পাঠ্যপুস্তকে প্রবাসী সরকারের ঐতিহাসিক অবদান উপস্থাপন ৫. বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের স্থানসমূহ চিহ্নিতকরণ, মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্রসহ বিভিন্ন উপকরণ সংরক্ষণ এবং যার যা অবদান তা ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করা কৃতজ্ঞ জাতির কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত।

লেখক : গীতিকার।

সর্বশেষ খবর