রবিবার, ১১ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

ড. সুফিয়া আহমেদ : প্রেরণার অফুরন্ত উৎস

ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির

ড. সুফিয়া আহমেদ : প্রেরণার অফুরন্ত উৎস

বায়ান্নর ভাষাসংগ্রামী ও বাংলাদেশের প্রথম নারী জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদের (১৯৩২-২০২০) প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী প্রায় অগোচরেই অতিক্রান্ত হলো। গত এক বছরে করোনা মহামারী আমাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে জাতির বেশ কিছু শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদের মৃত্যু করোনায় না হলেও তিনি গত বছর ৯ এপ্রিল মহামারীর কঠিন সময়ে অনেকটা নীরবেই আমাদের ছেড়ে চলে যান। সময়ের হিসাবে বছর চলে গেল। আমরা হারালাম আমাদের একজন উদার ও অনুপ্রেরণাদায়ী অভিভাবককে।

জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদের পৈতৃক নিবাস ফরিদপুর। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। শিক্ষাজীবনের সব ক্ষেত্রে মেধার অসামান্য স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্রী থাকাকালে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন। ভাষা আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ, বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে আন্দোলনের পক্ষে প্রচার চালানো এবং আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার মিছিলে নেতৃত্ব প্রদানকারীদের অন্যতম ছিলেন তিনি। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকে তিনি তাঁর জীবনের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করতেন।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ থেকে ১৯৬০ সালে পিএইচডি. ডিগ্রি অর্জন করে পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন একজন বিদগ্ধ পন্ডিত ও গবেষক। শিক্ষকতা করেছেন তুরস্কের বসফরাস বিশ্ববিদ্যালয়, ফুলব্রাইট ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলভার্নো কলেজে। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানদের ইতিহাস; উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর আধুনিক তুরস্কের ইতিহাস এবং বাংলাদেশ ও তুরস্কের নারী উন্নয়ন। এসব বিষয়ে তিনি প্রচুর গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন এবং দেশ-বিদেশের নামকরা জার্নালে তা প্রকাশিত হয়েছে। তার ‘মুসলিম কমিউনিটি ইন বেঙ্গল’ গ্রন্থটি দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে বহুল আলোচিত।

১৯৫২ সালে পাকিস্তান সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে তুরস্ক সফর করেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন ১৯৬৯ ও ১৯৭৯ সালে। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো অধিবেশনেও তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সমাজসেবী ও সংগঠক হিসেবেও সক্রিয় ছিলেন। জাতীয় মহিলা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, গার্ল গাইডসের ইন্টারন্যাশনাল কমিশনারসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং এ সংগঠনের আটবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এ সংগঠন বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চা ও ইতিহাস সংরক্ষণের প্রধানতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে আজ প্রতিষ্ঠিত।

জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদের বাবা বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন ঢাকা হাই কোর্টের বিচারপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী। তাঁর চলার পথে বাবা ছিলেন তাঁর অন্যতম আদর্শ। ‘জাস্টিস মুহাম্মদ ইব্রাহিম (১৮৯৮-১৯৬৬) : মেমোরিয়াল ভলিউম’ এবং ‘ডাইরিজ অব জাস্টিস মুহাম্মদ ইব্রাহিম (১৯৬০-৬৬)’  গ্রন্থ দুটি সম্পাদনা ও সংকলন করে সুফিয়া আহমেদ আমাদের ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায় জাতির সামনে উন্মোচন করেছেন। পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর বাবা সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সঙ্গে পূর্ব বাংলার স¦ার্থ রক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করতেন এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও তাঁর মতামত ব্যক্তিগত ডায়রিতে লিখে রাখতেন। এ ডায়রিতে ইতিহাস-সচেতন পাঠক দুই পাকিস্তানের বৈষম্যের চিত্র ও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের মানসিকতা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার নিরিখে দেখতে পান।

ড. সুফিয়া আহমেদ শিক্ষা ও গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা জাতীয় অধ্যাপকরূপে বরিত হন। এ ছাড়া ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০২ সালে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন। ড. সুফিয়া আহমেদ আমাদের হৃদয়ে থাকবেন একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে। তিনি ছিলেন একজন আদর্শবান ও নীতিমান শিক্ষক। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর বন্ধন কত সুদৃঢ় হতে পারে তা আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। আমাদের সমাজে শিক্ষককে বাবা-মার সঙ্গে তুলনা করা হয়। তিনি সত্যিকার অর্থে ছিলেন শিক্ষার্থীদের মায়ের মতোন। একজন শিক্ষার্থীকে সৎচিন্তায়, সৎপথে ও উদার জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ করা; পেশার প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা; সর্বোপরি আদর্শ মানুষ হওয়ার শিক্ষা তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের সারা জীবন দিয়ে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা একজন আদর্শ শিক্ষক ও আমাদের সত্যিকারের অভিভাবক হারিয়েছি। জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদের আদর্শ অফুরান প্রেরণার উৎস হয়ে আমাদের আলোর পথ দেখাবে।

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।  

সর্বশেষ খবর