রবিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

আমার মা ও একটি স্মৃতি গ্রন্থাগার

সৌরেন চক্রবর্ত্তী

আমার মা ও একটি স্মৃতি গ্রন্থাগার

মানুষ পৃথিবীতে আসে অফুরন্ত সম্ভাবনা নিয়ে, যার জন্য মানুষই পারে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে। যদিও জীবনে নানা রকমের সমস্যা, প্রতিকূল পরিস্থিতি থাকে যা মানুষকে আঁকড়ে ধরে। কিন্তু কিছু মানুষ নিজ যোগ্যতায় ও গুণে সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে আচরণ, কর্ম, কর্তব্যনিষ্ঠার দ্বারা কিছু দৃষ্টান্ত সমাজে রেখে যায়; যা নিজ জীবনের জন্য হয়ে থাকে মূল্যবান সম্পদ, অন্যের জন্য অনুসরণযোগ্য আদর্শ। তা থেকে অনুপ্রেরণা পায় সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের মানুষ। 

এমন কিছু মানুষের একজন ছিলেন সবিতা চক্রবর্ত্তী, যিনি আমার মা। তাঁর আচরণ, কর্ম, কর্তব্যনিষ্ঠা ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে শোধ করেন মানুষের কাছে তাঁর জীবনের ঋণ, সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মকে আবদ্ধ করেন অশেষ ঋণে। ২৪ এপ্রিল তাঁর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। নাটোরের কাফুরিয়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবার লাহিড়ী বাড়িতে ১৯২৭ সালের ১৫ জুন সবিতা লাহিড়ী নামে যে মেয়েটি জন্মেছিল সময়ান্তরে বৈবাহিকসূত্রে নওগাঁ বদলগাছী উপজেলার বৃহত্তর বালুভরা গ্রামে এসে তিনি হয়ে গেলেন সবিতা চক্রবর্ত্তী। ঐতিহ্যবাহী বালুভরা গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, নওগাঁ অঞ্চলের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবী শশীভূষণ চক্রবর্ত্তীর কনিষ্ঠ পুত্র ব্রজেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তীর সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিদুষী, মমতাময়ী নারী সবিতা চক্রবর্ত্তী মানুষ হিসেবে মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্বের যে নিদর্শন রেখে গেছেন তা কখনো ভোলার নয়। এলাকায় শিক্ষা-সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সমাজকল্যাণ ও সেবাব্রতে তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন সেজন্য নওগাঁ অঞ্চলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বালুভরাসহ নওগাঁ অঞ্চলের অনেক হিন্দু পরিবার দেশত্যাগ করলেও আমাদের পরিবার দেশমাতৃকার টানে রয়ে যায়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা সপরিবারে শরণার্থী হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাটে আশ্রয় গ্রহণ করি। শরণার্থী জীবনের যে চরম কষ্ট তা ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করেন। দেশ স্বাধীনের পর আমরা সপরিবারে বাংলাদেশে ফিরে আসি। কিন্তু আমাদের ঘরবাড়ি ল-ভ- হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধীরা ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছিল, ঘরের জিনিসপত্র লুটপাট করেছিল। যাচ্ছেতাই অবস্থা। আমাদের মা-বাবা এলাকাবাসীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করলেন। সে মোতাবেক আমরা বালুভরা আর বি উচ্চবিদ্যালয়ের (আমার পিতামহ ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন ১৯০৭-১৯৪৫ পর্যন্ত) হেডমাস্টার সাহেবের কক্ষে কয়েক মাস বাস করি। অন্য বেশ কিছু পরিবার পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা মাটির ঘরগুলোয় বসবাস করছিল। কয়েক মাসের মধ্যে নিজেদের জন্মভিটায় আমরা কোনোমতে বসবাস করার মতো ঘর নির্মাণের ব্যবস্থা করে নিই স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায়। ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু আমার মায়ের দৃষ্টি স্কুলের প্রতি। কেননা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ছেলেমেয়েরা যাতে নিয়মিত পড়াশোনা করতে পারে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে ঘন ঘন মিটিং-সিটিং করে স্কুলের শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজে অবহেলিত মানুষের জন্য কিছু করা, এ যেন নিত্যদিনের কাজ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর জীবনে একটা বড় স্বপ্ন ছিল বালুভরা আর বি উচ্চবিদ্যালয়ে একটি সুন্দর গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার। ছেলেমেয়েরা যাতে শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করতে পারে, সৎ গুণাবলি অর্জন করতে পারে মানুষের মতো মানুষ হয়ে যাতে দেশ ও দশের সেবা করতে পারে সেজন্য আজীবন পরিশ্রম করে গেছেন। বৃহত্তর বালুভরা অঞ্চলে শিক্ষা-সংস্কৃতি, ক্রীড়া, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সমাজকল্যাণ ও সেবাব্রতে তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন সেজন্য এ অঞ্চলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই এই বিদুষী নারীকে স্মরণ করেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও বৃহত্তর বালুভরাবাসীর দাবি ও ঐকান্তিক আগ্রহেই তাঁর মৃত্যুর পর এ প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিটির নামকরণ হয় ‘সবিতা চক্রবর্ত্তী স্মৃতি গ্রন্থাগার’।

শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা-সংস্কৃতির লালন ও বিস্তারের জন্য গ্রন্থাগার চিরদিনই সমাজের একক ও সমষ্টিগত জীবনে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যাঁরা দেশে-বিদেশে অর্থাৎ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত, তাঁদের ছবি এ গ্রন্থাগারের দেয়ালে টাঙানো রয়েছে (প্রায় ৪০০); যা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ ও গভীর আগ্রহের সৃষ্টি করে। প্রচুর বই রয়েছে এ গ্রন্থাগারে। সুবিশাল পরিসরে গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থী এবং জ্ঞানপিপাসুরা যাতে জ্ঞানার্জন ও বিদ্যাচর্চা করতে পারে সে রকম আগ্রহ তাঁর মনে অনেক আগে থেকেই বিরাজ করছিল। মফস্বলের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের গ্রন্থাগার বিরল। দূরদূরান্ত থেকে অনেক জ্ঞানপিপাসু মানুষ/শিক্ষার্থী গ্রন্থাগার দর্শনে আসেন। সাংস্কৃতিক আড্ডা, পারস্পরিক মতবিনিময় এবং পাঠাভ্যাস কমায় ক্রমেই অনুভূতিহীন এক যান্ত্রিক সমাজ তৈরি হচ্ছে। অসহিষ্ণু হচ্ছে মানুষ। এ ছাড়া সাহিত্যে আবহমানকালের সম্প্রীতি, প্রান্তিক জীবনাচার এবং লোকজঐতিহ্য তুলে না ধরলে শিকড়হীন বৃক্ষে পরিণত হবে নবীন প্রজন্ম। সবিতা চক্রবর্ত্তীর এ রকম ভাবনা ছিল যেন শিক্ষার্থীরা জ্ঞান, চিন্তা-চেতনা, মানসিকতা, শিক্ষা-সভ্যতা, বিবেচনাবোধ ও পরিমিতিবোধে সচেতন হয় এবং নবীন প্রজন্ম যাতে এসবের চর্চা করতে পারে, নিজেদের ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারে। এক কথায় বটবৃক্ষের মতো গ্রন্থাগারের ছায়ায় তা যাতে করতে পারে সেজন্য এ আয়োজন। আজ আমাদের সমাজ, মূল্যবোধ; চরম নৈতিক অবক্ষয় ও সংকটে আক্রান্ত। আজকে প্রয়োজন প্রতি পরিবারে সবিতা চক্রবর্ত্তীর মতো সৎ, নিষ্ঠবান, নৈতিক সাহসী মানুষ; যাতে সমাজটা বদলে যায়। বাংলাদেশের সবাই যাতে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে নিরাপত্তা, সুখ, শান্তি ও স্বস্তিতে বসবাস করতে পারে। এই বিদুষী নারী ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল নওগাঁয় নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

লেখক : সাবেক সিনিয়র সচিব

[email protected]

সর্বশেষ খবর