মঙ্গলবার, ২০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা
অতিথি কলাম

দরকার মানুষ বাঁচানোর বাজেট

ড. আতিউর রহমান

দরকার মানুষ বাঁচানোর বাজেট

কঠিন এক সংকটকালে আসছে আগামী অর্থবছরের বাজেট। এ সংকট বিশ্বজুড়েই চলছে। বিশ্বায়নের এই যুগে দেশের ভিতরের ও বাইরের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করেই আমাদের আসন্ন বাজেট তৈরি করতে হচ্ছে। একইভাবে জুন, ২০২০-এ একটি চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছিল। অতীতে কোনোকালেই যে ধরনের সংকট আমাদের মোকাবিলা করতে হয়নি তেমন একটি সংকটময় পরিস্থিতিতে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও যে একটি পূর্ণাঙ্গ বাজেট মহান জাতীয় সংসদে সে সময় প্রস্তাব করা সম্ভব হয়েছিল সার্বিক বিচারে সেটিকে সচেতন মহল সময়োপযোগী হিসেবেই অভিহিত করেছে। আমার মনে হয় ফিসকাল পলিসি ও মনিটারি পলিসির মধ্যে যথাযথ সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে আমরা প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন এবং সর্বোপরি সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে ভালোই করেছি। উন্নয়ন সহযোগী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আমরা পাশে পেয়েছি। নিঃসন্দেহে উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সংকট মোকাবিলায় ‘আউট অব দ্য বক্স’ উদ্যোগ নিতে পেরেছিল বলেই সরকার পুনরুদ্ধার কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামী বাজেটটি দিতে যাচ্ছে।

এ প্রক্রিয়ায় সময়োপযোগী মনিটারি পলিসি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাজারে তারল্যের সরবরাহ ধরে রাখা গেছে, বাড়ানোও সম্ভব হয়েছে। এ ধারাটি এ বছরও ধরে রাখতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে। তাই এ স্থিতাবস্থা বজায় রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই।  তবে আসন্ন অর্থবছরের মূল চ্যালেঞ্জ হবে এ তারল্যের ব্যবহার নিশ্চিত করা। এবারে প্রধানত রাজস্ব নীতির মাধ্যমে এ দুর্যোগ মোকাবিলা নিশ্চিত করতে হবে। গেলবারের মতো এবারও কৃষি ও রেমিট্যান্স হবে আমাদের প্রধান রক্ষাকবচ। তাই এ দুই খাতের প্রণোদনা ও নীতি সমন্বয়ের দিকে সুনজর অব্যাহত রাখতে হবে। করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ধাক্কা আবার আমাদের চাপে ফেলেছে। আমাদের মূল রপ্তানি পণ্যের বহির্চাহিদা নিয়ে দুশ্চিন্তা নিশ্চয় রয়েছে। এমন বাস্তবতায় বাজেট অধিবেশন চলবে। তবে আমরা আশাবাদী গেলবারের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগিয়ে আমরা আরও কার্যকর ও সময়োপযোগী বাজেট আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্যও দিতে পারব। গেল ডিসেম্বরে যে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সরকারের তরফে প্রকাশিত হয়েছে, সরকারের দায়িত্বশীল জায়গাগুলো থেকে যে বার্তাগুলো এখন পর্যন্ত আমরা পেয়েছি এগুলোই আমাদের এমন আশাবাদের পেছনে কাজ করছে।

২০২০ সালের বাজেট অধিবেশনের আগে-পরে পত্রপত্রিকার লেখালেখি এবং বিভিন্ন জায়গায় বক্তব্যে আমরা বলে এসেছি শুধু চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর নয় বরং আসন্ন তিন-চার অর্থবছর জুড়েই বাজেটের মূল গুরুত্বের জায়গায় স্বাস্থ্য খাতকে রাখতে হবে। এবারে নতুন বাজেট মহান জাতীয় সংসদে প্রস্তাবের আগে আগেও তাই স্বাস্থ্য খাতকেই সব সংলাপের কেন্দ্রে দেখার আশা করছি। এ কথা মানতেই হবে, করোনার প্রথম ধাক্কায় আমাদের স্বাস্থ্য খাত একটি অপ্রস্তুত অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিল। সব পক্ষের সম্মিলিত চেষ্টায় তা সামাল দেওয়া গেছে, যা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে আগামীতে আরও ভালো করার জন্য প্রস্তুতি ও কাজ এখনই শুরু করতে হবে। চলতি অর্থবছরে বাজেটের ৫ শতাংশের কিছু বেশি স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সত্যি বলতে গত প্রায় এক দশকে প্রতি বছর গড়ে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা করে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়লেও মোট জাতীয় বাজেটের শতাংশ হিসেবে এ অনুপাত কিন্তু ৫ শতাংশের আশপাশেই আটকে আছে।

কেবল টাকার পরিমাণ হিসাবে নয়, আমার মনে হয় মোট বাজেটের শতাংশ হিসাবেও এখন স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাড়াতে হবে। এটা সময়ের দাবি। তবে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে এ বাড়তি বরাদ্দ আমরা কোথায় ব্যয় করব সে পরিকল্পনার দিকে। বলে রাখা ভালো, আমাদের স্বাস্থ্য বাজেটের বড় অংশটিই (৬১ শতাংশ) কিন্তু পরিচালন ব্যয়। নতুন পরিস্থিতিতে নতুন কর্মসূচি পাইলট করার জন্য উদ্ভাবনী প্রকল্প নিয়ে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয়ের অংশ বাড়ানো দরকার বলে মনে করি। এ ছাড়া মনে রাখা চাই, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার দেশব্যাপী কমিউনিটি ক্লিনিকের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে একটি বৈপ্লবিক ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। এর ধারবাহিকতায় এখন সেকেন্ডারি ও টারসিয়ারি স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করার উদ্যোগ এখন নেওয়া চাই।

এ প্রসঙ্গে কিছু উপাত্তের দিকে দৃষ্টিপাত করা যায়। হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভের ডাটাসেট থেকে আমরা দেখেছি, স্বাস্থ্যসেবা দরকার এমন বাংলাদেশি নাগরিকের ১২ শতাংশ কোনো আনুষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবাদাতার কাছেই যাচ্ছেন না। মহানগরীতে এ অনুপাত প্রায় দ্বিগুণ (২৩ শতাংশ)। এ ছাড়া ইনপ্যাশেন্টের মধ্যে ১৪ থেকে ১৯ শতাংশ এবং আউটপেশেন্টের মধ্যে ৫৪ থেকে ৫৯ শতাংশ সরকারি স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন। এসব উপাত্ত থেকেই স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোন দিকগুলোয় নজর দেওয়া দরকার সে সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

স্বাস্থ্যের মতো শিক্ষা খাতেও অগ্রাধিকারগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবার দরকার রয়েছে মনে হচ্ছে। কারণ কভিডকালে শিক্ষাকে চলমান রাখার জন্য আমাদের নিত্যনতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমার জানা মতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ খাতের জন্য একটি সেক্টর প্ল্যান চূড়ান্ত করার পথে রয়েছে। আর অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও শিক্ষা খাত নিয়ে করোনাকালের বাস্তবতার নিরিখে পথনকশা তৈরি করা হয়েছে। এগুলো বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষা খাতের বরাদ্দের অগ্রাধিকার ঠিক করাটা সবচেয়ে সমীচীন হবে মনে হয়।

তবে চাহিদামতো বাজেট বাড়ানো তখনই সম্ভব হবে যখন আমাদের আহরিত রাজস্বের পরিমাণ বাড়বে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখতে চাই, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদকালে কর-জিডিপি অনুপাত ১২.৩ অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে তা একটু রক্ষণশীল হয়ে গেছে। আমার মনে হয় এ পরিকল্পনার মেয়াদকালেই আমাদের এ অনুপাত ১৫ করার সক্ষমতা রয়েছে। ডিজিটাইজেশনের সুফলগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে রাজস্ব বোর্ডের পক্ষে এ লক্ষ্য অর্জন খুব চ্যালেঞ্জিং হওয়ার কথা নয়। শুধু তাই নয়, করের উৎস চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আমাদের আরও উদ্ভাবনী উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। করারোপের ক্ষেত্রে কৌশলী হতে পারলে মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদে এর বহুমুখী সুফল পাওয়া সম্ভব। একটি উদাহরণ এখানে দিতে পারি। যেমন তামাক পণ্যের ঘোষিত খুচরা মূল্য বাড়িয়ে এর ওপর সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে সে অনুসারে রাজস্ব আহরণ করলে একদিকে প্রায় ২ মিলিয়ন বাংলাদেশিকে ধূমপান থেকে বিরত করা যাবে, অন্যদিকে বাড়তি রাজস্ব আসবে ৩৪ বিলিয়ন টাকা। বাড়তি রাজস্বটুকুই কেবল আমাদের প্রাপ্তি নয়, বরং তামাক সেবন কমার ফলে তামাকজনিত রোগে কম লোক আক্রান্ত হবে। আর তার ফলে তাদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য যে অর্থ ব্যয় হবে তাও বেঁচে যাবে। ফলে এ রকম উদ্ভাবনী করারোপের জায়গাগুলো নিয়েও ভাবার সুযোগ রয়েছে মনে করি। এ প্রসঙ্গে আরও বলে রাখতে চাই, কয়েকটি অর্থবছর ধরে তামাক পণ্যের ওপর ১ শতাংশ হারে হেলথ ডেভেলপমেন্ট সারচার্জ আরোপ করা হচ্ছে। এ সারচার্জ থেকে প্রাপ্ত অর্থ যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট বৃদ্ধির জন্যই ব্যয় করা যায় তাহলে মনে হয় এ করোনাকালে তা বিশেষ সহায়ক হবে। এ ক্ষেত্রে খুব বেশি আমলাতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জ থাকার কথা নয়। কারণ আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয় দিন দিন ডিজিটাইজেশনের দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের এ সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে পারলে লক্ষ্য অর্জন খুবই সম্ভব।

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার দিকে এগোতে হলে দীর্ঘমেয়াদে হলেও সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমার কথা আমাদের ভাবতে হবে। এজন্য সুনির্দিষ্ট রেগুলেটর স্থাপনের উদ্যোগও নিতে হবে। ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য উদাহরণ হতে পারে। আমাদের সরকারও সে পথে এগোতে চাচ্ছে। উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইলের তিনটি উপজেলায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি পাইলট হচ্ছে। জানা গেছে, আগামীতে নগরাঞ্চলেও একই রকম পাইলট হবে। এসব অভিজ্ঞতাকে দ্রুত কাজে লাগিয়ে অগ্রসর হতে পারলে আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্য খাতকে আরও বেশি ঘাতসহনীয় (অর্থাৎ রেজিলিয়েন্ট) করে তোলা সম্ভব হবে। একটি উন্নয়নশীল দেশের কাছে সেটিই প্রত্যাশিত।

বাজেট বাড়াতে বাড়তি রাজস্ব যেমন জরুরি তেমন বাড়তি বাজেটের সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে যথাযথ বাস্তবায়নও দরকার। সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে, দরিদ্র নাগরিকদের করোনার অভিঘাত থেকে বাঁচাতে বিশেষ সহায়তা হিসেবে ১০ হাজার ১৭৩ কোটি টাকার যে সাতটি প্যাকেজ সরকার ঘোষণা করেছিল সে অর্থের ৫৬ শতাংশই এখন পর্যন্ত বণ্টন করা যায়নি। মানতেই হবে এ ক্ষেত্রে টার্গেটিং একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবু পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং আমাদের জনপ্রশাসনের ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধির নিরিখে আমরা আশা রাখব আগামী অর্থবছরে এ ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়বে। করোনা সংকট আরও কতটা গভীর হবে তা আমাদের জানা নেই। তবু নিজেদের সক্ষমতার ওপর আস্থা রেখে বলা যায়, যদি আমাদের শক্তি ও সম্পদগুলোর সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় তাহলে আমরা ঠিকই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব।

এমএসএমইর জন্য প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়নেও আশানুরূপ গতি আমরা দেখিনি। এ প্রণোদনা বিতরণ প্রক্রিয়াটি মনিটরিংয়ের জন্য একটি ডিজিটাল ড্যাশবোর্ড ব্যবস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের চালু করার কথা। শুনেছি প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে। ব্যাংকগুলো পাসওয়ার্ডও পেয়ে গেছে। এখন কাজটি শুরু করে দেওয়ার পালা। একইভাবে যে স্টার্ট-আপ তহবিল তৈরির উদ্যোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়েছে তাও মনিটর করা দরকার। অনানুষ্ঠানিক উদ্যোক্তাদের অতিক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার জন্য আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের মাধ্যমে তাদের এমএফএস লেনদেন বিবেচনা করে ই-কেওয়াইসি সাপেক্ষে ঋণ দেওয়ার একটি সফল পাইলট সম্পন্ন করেছে একটি ব্যাংক ও একটি এমএফস প্রোভাইডার। এ অভিজ্ঞতা কজে লাগিয়ে অনানুষ্ঠানিক উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগও নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত যে প্রণোদনাগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো প্রধানত টার্গেট করেছে ঋণগ্রহীতাদের। আমানতকারীদের জন্য কোনো বিশেষ সুবিধা কিন্তু দেওয়া হয়নি। মহামারীর ফলে আমানতকারীরা যে ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন তা কিছুটা হলেও পুষিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা চাই। একটি ন্যূনতম পরিমাণ যথা ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ সহজতর করা এ ক্ষেত্রে একটি উপায় হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (ছয় মাস) সঞ্চয়পত্র কেনার শর্তগুলো সহজতর করা যায় কি না তা ভাবা যায়। ক্ষুদ্র আমানতকারী যেমন স্কুল ব্যাংকিংয়ের হিসাবধারীদের ক্ষেত্রে আমানতকারীদের নিট জমা যাতে কমে না যায় সে লক্ষ্যে উৎস কর এবং একাধিকবার সার্ভিস চার্জ আদায় নিয়েও নতুন করে ভাবা দরকার। একইভাবে আয়করযোগ্য নয় এমন আমানতকারীদের ক্ষেত্রে টিন নম্বর থাকা-না থাকার ভিত্তিতে উৎস কর আদায়ের বিষয়টিও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। তবে আমাদের মনে হয় মহামারীজনিত অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মনিটারি পলিসির মাধ্যমে বহুসংখ্যক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেগুলো আরও কার্যকরের উদ্যোগ অবশ্যই নিতে হবে। তবে এর পাশাপাশি ফিসকাল পলিসি ইন্টারভেনশনকেই এখন বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষের হাতে টাকা পৌঁছানোকেই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। আসন্ন বাজেটে তাই এ দিকটিতে বেশি নজর দেওয়া কাম্য। আর এজন্য গ্রামগঞ্জে অবকাঠামো নির্মাণে ও সংস্কারে সরকারি খরচ বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। এর পাশাপাশি ডিজিটাল ফাইন্যানশিয়াল সার্ভিস চ্যানেলগুলোর উদ্ভাবনী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মহামারীকালে যে মোবাইল ফাইন্যানশিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)-এর ওপর আস্থা বেড়েছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো ১০ কোটি এমএফএস অ্যাকাউন্ট। এমন কি বাংলাদেশ সরকারও মাসে ১ কোটি টাকা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিতরণ করছে এমএফএসের মাধ্যমেই। তবে এমএফএসের ব্যবহার যাতে আরও বাড়ানো যায় সেজন্য আমাদের ভাবতে হবে। এমএফএস ব্যবহারকারীদের জন্য একটি ভর্তুকি ফান্ড গঠন করা যেতে পারে। মাইক্রো-মার্চেন্টরা এমন ভর্তুকি পেলে তাদের মধ্যে এমএফএস ব্যবহারের প্রবণতা বাড়বে। যেমন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যাংকে মার্চেন্ট ডিসকাউন্ট রেট বা এমডিআর বাবদ অর্থ ব্যয় করতে হয়। এ অর্থ তারা ব্যাংককে দেন যখন ক্রেতারা ডিজিটাল পদ্ধতিতে মূল্য পরিশোধ করে। এ এমডিআর বাবদ অর্থটুকু ভর্তুকি হিসেবে দিলে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আরও বেশি মাত্রায় এমএফএস ব্যবহার করবেন। ফলে টাকা ছাপানো এবং বাজারে চালানো বাবদ যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয় তা সাশ্রয় হবে।

আমরা আরও আগে থেকেই বিশেষ করে নগরাঞ্চলের অতিদরিদ্র এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত পরিবারগুলোকে এমএফএসের মাধ্যমে প্রণোদনা দেওয়ার আহ্বান করে আসছি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ফলে যে লকডাউন চলছে এ সময় তারা আবার নতুন করে বিপাকে পড়বেন। তাই অন্তত পাইলট ভিত্তিতে হলেও কিছু কিছু এলাকায় মোবাইল ট্রানজাকশন (যেমন মাসিক ইউটিলিটি বিল পরিশোধের পরিমাণ, টকটাইম কেনা বাবদ ব্যয় ইত্যাদি) বিবেচনা করে অতিদরিদ্র মানুষদের চিহ্নিত করে তাদের মোবাইল অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম টাকা পাঠানো যেতে পারে। এ ছাড়া শ্রমজীবী মানুষ বেশি বসবাস করেন এমন এলাকায় ১০ টাকা কেজি চাল বিক্রির কর্মসূচিটি সফল হয়েছে চলতি অর্থবছরে। আসন্ন অর্থবছরে এর পরিধি আরও বাড়ানো উচিত। লকডাউনকালে যাদর ঘরে খাবারের সংকট হবে তারা যেন সেটা প্রশাসনকে অবহিত করতে পারে সেজন্য একটি হটলাইন চালুর উদ্যোগ থাকা দরকার এবারের বাজেটে। নতুন এ হটলাইনের সঙ্গে আগে থেকে চালু থাকা এ রকম অন্য হটলাইনগুলোর সমন্বয় করা গেলে আরও ভালো ফল পাওয়া সম্ভব। এ রকম আরও উদ্ভাবনী উদ্যোগ পাইলটের মাধ্যমে ‘করে করে শিখে’ এগোনোর বিকল্প নেই।

মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে আমাদের জীবন-জীবিকা আবারও ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। সরকার আগের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সতর্কতার সঙ্গেই এগোচ্ছে। ইতিমধ্যে আবারও ‘কঠোর লকডাউনে’র কথা শোনা যাচ্ছে। তবে অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে রপ্তানির চাকাও চলমান রাখা চাই। বিদেশি বায়ারদের যে অর্ডারগুলো এর মধ্যে পাওয়া গেছে সেগুলোর সরবরাহ নিশ্চিত করতেই হবে। সে বিবেচনার জায়গা থেকেই স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে লকডাউনেও শিল্পকারখানা খোলা রাখার কথা বলা হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবসম্মত সন্দেহ নেই। তবে স্বাস্থ্যবিধি যেন সত্যিই কঠোরভাবে কারখানাগুলোয় মানা হয় তা নিশ্চিত করতে নিরন্তর মনিটরিং বহাল রাখতে হবে। অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে হবে তবে আগে মানুষের জীবনের নিরাপত্তাটুকু নিশ্চিত করতে হবে। মহামারী থেকে উত্তরণের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াটি অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সবুজ হতে হবে। ইতিমধ্যে বিএসইসি ১০০ কোটি টাকার গ্রিন বন্ড চালু করেছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবুজ প্রবৃদ্ধির একজন চ্যাম্পিয়ন। তাই পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় রিসোর্স মবিলাইজেশনের লক্ষ্যে গ্রিন বন্ড, সুকুকসহ বিভিন্ন ইনস্ট্রুমেন্ট চালুর পাশাপাশি এগুলোয় যথাসম্ভব কর প্রণোদনা দেওয়ার কথা ভাবা চাই। মনে রাখতে হবে, এবারের বাজেটও হবে মানুষ বাঁচানোর। কাজেই প্রবৃদ্ধি বা বাজেট ঘাটতি নিয়ে দুর্ভাবনা না করে কী করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো যায় সেদিকেই বেশি নজর দেওয়া উচিত। এ দুঃসময়ে ৬ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি অর্জন করা গেলেও মন্দ কি। আমার বিশ্বাস, এ দিয়েই আমাদের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা সময়মতো অর্জন করতে পারব। পূর্ণোদ্যমে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার শুরু হলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার দ্রুতই আরও অনেকটাই বেড়ে যাবে। এখন তাই মানুষ বাঁচিয়ে টিকে থাকার ওপরই বেশি বেশি জোর দিতে হবে নীতিনির্ধারকদের।

 

                লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

                ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর