রবিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

গরম বাতাসে পুড়েছে কৃষকের স্বপ্ন

শাইখ সিরাজ

গরম বাতাসে পুড়েছে কৃষকের স্বপ্ন

সারা বিশ্বেই করোনার প্রকোপ বেড়ে চলেছে। আমাদের দেশে চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। হঠাৎ সংক্রমণের হার বেড়েছে বহুগুণে। বেড়েছে মৃত্যু। আমি যখন এ লেখা লিখতে বসেছি তখন দৈনিক মৃতের সংখ্যা ১০০ ছুঁতে চলেছে। হাসপাতালগুলোয় রোগীর জন্য বেড খালি নেই। সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে ছুটছে। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে বাধ্য হয়েই সরকারকে লকডাউনের ঘোষণা দিতে হয়েছে। প্রথমে ঢিলেঢালা লকডাউন চললেও এখন কঠোর লকডাউনের একটা চেষ্টা চলছে। অর্থনৈতিক কারণে শিল্পকারখানা বন্ধ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতাও তত সমৃদ্ধ নয় যে ঘরে বসে থেকে দিব্যি দিন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব। কারও কারও কাছে করোনার চেয়ে ক্ষুধা ভয়াবহ। গত বছর এই সময়ে আমাদের কৃষককে গুনতে হয়েছে অপরিসীম ক্ষতি। বিশেষ করে ফুল, মাছ ও সবজি চাষিদের মুখোমুখি হতে হয় রূঢ় বাস্তবতার। তাদের এমন ভয়াবহ ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়নি দীর্ঘদিন। পয়লা বৈশাখ ঘিরে দেশের বড় এক ফুলবাণিজ্য। গতবারের মতো এবারও এ বড় উৎসবটিতে কোনো ফুল বিক্রি করতে পারেননি কৃষক। ফলে এবারও বড় ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের।

এ সময়টায় আমি শঙ্কিত থাকি হাওরের কৃষক নিয়ে। ওখানে একটা মাত্র ফসল। সেটা ঠিকঠাক মতো তুলতে না পারলে সারা বছর অভাব-অনটনে কাটাতে হয়। শুধু তাই নয়, এ ফসল করতে অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকই বিভিন্ন এনজিও থেকে শুরু করে মহাজনদের থেকে ঋণ নেয়। তাই এ ফসল ঠিকঠাক তুলতে না পারলে বড় বিপদে পড়তে হয় তাদের। প্রায় প্রতি বছরই ওখানকার কৃষককে আগাম বন্যা, না হয় শিলাবৃষ্টির মুখোমুখি হতে হয়। এবারও করোনার মতোই এক অচেনা দুর্যোগের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে হাওরসহ দেশের ৩৬ জেলার হাজার হাজার কৃষককে। ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় বেশ কিছু অঞ্চলের ওপর দিয়ে গরম বাতাস বয়ে গেছে। এ কারণে ধানসহ অন্যান্য ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে সারা দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হিটশকের (গরম বাতাসের প্রবাহ) কারণে ৩২৮ কোটি টাকার বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে। অনেক অঞ্চলের ধান গাছগুলো ফ্লাওয়ারিং স্টেজ বা মিল্কিং স্টেজে (ধানে চাল গঠনের পর্যায়ে) থাকায় গরম বাতাসে এগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে গাছে ধানের শীষ থাকলেও ধান সব চিটা। এসব ধান গাছ থেকে আর চাল পাওয়া যাবে না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, মোট ৩৬ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ হিটশকে ২১ হাজার ২৯২ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। যাতে সম্ভাব্য ফলন পাওয়া যেত প্রায় ১ লাখ টন। ধানের পাশাপাশি ভুট্টা, সবজি, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী ও কলার ফলন নষ্ট হয়েছে। সব মিলে টাকার অঙ্কে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩৪ কোটির বেশি। এতে মোট উৎপাদন কম হবে ৯৯ হাজার ৯৬৮ মেট্রিক টন যার মধ্যে ৯৫ হাজার ৯৩৪ টন বোরো।

সারা দেশ থেকেই চ্যানেল আইয়ের প্রতিনিধিরা সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাকে অবগত করছিলেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার হাওর এলাকা। সে অঞ্চলগুলোর অবস্থা সরেজমিন দেখার জন্য ছুটলাম।

হাওরাঞ্চল মানেই বিস্তৃত ধান খেত। মাঠের পর মাঠ শুধু ধান আর ধান। বিশাল হাওরের বুকে পাকা রাস্তায় গাড়ি করে যেতে যেতে চারপাশের ধান খেতে চোখ জুড়িয়ে যায়। তবে এ সময়টাতে ধান নিয়ে যেমন কর্মব্যস্ততা থাকে তেমনটি চোখে পড়ছে না। নেত্রকোনার মদন উপজেলার উচিতপুরে ধানের অস্থায়ী বাজারে ধান ব্যবসায়ীদের হতাশ মুখ। এই সময়ে হাওরের ধান কাটার নতুন এক বাণিজ্য শুরু হয়েছে। হার্ভেস্টার দিয়ে ধান কেটে দেওয়ার। এমনই একজন আনোয়ার হোসেন। আনোয়ার হোসেন ছয়টি হার্ভেস্টার নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু হাওরের ধানের অবস্থা দেখে তিনিও হতাশ। চিটার পরিমাণ এত বেশি যে কৃষক আর ধান কাটাতে চাচ্ছেন না। কৃষক আলাদিন নিয়ে গেলেন তার নিজের খেতে। বিশাল ধানের খেত। বললেন, ৩০ একর জমি তিনি এবার চাষ করেছেন। কিছু নিজের, অধিকাংশই লিজ নিয়ে। ধানের খেত দেখলে মনে হয় পাকা ধানে ভরা। কিন্তু ধানের রঙ কিছুটা ফ্যাকাসে। আলাদিন খেত থেকে এক গোছা ধান নিয়ে এনে দেখালেন। চোখ ভিজে উঠল তার। ‘দেখেন কিচ্ছু নাই। সব চিটা। কাল থেকে বউ-বাচ্চা-মা-বাবা নিয়ে কী খায়াম? কী করবাম? কিছুই বুঝে আসতেছে না। ফসল দেখে কী আনন্দেই না ছিলাম। মুহূর্তের বাতাসে সব শেষ হয়া গেল!’ এ হাহাকার শুধু আলাদিনের নয়, খাইরুল, বিকাশ, বাছেত, সোহেল, নির্মলসহ অনেক কৃষকের। ১৫ বিঘায় ধান ছিল জুবেল মিয়ার। এ সোনার ফসলের পেছনে তার বিনিয়োগ ছিল সবকিছু। ছিল ঋণ। সব শেষ হয়ে গেছে। কৃষক আবদুল লতিফ বললেন, একদিকে পেটের খাওয়া... অন্যদিকে ঋণের বোঝা... সব মিলিয়ে  দিশাহারা অবস্থা এখন আমাদের।

আর একটু সামনে এগোতেই গোবিন্দশ্রী বিচুইয়া হাওর। মাঠের দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু এবার এ খেত শেষ সময়ে এসে মন ভেঙে দিয়েছে কৃষকের। ধানের গোছায় ধান নয়, আছে চিটা। এই সময়ে এখানে ধান মাড়াইয়ের জমজমাট উৎসব জমে যাওয়ার কথা। কিন্তু এবার জমেনি। অল্পবিস্তর ফসল পেয়েছে কৃষক এজহারুল ইসলাম। সবার ক্ষতির মধ্যে মানসিক শক্তি হারিয়েছেন তিনিও। বলছিলেন, ‘একদিকে করোনা অন্যদিকে গরম বাতাস... সবই শেষ হয়ে গেছে।’

কৃষকের মুখে যেন কোনো কথা নেই। গরম বাতাসে উধাও হয়ে গেছে এবারের ফসলি স্বপ্ন। বোবাকান্নার রেশ চোখে-মুখে। গরম বাতাসে হঠাৎ এ ক্ষতির গভীরে তলিয়ে দেখা হয়নি এখনো। স্থানীয় কৃষকের কাছে এ অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। তবে সবাই এটুকু বুঝেছেন, দেরিতে রোপণ করা খেতগুলোই আক্রান্ত হয়েছে।

কৃষি ও কৃষকের এ ক্ষতির খোঁজ রাখছে স্থানীয় প্রশাসন। খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন মাঠে। তিনি জানালেন, খালিয়াজুরীতে ২১ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৭ হাজার হেক্টরে হাইব্রিড জাতের ধান, ৩ হাজার ৪০০ হেক্টরে ‘২৯’ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। ‘২৮’ জাতের ধান আগেই উঠে গেছে। হাইব্রিড ও ‘২৯’ জাতের ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলছে, নেত্রকোনায় এবার মোট ১ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর এলাকায় বোরো আবাদ হয়। এর মধ্যে ক্ষতির মুখে পড়েছে ১৪ হাজার হেক্টর। এর প্রায় ৭ হাজার হেক্টরই হাওরে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সব মিলিয়ে অর্ধলক্ষাধিক কৃষক। নেত্রকোনার কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সহকারী পরিচালক কৃষিবিদ হাবিবুর রহমান জানালেন, নেত্রকোনায় বোরো ধানের ফলনের তুলনায় ক্ষতির পরিমাণ ৪%। কিন্তু যে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ক্ষতি হয়ে গেছে অনেকখানি। তবে কৃষি বিভাগ ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছে। তাদের সার্বিক সহায়তার ব্যাপারে সরকার নিশ্চয়ই উদ্যোগী হবে।

খোঁজ নিয়ে জানলাম এ বিষয়ে সরকারি তৎপরতা সমন্বয় করছে জেলা প্রশাসন। কথা হলো নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজী মো. আবদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি সহযোগিতা দেওয়ার সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। এ বিষয়ে দ্রুতই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

করোনা পরিস্থিতিতে কৃষি উৎপাদনের ওপর সরকার বিশেষ জোর দিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এবার বোরোতে আবাদ বেড়েছে ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে। সে হিসাবে এবার সবকিছু ঠিক থাকলে বোরো মৌসুমে আবাদ হওয়ার কথা সবচেয়ে বেশি ধান। এ বছর আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪৮ লাখ ৫ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয় ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ হেক্টরে। মোট উৎপাদনের প্রভাব থাকবে আকস্মিক এ গরম বাতাসে ফসলহানি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা হবে কয়েক লাখ। করোনা পরিস্থিতির ভিতর এ ক্ষতি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে উঠেছে এসব কৃষকের জন্য। এই সময়ে এ ক্ষতির প্রভাব হতে পারে বহুমুখী। সরকার অত্যন্ত দক্ষতায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে আবার উঠে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করবে, পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদন ও পরবর্তী ব্যবস্থাপনায়ও সমান তৎপরতার নজির রাখবে এ চাওয়া কৃষকের। লেখাটি যখন শেষ করতে চাইছি ঠিক সে সময় একজন কৃষক ফোন দিলেন মেহেরপুর থেকে। ফোনের ওপাশ থেকে অনেক মানুষের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। কৃষক জানালেন, অজানা কারণে খেতের পর খেতের ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে। কী কারণে এমনটা হচ্ছে তারা ধরতে পারছেন না। কৃষি বিভাগের কাউকে পাশে পাচ্ছেন না। আমাকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানালেন। এমন একটি খবর কুড়িগ্রাম থেকেও পেয়েছি। আশঙ্কা হচ্ছে ধানের ব্লাস্ট রোগ কি না। মনে পড়ছে ২০১৬ সালে গমের ব্লাস্ট রোগ যখন ভয়াবহ আকার ধারণ করল তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. তোফাজ্জল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, গমের ব্লাস্ট নামক সর্বগ্রাসী ছত্রাকের জন্য অনুকূল আবহাওয়া হচ্ছে ১৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা, গাছের ফুল আসার সময় এ তাপমাত্রা ব্লাস্ট আক্রমণের কারণ হতে পারে। এ ছাড়া বৃষ্টি ও কুয়াশায় গাছের পাতা ১০ ঘণ্টার বেশি সময় ভেজা থাকলে এর প্রকোপ ভয়াবহভাবে বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে জলবায়ুর পরিবর্তন ব্লাস্ট রোগের জন্য বড় এক কারণ হতে পারে। তিনি এও বলেছিলেন, ধানেও ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ হতে পারে। এখন গবেষণা করে দেখতে হবে এ দুর্যোগের মূল কারণ কী। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি আগামীতে যেন এমন দুর্যোগের মুখোমুখি হতে না হয় তার জন্য আমাদের আগেই প্রস্তুত হতে হবে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর