সোমবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা
অতিথি কলাম

দুঃসময়ে খুব দরকার ছিল মওদুদ আহমদকে

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

দুঃসময়ে খুব দরকার ছিল মওদুদ আহমদকে

কয়েক দিন আগে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সহধর্মিণী বেগম হাসনা মওদুদ আমাকে তাঁর গুলশানের ফ্ল্যাটে ডেকেছিলেন। হাসনা মওদুদের আরেকটি পরিচয় তিনি পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের মেয়ে। এ ছাড়াও তার নিজস্ব পরিচয় বেশ উল্লেখ করার মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ পাস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। এ ছাড়াও তিনি জাতিসংঘে কাজ করেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলোর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। হাসনা মওদুদ এখন বড় একা, দুই ছেলে হারিয়েছেন অনেক আগেই। মেয়ে থাকেন নরওয়েতে স্বামী-সন্তানসহ। এই নিঃসঙ্গ জীবনে ব্যারিস্টার মওদুদের স্মৃতিই তাঁর সঙ্গী। হাসনা মওদুদ আমাকে ডেকেছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদের লাইব্রেরি দেখার জন্য এবং সেই সঙ্গে তাঁর অপ্রকাশিত বইয়ের বিষয়ে কথা বলার জন্য। লাইব্রেরি দেখে আমার মনে হলো একজন শীর্ষ আইনজীবী, বরেণ্য রাজনীতিবিদ এবং উঁচুমানের লেখক ছাড়াও তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ একজন পাঠক এবং গবেষক। তাঁর লিখিত সব কয়টা বই সে প্রমাণ বহন করে। ব্যারিস্টার মওদুদের জীবনী এত বেশি বর্ণাঢ্য যে, স্বল্প পরিসরে তাঁর সম্পর্কে কিছু লেখা আমার জন্য অত্যন্ত কষ্টকর। আমি লেখক নই। যেটুকু অভ্যাস ছিল, রাজনীতির ডামাডোলে তাও নিঃশেষ প্রায়। ব্যারিস্টার মওদুদ এই দেশের রাজনীতিতে একজন কিংবদন্তির পুরুষ এ কথা বললে অনেকে ভ্রু কুঁচকালেও এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না তিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়েই বাংলাদেশে রাজনীতি করেছেন। আমার কাছে মনে হয় তিনি আপাদমস্তক একজন উদারপন্থি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে রাজনীতির বিভিন্ন বাঁকে তাঁর অবদান রেখেছেন। ছাত্রজীবনে স্কুল থেকেই রাজনৈতিক সচেতন এক কিশোর বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্যে আইন পড়ার সময় থেকে দেশের স্বাধিকারের জন্য, পরবর্তীতে স্বাধীনতার জন্য, মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিনি কাজ করেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর অগ্রণী ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাঁর ভূমিকা, অবদান এবং স্বাধীনতার পরে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা, নিঃসন্দেহে ইতিহাসের অংশ হিসেবে থাকবে। ১৯৭২-এর পরে তৎকালীন সরকারের গণবিরোধী শাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থান গ্রহণ এবং ভুক্তভোগীদের পক্ষে আইনি সহায়তা নিয়ে অবস্থান গ্রহণ তাঁর সেই পরিচয়কেই স্পষ্ট করে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে তিনি হয়তো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন, সে জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা বিতর্কিত হলেও সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্র প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে তিনি সব সময়ই ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে কর্তৃত্ববাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। বহুবার সামরিক শাসনের ফলে নির্যাতিত হয়েছেন এবং জীবনের শেষ দিকে ফ্যাসিবাদ ও কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে অসংখ্য মামলার শিকার হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন এবং নিজের বসতবাড়ি পর্যন্ত হারিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে একজন নিখাদ আলোকিত জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক নেতা ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ। তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত পরিশীলিত ভাষায় পরিমিত বক্তব্য প্রদানে। গণমাধ্যমের কর্মীদের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন সেই কারণেই। ঠিক যতটুকু বলার দরকার যা গণমাধ্যমের গ্রহণীয় হবে তিনি সেটুকু বলতেন। আইনমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রণীত বেশ কিছু আইন বিচারব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করেছে। উঁচুমাপের লেখক হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত এবং সমাদৃত। তাঁর বেশ কয়েকটি বই বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ওপরে লিখিত বইগুলো বিদেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাঁর শিক্ষা, জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি একটি গণতান্ত্রিক সমাজকে হয়তো অনেক বেশি সমৃদ্ধ করত, বর্তমানের এই কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচার এবং একনায়কতন্ত্রের অন্ধকার সমাজে তাঁর চলে যাওয়া নিঃসন্দেহে অনেক শূন্যতার সৃষ্টি করল। এই দুঃসময়ে তাঁর খুবই দরকার ছিল।। ব্যক্তিগতভাবে ব্যারিস্টার মওদুদের কাছে আমি অনেক ঋণী। তিনি বর্তমানের স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন অভিভাবকের মতো, উপকৃত হয়েছি তাঁর রাজনৈতিক বিশ্লেষণে এবং পথনির্দেশনায়। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় উন্নত চিকিৎসায় সিঙ্গাপুরে যাওয়ার আগে অসুস্থ হয়ে যখন এভারকেয়ার হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আমিসহ অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। অত্যন্ত অসুস্থ, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তখনো বললেন “এবার আর স্টান্ডিং কমিটির মিটিংয়ে হয়তো থাকতে পারব না, ইনশা আল্লাহু পরের শনিবার থাকব।” ব্যারিস্টার মওদুদের পরের মিটিং-এ উপস্থিত থাকা হয়নি। আর কোনো মিটিং থাকবেন না। থাকবেন আমাদের হৃদয়ে আমাদের অন্তরে। গণতন্ত্রের সংগ্রামে, লাখো মানুষের আন্দোলনে।। ভাবী বাসায় বলছিলেন, “উন্নত চিকিৎসা চেয়েছিল মওদুদ। চেষ্টা করেছি, এই করোনাকালে কোয়ারেন্টাইনের মধ্যেও নিয়ে গেছি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। জীবিত ফিরিয়ে আনতে পারলাম না।  আপনারা তাঁকে মনে রাখার চেষ্টা করবেন।” আমি উত্তরে বলেছিলাম উনি জীবিত থাকবেন তাঁর এলাকায় মানুষের হৃদয়ে, আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে, সংগ্রামে, আন্দোলনের ইতিহাসে।

                লেখক : মহাসচিব, জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি।

সর্বশেষ খবর