শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

লকডাউনে পুলিশের ভূমিকা এবং ‘সাতানিরহাট’

জহিরুল হক শামীম

লকডাউনে পুলিশের ভূমিকা এবং ‘সাতানিরহাট’

‘আমি মাস্ক ইচ্ছা কইরাই পরি নাই। কারণ আমার গোষ্ঠীতে একজনও মরে নাই। আমার নানার গোষ্ঠীতেও মরে নাই। আমার পার্শ্ববর্তী এলাকায়ও কেউ মরে নাই। আমি মাস্ক ব্যবহার কইরা নিজে মরমু নাকি?’ জনৈক ব্যক্তির ডায়ালগের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে বেশ হাসির খোরাক জোগানোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মাস্ক বিষয়ে অনীহার চিত্রটিও স্পষ্ট করেছে।

ঠিক এমনি সময়ে ‘চ্যালেঞ্জে জীবন-জীবিকা’ ও ‘ভয়াবহতার দিকে পরিস্থিতি’ শীর্ষক দুটি শিরোনাম বাংলাদেশ প্রতিদিন করেছে ২২ ও ২৩ এপ্রিল। শিরোনাম দুটির যথার্থতা নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। প্রশ্ন হলো, এ ভয়াবহ পরিস্থিতি আমরা কীভাবে সামাল দেব? ভয়াবহ পরিস্থিতি মানে তো শুধু সংক্রমণ বৃদ্ধি, আইসিইউ অক্সিজেন বা টিকার সংকট নয়। সংকট জীবন-জীবিকারও। জীবন আগে না জীবিকা আগে এ বিতর্ক নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করবে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ সব স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞই বলছেন মাস্ক ব্যবহার, জনে জনে দূরত্ব রক্ষাসহ বারবার হাত ধোয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প জ্ঞান করোনা নিবারণে মানুষের জানা নেই। টিকা নিলেই করোনা আক্রান্ত হবেন না এমন নিশ্চয়তাও নেই। টিকা মানবদেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তবে এতে সময় লাগে। তা ছাড়া করোনা নিত্যই তার ধরন বদলাচ্ছে। এ অবস্থায় লকডাউন ও দূরত্ব বজায় রাখাই সংক্রমণ থেকে রক্ষার আপাত উপায়। হ্যাঁ, সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি আমাদের দেহরক্ষার জন্য জীবিকারও প্রয়োজন। সরকার তা ভেবেই এবার সর্বাত্মক লকডাউন চলাকালে শিল্পকারখানা চালু রাখার অনুমতি দিয়েছে। প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার জন্য মুভমেন্ট পাসের ব্যবস্থাও চালু রেখেছে। চলমান লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র, দুস্থ, ভাসমান ও অসচ্ছল মানুষের সহায়তায় ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ভারতে করোনায় মৃতের সংখ্যা দিনে ২ হাজার ৮১২-তে পৌঁছেছে। অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। এ বিষয়ে দিল্লি হাই কোর্টে ম্যারাথন শুনানি শেষে বিচারপতি বলেছেন, ‘অক্সিজেনের অভাবে রোগী মারা যাচ্ছে। যেমন করেই হোক রোগীদের অক্সিজেন দিন। প্রয়োজনে ভিক্ষা করুন, ধার করুন, চুরি করুন। তবু অক্সিজেন এনে রোগীদের দিতেই হবে।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন : ২৩ এপ্রিল)

এমনতর ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বে যখন টিকার সংকট, বাড়ছে রোগী, আইসিইউ ও অক্সিজেন সংকটে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে তখনো যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মুখে মাস্ক না লাগিয়ে হাওয়া খেয়ে ঘুরে বেড়াই, প্রাইভেট কার নিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় যানজট তৈরি করি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য আন্দোলনে নামি, শিং মাছ কিনতে উত্তরা থেকে রামপুরা চলে আসি, পুলিশের সঙ্গে বিতন্ডায় জড়াই তাহলে আমরা কীভাবে করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্তি পাব? এ দায় কি সরকারের একার? নাকি আমাদেরও? রাতারাতি টিকা আনা বা উৎপাদন করা, শত শত আইসিইউ সংযোজন করা বা অক্সিজেনের অবাধ ফ্লু নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কারণ করোনা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সব দেশেই ছোবল হেনেছে। তা ছাড়া এমন ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার জন্য কোনো দেশ বা সরকারই প্রস্তুত ছিল না। এ অবস্থায় কেবল আমরা নিজেরাই পারি সংক্রমণের হার রোধ করতে এবং তা খুব সহজেই। আমরা নিজেদের মহৎ জাতির অংশ দাবি করি অথচ সামান্য ১০ টাকা দামের একটা মাস্ক পরতে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে আর হাত ধুতে আমাদের যত অনীহা। আমরা যদি এ সহজ কাজগুলো সচেতনভাবে করি তাহলে অবশ্যই করোনা সংক্রমণ রোধ হবে ইনশা আল্লাহ। তাহলে আর লকডাউন দেওয়ারও প্রয়োজন পড়বে না। জীবন-জীবিকাও হুমকির মুখে পড়বে না।

কিন্তু আমরা তা কিছুতেই মানতে রাজি না। মুখের মাস্ক থুতনিতে ঝুলিয়ে রাখা, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বাইরে বের হওয়া, মুভমেন্ট পাস নিয়ে শিং মাছ কিনতে যাওয়া অথবা হেরোইন পাচার করার মতো ঘটনাও এ লকডাউনকালে ঘটছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। পুলিশ মুভমেন্ট পাস বা আইডি দেখতে চাইলে আমরা ক্ষুব্ধ হচ্ছি। এ ক্ষেত্রে অনায়াসে একটি প্রশ্ন করাই যায়, কেন আমরা ক্ষুব্ধ হই? কেন আমরা মাস্ক পরি না? কেন আমরা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখি না? কেন আমরা একে অন্যের গা ঘেঁষে দাঁড়াই? কেন আমরা বাস, ট্রেন, ফেরিতে ওঠার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ি? আমরা যদি এসব না করি তাহলে তো লকডাউনেরও দরকার হতো না। পুলিশেরও এত বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হতো না। আমরা কজন খবর রাখি যে ৯৩ পুলিশ সদস্য করোনা ডিউটি পালন করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন। ২০ হাজার আক্রান্ত হয়েছেন। আমরা কজন জানি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে কতজন ডাক্তার তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন? করোনা সচেতনতায় কর্তব্য পালন করতে গিয়ে কতজন সংবাদকর্মী মৃত্যুবরণ করেছেন?

সে খবর রাখা আমরা প্রয়োজন বোধ করি না। আমরা নিউমার্কেটে-পুলিশ-ডাক্তার বিতন্ডাকে ফলাও করে প্রচার করি। একবারও ভাবী না ঠিক ওই একই সময়ে হাজার হাজার পুলিশ, ডাক্তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের কর্তব্যকর্ম করে যাচ্ছেন। আমরা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে’ বড় করে তুলি কিন্তু ‘নিরবচ্ছিন ঘটনা’ নজরেই পড়ে না।

আমরা ঢাকা মহানগরীতে যা পারিনি তা-ই করে দেখিয়েছেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামের ‘সাতানিরহাট’ বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতা, দোকানদার ও কমিটির লোকেরা। ওই বাজারে মাস্ক পরা ছাড়া যাওয়া যায় না, কেনাবেচা করা যায় না। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই মাস্ক পরেন। এমনকি এ করোনাকালে ইজারাদার কারও কাছ থেকে টোলও নেন না। প্রত্যন্ত এলাকায় গ্রামবাসী নিজেরা সচেতন হয়ে যা পেরেছেন আমরা কি তা পারি না? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে যদি দেশ স্বাধীন করতে পারি তাহলে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডাকে আমরা মাস্ক পরে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে কি কভিডমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি না?

লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর