শুক্রবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

’৭১-এর শরণার্থী জীবন : ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

’৭১-এর শরণার্থী জীবন : ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা

ভয়াল অদৃশ্য অণুজীব করোনার করাল গ্রাসে বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত, জর্জরিত। করোনার বিষময় বিষে কেটেছে ২০২০। আবার এখন এ বছর বাংলাদেশে কভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ প্রবহমান। প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। গেল বছরের তুলনায় এ বছর সংক্রমণ যেমন বাড়ছে তেমন পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। প্রতিদিন সকালে উঠে খবরের কাগজ খুললেই এক বা একাধিক পরিচিত বিশিষ্ট মানুষের ছবি দেখতে পাই। এ কোনো সুসংবাদের ছবি নয়। এ কারও সাফল্যগাথারও ছবি নয়। এ ছবি আমাদের জানান দেয় ছবির মানুষটি আর নেই। তিনি অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন। এক অনন্ত জগতের বাসিন্দা হয়েছেন ছবির চেনা মানুষটি। বুকটা ভারী হয়ে আসে। জানি না কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে মানবকুল। এমন বিপর্যস্ত সময়েও বিস্মৃত হইনি জীবনের কতক প্রতিকূল চিত্র।

আমাদের প্রিয় এ ধরিত্রী বিশ্বের একটি গ্রহমাত্র। এখানে মনুষ্য বসতি যেমন আছে তেমনই রয়েছে অনেক জীব-অণুজীবের বাস। বিশ্বব্রহ্মান্ডের অন্য কোনো গ্রহ বা উপগ্রহে জীবনের কোনো অস্তিত্ব আছে কি না বা কোনো দিন ছিল কি না তা নিয়ে গবেষণা চলছে নিরন্তর। এ সবই চলছে মানুষের কল্যাণে, পরিবেশের কল্যাণে, সভ্যতা বিকাশের জন্য। করোনা মহামারীর কঠিন সময়গুলোতেও গবেষণার মতো কঠিন কাজ থেমে নেই। ঠিক যেমন পরিবারের কর্তাব্যক্তির তিরোধানেও থেমে থাকে না পরিবার ও পরিবারের সদস্যদের দৈনন্দিন জীবনযাপন। জীবন চলমান, জীবন গতিময়। এটিই বাস্তবতা। অমানিশাবৃত এ সময়েও স্মৃতিপটে ঘুরে ফিরছে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা, বিশেষ করে ১৯৭১-এর কথা।

ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক ভূখন্ডে বসবাস করলেও সমগ্র মানবকুলের আবাসস্থল এ অভিন্ন গ্রহ পৃথিবী। স্বদেশ প্রত্যেক নাগরিকের নিজস্ব প্রিয় আবাসভূমি। নিজ দেশের প্রতি অপার ভালোবাসা থাকে প্রতিটি মানুষের। আমরাও আমাদের দেশকে ভালোবাসি। বিশ্বের প্রথম কটি ধনাঢ্য দেশের একটি না হলেও এ প্রিয় স্বদেশভূমিই আমাদের মা, আমাদের মাতৃভূমি। এ উপলব্ধিতে হৃদমাঝারে উচ্চকণ্ঠ হয়- ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’।

এ বছর তথা ২০২১ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্মের ৫০ বছর। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। কেউ কি কোনো দিন ভেবেছিল যে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির বছরে বৈশ্বিক অতিমারী করোনা প্রাদুর্ভাবের এক বছর পূর্তি হবে? কিন্তু সেটিই হয়েছে। কী নির্মম বাস্তবতা! আর এ বাস্তবতার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করছি। যদিও জীবনটা কেন যেন এক বিচ্ছিন্নতা ও বিষণ্নতায় আক্রান্ত। প্রিয়জন স্বজনের জন্মদিন পালনের সংস্কৃতি আমাদের সমাজে চর্চিত হয়ে আসছে। আমরা পিতা-মাতার জন্মদিনও স্মরণ ও পালন করি। আর যাদের পিতা-মাতা চলে গেছেন বা গত হয়েছেন তারা তাদের পিতা-মাতার গত হওয়ার দিনটি স¥রণ করেন শোকাবৃত মনে। সেই সঙ্গে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।

২০২১-এ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমরা সবাই গর্ব ও আনন্দের সঙ্গে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি। অনেক সংগঠনও তাদের প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পালন করছে। ১৭ এপ্রিল ছিল মুজিবনগর সরকার গঠনের ৫০ বছর পূর্তির দিন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি পালন করবে। পুলিশ বাহিনীও তাদের বাহিনী গঠনের ৫০ পছর পূর্তি পালন করছে বা করবে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, বিচারকসহ সারা দেশের মানুষ পালন করবেন সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই এ দিনগুলো নিজ বৈশিষ্ট্যের উজ্জ্বলতায় মূর্ত হচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে। আর যাঁর নেতৃত্বে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে, যাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে লাখ লাখ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে, ২ লক্ষাধিক মা-বোন হারিয়েছেন তাদের সর্বোচ্চ সম্মান তাদের সম্ভ্রম তিনি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। করোনা অতিমারীর কারণে এ মহামানবের জন্মশতবার্ষিকীও পালিত হচ্ছে বছরব্যাপী সীমিত আকারে। হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা মিশিয়ে।

প্রতিটি শিশুর জন্মের মধ্যে যেমন আনন্দ আছে তেমন তার পেছনে অব্যক্ত এক কষ্টও থাকে। এ কষ্ট মায়ের। মা তাঁর গর্ভে শিশুটিকে ধারণ করেন নয় মাসের অধিককাল। এ সময়টিতে মাকে কী ধরনের কষ্ট সহ্য করতে হয় তা কেবল গর্ভধারিণী মা-ই জানেন। শিশুটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাকে দুগ্ধপান করানো থেকে শুরু করে তার শুশ্রুষা মা-ই করেন। এত কষ্টের পরও মায়ের কাছে তাঁর শিশু সন্তানের পরিচর্যা সব সময়ই স্বর্গীয় আনন্দের। মা কখনই একে কষ্ট মনে করেন না। আমাদের জন্মদাত্রী মায়ের মতো আমাদের দেশমাতৃকাকেও প্রচন্ড ত্যাগ ও রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে। বিভীষিকাময় ইতিহাসের মহাকাল পেরিয়ে আজ আমরা স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছি। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতের ইতিহাস সংক্ষেপে হলেও ২৩ বছরের। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ২৩ বছরের ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। ১৯৭১ সালে বহু মানুষের আত্মদান ও মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর মধ্য দিয়ে আমরা পাই স্বাধীনতা। তার বিনিময়ে দিতে হয়েছে চরম মূল্য। ‘...দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারও দানে পাওয়া নয়’।

১৯৭১ সালে লাখো-কোটি মানুষের মতো আমরাও নিজেদের নিবাস অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিলাম। বাস্তুচ্যুত হয়ে আমরাও সপরিবারে হয়েছিলাম দেশান্তরিত। শরণ নিয়েছিলাম পাশের রাষ্ট্র ভারতের এক রাজ্যে। আজ আমাদের সেই শরণার্থী জীবনের ৫০ বছর পূর্তি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির আনন্দের বছর আমাদের শরণার্থী জীবনের কথা জানাতে চাই। স্মৃতিপটে অমলিন থাকা জীবনের এ পর্ব আরেক অর্থে কোটি শরণার্থীর বাস্তুচ্যুত জীবনের খন্ডিত চিত্র।

১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করে। পাকিস্তানভিত্তিক রাজনীতির নিয়মানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে। কিন্তু সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা শেখ মুজিবকে হস্তান্তরে অনীহা প্রকাশ করে গোপনে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু আঁচ করতে পারেন। তিনিও তৈরি করে রাখেন দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। যদিও ৭ মার্চই প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন এবং প্রত্যেককেই যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণাসংবলিত বার্তাটি সারা দেশে প্রচারের জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে প্রেরণ করেন। শুরু হলো স্বাধীনতাযুদ্ধ। বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শুরু করে নির্বিচার মানুষ হত্যা- ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে।

ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের প্রতিটি বড় বড় শহরে নির্বিচারে গণহত্যা চালায় পাক বাহিনী। মানুষ দিশাহারা আতঙ্কিত হয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে শহরের নিবাস ছেড়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিতে থাকে। কিছু দিন যেতে না যেতেই পাক সেনারা তাদের এ-দেশীয় দোসরদের সহায়তায় জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ের এলাকাগুলোয় পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়। এরপর তাদের সহিংসতা ও অত্যাচারের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। এ অবস্থায় দিশাহারা মানুষ নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে ছুটতে থাকে পাশের রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে। যে যেভাবে পারে। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ গরুর গাড়িতে, কেউবা নৌকাযোগে। সঙ্গে শিশু-কিশোর সন্তান ও স্বজন। প্রতিদিন হাজার হাজার নারী-পুরুষ সীমান্ত অতিক্রম করতে থাকে। সে সময় ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস আর দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মহীয়সী নারী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি এবং তাঁর সরকার সেদিন সীমান্ত খুলে না দিলে আরও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় নেমে আসত।

১৯৫১ সালের ‘রিফিউজি কনভেনশন’ একটি অন্যতম আইনগত দলিল যা সংজ্ঞায়িত করেছে শরণার্থী কে এবং তার অধিকার কী ও তা কীভাবে নিশ্চিত হবে। এ কনভেনশন অনুযায়ী কেউ যখন ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তার কারণে বা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় চরম নিগ্রহ ও সহিংসতার শিকার হন এবং এ কারণে সৃষ্ট ভীতি তাকে তার দেশ বা ভূখন্ডে অবস্থান করাটা অনিরাপদ করে তোলে তখন বাস্তুচ্যুত এই ব্যক্তি ‘শরণার্থী’। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে কী হয়েছিল? সে সময় বাংলাদেশ ভূখন্ডের ১ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। শরণার্থী হয়ে তারা আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী ভারতের কটি রাজ্যে। এ বিশাল বাঙালি জনগোষ্ঠী প্রকারান্তরে বাধ্য হয়েছিল সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিতে। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসরদের কৃত বর্বর অপরাধমূলক কর্মকান্ড বাধ্য করেছিল এ বিশাল বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত হতে। মুক্তিযুদ্ধকালীন নিরীহ বাঙালি জনগণ হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, আটক, নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়। এসব ছিল বেআইনি ও আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন যা যুদ্ধাপরাধও বটে।

এপ্রিলের শুরু থেকে অক্টোবরের শেষাবধি এমনকি নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশের অগণিত নারী-পুরুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নেয়। শুরু করে শরণার্থীর জীবন যাপন। ভারতীয় সরকারের হিসাবে এর সংখ্যা ছিল ১ কোটির মতো। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এ সংখ্যা হয়তো আরও অনেক বেশি হবে। বিশ্ব ইতিহাসে সম্ভবত এটিই হলো সবচেয়ে বড় দেশান্তর। এ ১ কোটি শরণার্থীর মধ্যে আমি ও আমাদের পরিবারও অন্তর্র্ভুক্ত ছিলাম। শরণার্থীর অধিকাংশই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। সামান্য কিছু শরণার্থী বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে আশ্রয় নেয়। পাক সেনারা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে যে বর্বরতা ও গণহত্যা চালিয়েছিল তার লক্ষ্য ছিল প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যগণ।

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে সংঘটিত ব্যাপক বর্বরতা কোটি মানুষের ‘ফোর্সফুল ডিপোর্টেশন’ সংঘটিত করেছে যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। মূলত সীমান্তসংলগ্ন স্থানগুলোতেই অসংখ্য শরণার্থী শিবির গড়ে ওঠে। পশ্চিম বাংলায় সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির ছিল কলকাতার সল্ট লেকে। এখানে ২ লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় পায় শরণার্থী হিসেবে। ভারতের জনগণ ও সরকার সর্বোচ্চ মানবিকতা দেখিয়েছে বাস্তুচ্যুত এ শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোও ছিল সক্রিয় ও মানবিক।

শরণার্থী হিসেবে কেমন ছিল তাদের নয় মাসের জীবনগাথা? এ বিষয়ের তেমন কোনো বিস্তৃত চিত্র বোধহয় এখনো উঠে আসেনি। কিন্তু এ চিত্রটি সবার সামনে আসা উচিত। সবার জানা উচিত কীভাবে কত সীমাহীন দুর্গতি সঙ্গী করে কেটেছে এ কোটি শরণার্থীর বাস্তুচ্যুত জীবন। বাস্তুচ্যুত এ শরণার্থীদের নয় মাসের বেদনার্ত জীবন কেড়ে নিয়েছে তাদের নিবাস, গৃহসম্পদ, স্বজন। ‘পারসিকিউশন’-এর শিকার তারা। পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর সুসংগঠিত গোষ্ঠীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ও নারকীয় সহিংসতার শিকার তারা। অপারেশেন সার্চলাইটের পর শুরু হয় তাদের এ সহিংসতা ও হত্যাযজ্ঞ।

আমার বাবা তখন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ ও বারহাট্টা নির্বাচনী এলাকায় সদ্যনির্র্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার লক্ষ্যে তিনি মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলার মহেশখলা নামক এক নিভৃত এলাকায় আশ্রয় নেন। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের ভাটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে নিজেকে নিবিষ্ট করেন। আমরা তখন অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশের ভিতরে এ গ্রাম ও গ্রামে আশ্রয় নিয়ে অনিশ্চিত দিনাতিপাত করতে থাকি। জুলাইয়ের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে হঠাৎ একদিন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে বাবা কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার জাওয়ার পীর বাড়িতে আসেন। আমরা নিরাপত্তার জন্য নিজ বাড়ি ছেড়ে সেখানে আশ্রয় নিয়ে অবস্থান করছিলাম। বাবা আমাদের বলে যান, মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তাই আমরাও যেন মেঘালয়ের মহেশখলায় চলে যাই।

অনিরাপদ ও আতঙ্কিত অবস্থার মধ্যে আমরা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। তার পরও যে কোনো সময় পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার সমূহ আশঙ্কা ছিল। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে আমরা ভারতের শরণার্থী জীবনকেই বেছে নিতে রাজি হলাম। তখন আমি ১২ বছরের কিশোর। আমার মনে পড়ে, আব্বা শরণার্থী জীবনের কষ্টের কথা বর্ণনা করছিলেন। পাহাড়-জঙ্গলে সাপ, চিনে জোঁকের উপদ্রবের পাশাপাশি পানীয় জলের অসুবিধার কথা বলছিলেন আম্মাকে। তার পরও সব প্রতিকূল অবস্থা মেনে নিয়েই আমার আম্মা আমাদের নিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে রাজি হয়েছিলেন। শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য। ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট আমার মাসহ আমরা চার ভাই-বোন, মেজ মামা, আমার ছোট দাদা (আব্বার ছোট মামা) এবং আরও দু-এক জন আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে মেঘালয়ের তুরা জেলার মহেশখলায় পৌঁছতে সক্ষম হই।

সীমান্ত অতিক্রম করে মহেশখলা যাওয়ার আগে আমরা খালিয়াজুরি থানার বলী গ্রামে আমার অশীতিপর বৃদ্ধা দাদুকে (বাবার মা) রেখে যাই তাঁর ভাইদের কাছে। নদী ও হাওরের উথাল-পাথাল ঢেউ মাড়িয়ে সন্ধ্যায় মহেশখলায় পৌঁছি। সামনের জীবনটা অনিশ্চিত হলেও অনেকটা নিরাপদবোধ করছিলাম। মহেশখলায় পৌঁছার পর আমরা নৌকাঘাট থেকে উঁচু-নিচু পাহাড়-টিলা পেরিয়ে বেশ কিছু দূরে একটি নলখাগড়ার ঘরে এসে উঠি। মাচার ওপর তৈরি ঘরটির চারদিকে ছিল নলখাগড়া ও ধারী দিয়ে তৈরি করা বেড়া, ওপরে ছিল ছনের ছাউনি, ঘরটির একটি অংশের চালে কিছু পোড়া টিন ছিল। আমাদের এ ঘরগুলোই ছিল শিবিরের সবচেয়ে ভালো ঘর। এভাবে শুরু হয় আমাদের শরণার্থী জীবনের পর্বটি।

মহেশখলা হলো সাউথ গারো হিলসের অধীন বাঘমারা থানার একটি গ্রাম। বাঘমারা বর্তমানে একটি জেলা শহর। যেদিন মহেশখলা পৌঁছলাম তার পরদিন অদূরে শরণার্থী শিবির দেখতে গিয়েছিলাম আব্বার সঙ্গে। নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় বেড়া এবং ছাউনি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে শরণার্থী শিবির। জানলাম এ শিবিরগুলো কেউ তৈরি করে দেয়নি। শরণার্থীরা বাড়িঘর ছেড়ে যখন ভারতের এ রাজ্যে আসে তখন সঙ্গে যে ধারী চাটাই নিয়ে এসেছিল সেগুলো দিয়েই প্রাথমিকভাবে ঘেরা দিয়ে কোনোমতে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করেছিল। গারো পাহাড়ের জঙ্গলে যথেষ্ট পরিমাণ মুলিবাঁশ নামে এক ধরনের বাঁশ হতো। শরণার্থীরা ধীরে ধীরে সে বাঁশ সংগ্রহ করে তাদের মাথা গোঁজার জায়গা তৈরি করতে থাকে। এ বাঁশ সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় গারোদের সঙ্গে শরণার্থীদের প্রায়ই বিবাদ লেগে থাকত। ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত নেতৃবৃন্দ তাদের সহকর্মীদের মাধ্যমে দেনদরবার করে ওইসব ছোটখাটো ঝগড়াঝাঁটি মিটিয়ে দিতেন। এ কাজটি এত সহজ ছিল না। কেননা ভাষাগত একটি প্রতিবন্ধকতা এ ধরনের সমস্যা সমাধানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমার মনে পড়ে, আমরা যে টিলায় থাকতাম সেখানে দুর্গাপুরের বিরিশিরি এলাকার কয়েকজন গারো সম্প্রদায়ের শিক্ষিত মানুষ থাকতেন। তাঁরা যেহেতু বাংলাদেশের অভ্যন্তরের গারো তাই তারা ভালো বাংলা জানতেন। বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভাষাগত জটিলতা দূর করার জন্য তাঁদের সাহায্য নেওয়া হতো। তারা দোভাষীর ভূমিকা পালন করতেন।

কেমন ছিল আমাদের শরণার্থী জীবন? মুলিবাঁশের তৈরি শরণার্থী শিবিরগুলো ছিল অত্যন্ত নাজুক প্রকৃতির। বৃষ্টি হলে এসব শিবিরের ভিতরে পানি ঢুকত। আবার শীতকালে পাহাড়ি এলাকার প্রচন্ড ঠান্ডায় শরণার্থীরা অনেক কষ্ট করেছেন। পাহাড়ি অঞ্চলে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে শীত অনুভূত হয়। সে কারণে নভেম্বরে বলতে গেলে যথেষ্ট শীত নেমে আসত। ছালার চট দিয়ে শরণার্থী শিবিরের বেড়াগুলো ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হতো যাতে হিমেল বাতাস ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। আমাদের ঘরের বেড়াগুলোও ছালার বস্তা দিয়ে ঘিরে রাখা হতো শীত থেকে রক্ষা পেতে। তবে ভারত সরকারের সাহায্য হিসেবে কিছু কম্বল শরণার্থীদের দেওয়া হয়েছিল ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে।

আগেই বলেছি মহেশখলা পৌঁছে আমরা নিরাপদবোধ করছিলাম। সেখানে পৌঁছার অব্যবহিত পরই আমাদের মনে একটা আনন্দ কাজ করছিল। তা হচ্ছে বাবাকে কাছে পাওয়ার আনন্দ। এটি ছিল এক অনিশ্চয়তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আনন্দ। আব্বা যখন মে মাসের প্রথম দিকে মেঘালয়ে চলে গেলেন তখন থেকে আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগত, তাঁর সঙ্গে আর কখনো কি আমাদের দেখা হবে? মাঝেমধ্যেই কষ্টে মন খুব খারাপ হতো। আম্মাকে জিজ্ঞেস করতাম আব্বা কবে ফিরবেন? আমার মায়ের কাছে এর কোনো উত্তর ছিল না। আমরা মহেশখলায় পৌঁছার পর বাবার সঙ্গে দেখা হওয়ায় তাঁর সঙ্গে আর দেখা না হওয়ার অনিশ্চয়তাটি কেটে যায়। বাঁচি-মরি বা দেশে ফিরতে পারি বা না পারি আমি আমাদের পরিবার ও আব্বার সঙ্গে একসঙ্গে আছি সেটিই ছিল বড় প্রাপ্তি ও আনন্দের অনুঘটক। এ অনুভূতি প্রকাশ করা কঠিন।

মনে আছে, আমরা যখন মহেশখলায় পৌঁছি তখন ক্যাম্প পরিচালনার নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। সেপ্টেম্বরের প্রথম থেকেই আমার বাবা মহেশখলা ইয়ুথ ক্যাম্পের ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। আর সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশার এমপিএ আবদুল হেকিম চৌধুরী সাহেব ইয়ুথ ক্যাম্পের অ্যাডভাইজরি কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ইতিপূর্বে চৌধুরী সাহেব ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করা ছাড়াও ক্যাম্প পরিচালনায় অনেক ধরনের দায়িত্ব ছিল ক্যাম্প নেতৃবৃন্দের।

মহেশখলা ক্যাম্পটি সম্ভবত মেঘালয় রাজ্যে অবস্থিত সবচেয়ে বড় ক্যাম্প ছিল। এখানে লক্ষাধিক শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এ ক্যাম্পে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। প্রতিদিন শত শত লোক কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যেই তা হাজারের কোটা ছাড়িয়ে যায়। এ অবস্থায় আমি আব্বাকে অত্যন্ত চিন্তিত দেখতাম। যেহেতু তিনি পেশায় ছিলেন একজন ডাক্তার, ইয়ুথ ক্যাম্প এবং শরণার্থী শিবির পরিচালনার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ডাক্তার হিসেবে তাঁর ওপর এ কলেরায় আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার দায়িত্বও পড়ে। বিএসএফ ক্যাম্পের মাধ্যমে তুরা জেলা সদরে যোগাযোগ করে ভারত বা মেঘালয় সরকারের কাছ থেকে যৎসামান্য ওষুধপথ্যাদি পাওয়া গিয়েছিল। সে সময় কাকতালীয়ভাবে ঢাকা থেকে সিলেটগামী একটি কার্গো জাহাজ ধনু নদে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশের মধ্যে পড়ে যায়। এ কার্গোয় করে পাক বাহিনীর রসদ যাচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা কার্গো জাহাজটি আটক করেন। কার্গো জাহাজ পরিচালনায় নিয়োজিত মিলিশিয়ারা জাহাজের সঙ্গে থাকা স্পিডবোটযোগে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মুক্তিযোদ্ধারা জাহাজের মালামাল জব্দ করে সেগুলো মহেশখলায় নিয়ে আসেন। সেই জব্দকৃত মালামালের মধ্যে কলেরা প্রতিষেধক ইনজেকশন, স্যালাইন, ওয়াটার পিউরিফাইং ট্যাবলেট ছিল প্রচুর। এ ওষুধগুলো তখন কলেরা চিকিৎসায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। আব্বার নেতৃত্বে একটি মেডিকেল টিম দিনরাত কাজ করে অনেক শরণার্থীর জীবন বাঁচান।

মনে আছে, পাহাড়ি ঝরনার পানি আমাদের পান করতে হতো। পানিতে ভারত সরকার-প্রদত্ত ওয়াটার পিউরিফাইং ট্যাবলেট মিশিয়ে তা বিশুদ্ধ করে আমরা সে পানি পান করতাম। ব্লিচিং পাউডারের বিশ্রী গন্ধ। কিন্তু উপায় নেই। শরণার্থী জীবনে এ-ই- তো অমৃতসম। অক্টোবরের মাঝামাঝি আমাদের পড়াশোনার কথা ভেবে বাবার কিছু শুভানুধ্যায়ী আমাদের শিলিগুড়ি অথবা কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলেন। সবারই ধরণা ছিল মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হবে বছরের পর বছর। এমনও হতে পারে আমরা হয়তো কোনো দিনই দেশে ফিরতে পারব না। আম্মাও আমাদের পড়াশোনার কথা ভেবে বাবার শুভানুধ্যায়ীদের এ রকম প্রস্তাব হালকাভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন।

নভেম্বরের মাঝামাঝি বা শেষ দিকে আব্বা তুরা জেলা সদরে গেলেন। সেখানে সম্ভবত এমএনএ ও এমপিএদের একটি জরুরি মিটিং ছিল। আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ বাংলাদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আব্বা মহেশখলায় ফিরে এসে আম্মাকে বললেন আমাদের এ যুদ্ধ আর খুব বেশি প্রলম্বিত হবে না। খুব তাড়াতাড়ি সম্ভবত আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ রকমটিই সম্ভবত আব্বাকে বলেছিলেন। এ রকম শুভ আশ্বাসের কারণে আমাদেরও আর কলকাতা বা শিলিগুড়ি যেতে হলো না। সত্যি অবশেষে তা-ই ঘটল। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধারাও একের পর এক নিজ আবাসভূমির এলাকা দখলে নিতে সচেষ্ট হন। আমরা ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১ খবর পাই আগের দিন অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর মোহনগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়েছে। পরে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে মুক্ত-স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশে¡র মানচিত্রে জায়গা করে নেয়। এর দুই দিন পরই মহেশখলা থেকে হেঁটে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে আব্বা মোহনগঞ্জ পৌঁছান। এটি ছিল সম্ভবত ডিসেম্বরের ২০/২১ তারিখ। ২২ তারিখ লোহিয়ার মাঠে দালাল ও রাজাকারদের বিচারের জন্য গঠিত গণআদালতে প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন আব্বা। সেখানে সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা গোলাম এরশাদুর রহমান। থানার সামনে আমাদের বাসাটি দেখতে গিয়ে আব্বা দেখলেন বাসার সব দরজা-জানালা আগুন দিয়ে পোড়ানো। বাড়িটি দালানঘর ছিল বিধায় বাড়ির দেয়াল ও ছাদ ভাঙেনি। তবে সব দালানের আস্তর ধোঁয়ার আবরণে কালো হয়ে গেছে। মহেশখলা ফিরে গিয়ে আব্বা আমাদের নিয়ে দেশে ফেরেন সম্ভবত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। আমরা মোহনগঞ্জ ফিরে আমাদের এক ফুপুর বাসায় উঠি। এ ফুপুর এক ছেলে আমাদের সঙ্গে মহেশখলায় ছিলেন। তাঁর আরেক সন্তান দবীর উদ্দীন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পথে নেত্রকোনা শহরে পাক বাহিনী ও এদের দোসরদের হাতে শাহাদাতবরণ করেন। এ বাসায় মাস তিনেক থাকার পর নিজ বাসা মেরামত করে সেখানে ফিরে যাই।

১৪ আগস্ট, ১৯৭১ ছিল আমার প্রথম বিদেশ সফর! বিনা পাসপোর্টে বিনা ভিসায় আমরা সপরিবারে নিজ দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করি শরণার্থী হিসেবে। সীমান্তে কেউ আমাদের যাত্রা বাধাগ্রস্ত করেনি। আজ স্বাধীন দেশে বসে মনে হয় সেদিন বিএসএফ যদি আমাদের ভারতে প্রবেশ করতে না দিত আর যদি দেশ স্বাধীন না হতো তাহলে বেঁচে থাকলে আমাদের পাকিস্তানের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকতে হতো। বাবাকে থাকতে হতো ভারতে রিফিউজি হিসেবে। জানি না সে ক্ষেত্রে বাবার সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হতো কি না। অন্যদিকে যদি দেশ স্বাধীন না হতো, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে যদি ফিরে না আসতেন তাহলে লাখো-কোটি শরণার্থীর মতো আমাদেরও হয়তো ভারতের তৃতীয় শ্রেণির অভিবাসী নাগরিক হিসেবে বসবাস করতে হতো। ভারত সরকারের নাগরিকত্ব আইন আমাদের ওপর কীভাবে প্রয়োগ হতো তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন।

শরণার্থী জীবনের দুঃখ-কষ্ট কী তা একজন শরণার্থী ছাড়া কারও পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হিসেবে প্রবেশ করেছে প্রায় চার বছর আগে। তাদের সংখ্যা জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ১৩ লক্ষাধিক। বাস্তবে হয়তো আরও বেশি। ভাসানচরে যেভাবে শরণার্থীদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ সরকার, ১৯৭১ সালে বাঙালি শরণার্থীরা এ রকম সুযোগ-সুবিধা কল্পনাও করতে পারেননি। চরম কষ্টে কেটেছে তাদের শরণার্থী জীবন। মাত্র ২৪ বছর আগে ভারত স্বাধীন হয়। তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তার পরও মানবিক ছিল ভারত সরকার। তাদের পাশে ছিল বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো। তার পরও শিবিরে শিবিরে অসংখ্য শিশু মারা গেছে পুষ্টিহীনতা ও সংক্রামক ব্যাধিতে। নিজ আবাস-নিবাস ছেড়ে কী দুর্বিষহ ছিল প্রবাসে তাদের শরণার্থী জীবন! ১৯৭১-এর ১৪ আগস্ট লন্ডন টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘Hundreds of children are dzing everyday from malnutirition in the East Pakistan refiugee camps in India’ একই তারিখে সিনেটর কেনেডি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কেনেডি সেদিন বলেছিলেন, শরণার্থী সংকটটি ছিল সে সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ এক ‘হিউম্যান ট্র্যাজেডি’।

বেআইনি কর্ম ও প্রতিকূল বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি করে নিজ আবাসভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য করা আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন এবং অপরাধ। ১ কোটি বাঙালি শরণার্থী এ অপরাধের শিকার। এ বিবেচনায় শরণার্থীরাও বিসর্জন দিয়েছেন তাদের স্বাভাবিক জীবন, জীবিকা, সম্পদ। ধ্বংস হয়েছে তাদের নিবাস ও অধিকার। স্বাধীনতা অর্জনে তাদের এ আত্মত্যাগ স্বীকৃতির দাবি রাখে। অনেক স্মৃৃতি অনেক কথা আমাদের চার মাসের শরণার্থী জীবনের। অল্প কিছু কথায় তা চিত্রিত করা যাবে না। স্বাধীন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের একজন বিচারক হিসেবে ২০১৬ সালের এপ্রিলে ছোট ভাই সাইফুল হাসানসহ শরণার্থী জীবনের স্মৃতিময় স্থান মহেশখলা গিয়েছিলাম। মেঘালয় সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হলো, আমি ও আমার সফরসঙ্গীরা তাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি। তখন আমার মনে এক ভিন্ন অনুভূতি কাজ করে। যে স্থানে সাপ আর চিনে জোঁকের উপদ্রবের মধ্যে ভারত সরকার ও মেঘালয় সরকারের অনুকম্পায় কয়েক মাসের অনিশ্চিত জীবন কেটেছে, আজ সেখানেই আমাকে তারা রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বরণ করছেন। পরম শ্রদ্ধায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাম হৃদয়ে মিশে যায়। কেবলই মনে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও আত্মত্যাগে দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই আজ আমি সেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক হিসেবে পেলাম রাষ্ট্রীয় অতিথির সম্মান সেখানে, যেখানে কেটেছে কয়েক মাসের শরণার্থী জীবন।

৩০ লাখ মানুষের আত্মদান, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আর কোটি মানুষের দেশান্তর তথা শরণার্থী জীবন গ্রহণের মধ্য দিয়ে আজ আমরা স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করছি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমাদের আনন্দের স্মৃতি আমরা যেভাবে ভাগাভাগি করছি সেভাবে শরণার্থী জীবনের ৫০ বছর পূর্তির কথাটিও স¥রণ করছি। পরম শ্রদ্ধায় ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স¥রণ করছি সেই মহীয়সী নারী ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে ও তাঁর সরকারকে। সেদিন যদি ভারত সরকার ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী মাতৃসম ভালোবাসা দিয়ে আমাদের আশ্রয় না দিতেন তাহলে আজকের ইতিহাস হয়তো ভিন্নতর হতো। ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের মৈত্রীর বন্ধন চির-অটুট হোক।

 

লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগ, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর