শিরোনাম
শুক্রবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

ইসলামে শ্রমের মর্যাদা অপরিসীম

এম এ মান্নান

ইসলামে শ্রমের মর্যাদা অপরিসীম

শ্রমের মর্যাদাদানের ক্ষেত্রে ইসলামের অবস্থান অতুলনীয়। মানব জাতির গাইডলাইন আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) সন্ধান করবে।’ সুরা জুমা, আয়াত ১০। ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদের মালিকানা আল্লাহর, মানুষ সে সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক মাত্র। সুতরাং মালিক-শ্রমিক সবাই ভাই ভাই। তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য টানা যাবে না। পারস্পরিক সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা-স্নেহ, বিশ্বস্ততায় ভরপুর। শ্রমিক ও মালিক উভয়ের অধিকার রয়েছে নিজ নিজ প্রাপ্য বুঝে পাওয়ার। উভয়কে বলা হয়েছে নিজ নিজ কর্তব্য পালনে দায়িত্বশীল হতে। শুধু মালিক বা শুধু শ্রমিক নয়; বরং উভয়কে সুসংহত আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে।

শ্রমের শ্রেণিবিন্যাস স্বীকার করা হলেও ইসলামের দৃষ্টিতে মানবিক মূল্যবোধ ও মৌলিক মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবাই সমান। মহানবী (সা.) বলেছেন, শ্রমজীবী আল্লাহর বন্ধু। ইসলাম শ্রমিককে বলেছে, দক্ষ, বিশ্বস্ত ও দায়িত্ববান হতে।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো উত্তম উপার্জন কী? তিনি উত্তর দিলেন নিজের শ্রমের উপার্জন উত্তম উপার্জন। কর্মহীনতাকে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধিক্কার দিয়ে বলেছেন, কর্মহীনতা মানুষকে পাষাণ করে দেয়। যারা শ্রম দেয় তারা হলো শ্রমিক, তাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মজদুরের ঘাম শুকানোর আগেই তাকে তার মজুরি দিয়ে দাও। এ রকমভাবে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মজুরি সঠিকভাবে আদায় না করা কত বড় অপরাধ তা উল্লেখ করতে গিয়ে বললেন, মজদুরকে তার মজুরির ব্যাপারে জুলুম করা অন্যতম কবিরা গুনাহ।

কোরআনে আদর্শ শ্রমিক হিসেবে হজরত মুসা (আ.)-এর বৈশিষ্ট্য এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে পিতা! আপনি তাকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিন। নিশ্চয় আপনার শ্রমিক হিসেবে সে-ই উত্তম যে সামর্থ্যবান ও বিশ্বস্ত।’ সুরা কাসাস, আয়াত ২৬। পরবর্তী আয়াতে নিয়োগদাতা শোয়াইব (আ.)-এর সঙ্গে নিয়োগপ্রাপ্ত মুসা (আ.)-এর মজুরি নির্ধারণের বিবরণ এসেছে। পরে বিরোধ এড়াতে উভয়ের সম্মতিতে প্রথমেই মজুরি নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামী শ্রমনীতির স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে ইসলাম একটি উচ্চ মানসিকতাসম্পন্ন শ্রমনীতির কথা বলেছে, যেখানে শ্রমিকের মানসম্মত জীবন-জীবিকা নিশ্চিত হয়। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং যার ভাইকে তার অধীন করেছেন সে যেন তাকে তা-ই খাওয়ায় যা সে খায়, সেই কাপড় পরিধান করায়, যা সে পরিধান করে। তাকে সামর্থ্যরে অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না। যদি এমনটা করতেই হয় তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে।’ বুখারি।

শ্রমিকের মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মালিকেরই। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মালিকানাধীন (অধীন) ব্যক্তির জন্য খাবার ও কাপড়ের অধিকার রয়েছে।’ মুসলিম।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা বলেন কিয়ামতের ময়দানে আমি তিন ধরনের ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হব- ১. যে ব্যক্তি আমার নামে কথা দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করল ২. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য আত্মসাৎ করল ৩. যে ব্যক্তি কোনো মজদুরকে শ্রমিক নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পূর্ণ কাজ বুঝে নিল কিন্তু তাকে তার মজুরি দিল না।’ এটা হলো শ্রমিকের অধিকার আদায় সম্পর্কিত হাদিস। তবে কোনো শ্রমিক যদি মালিকের কাজ করতে গিয়ে মালিকের কোনো কিছু নষ্ট করে ফেলে তখন মালিক কী করবেন এ ব্যাপারে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘চাকর-বাকর তোমাদের কাজ করতে গিয়ে কোনো পাত্র ভেঙে ফেললে তার জন্য তাকে শাস্তি দেবে না, কারণ অন্য মানুষের মতো তাদেরও তো হঠাৎ অনিচ্ছায় কোনো কিছু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ বেতন ও পারিশ্রমিক কর্মজীবীর অধিকার। ইসলাম দ্রুততম সময়ে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ ইবনে মাজাহ।

অন্য হাদিসে পারিশ্রমিক ও প্রাপ্য অধিকার নিয়ে টালবাহানাকে অবিচার আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘ধনী ব্যক্তির টালবাহানা অবিচার।’ বুখারি।

শ্রমিক ও মালিক পরস্পরকে ভাই সম্বোধন করে মূলত ইসলাম শ্রেণিবৈষম্যের বিলোপ করেছে। তবে শ্রেণিবৈষম্য বিলোপের নামে মালিক ও উদ্যোক্তার মেধা, শ্রম ও সামাজিক মর্যাদা অস্বীকার করেনি ইসলাম। চাপিয়ে দেয়নি নিপীড়নমূলক কোনো ব্যবস্থা। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহতায়ালা জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকে কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে তারা তাদের অধীন দাস-দাসীদের নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে এমন কিছু দেয় না যাতে তারা তাদের সমান হয়ে যায়। তবে কি তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে?’ সুরা নাহল, আয়াত ৭১।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার তৌফিক দান করুন।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর