মঙ্গলবার, ৪ মে, ২০২১ ০০:০০ টা
শিক্ষাঙ্গন

দুই ব্যতিক্রমী উপাচার্য

বিমল সরকার

দুই ব্যতিক্রমী উপাচার্য

অত্যন্ত সাধনার ধন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে গোটা বাঙালি জাতির গৌরব-গরিমা ও আশা-আকাক্সক্ষার যেমন শেষ নেই, তেমন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ঘিরে সচেতন ব্যক্তিদের রয়েছে নানা কৌতূহলও। শতবর্ষের গৌরবে গরীয়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর দুই মাস পর ১ জুলাই, ২০২১ উদযাপন করা হবে গৌরবের শতবর্ষপূর্তি উৎসব। আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ১৬৪।

প্রধানত পূর্ববঙ্গের বঞ্চিত-অবহেলিত ও অনগ্রসর মুসলমানদের স্বার্থ-সুবিধার কথা বিবেচনা করেই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। জ্ঞান বিতরণ-চর্চা ও সৃষ্টি-গবেষণা যার মূল লক্ষ্য। প্রতিষ্ঠার ২৭ বছর পর (১৯২১-১৯৪৭) উপমহাদেশ বিভক্তি ও মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির সময় দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের অনুপাত ৮০:২০। শুরুর দিকে তাদের শিক্ষা ও সামাজিক পরিস্থিতির আনুপাতিক হার ছিল আরও ভয়াবহ।বিষয়টিকে একদিক থেকে কাকতালীয়ও বলা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় মানে উদার-উন্মুক্ত জায়গা।

যেখানে থাকবে না সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কোনো প্রশ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯২১ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় আরও অন্তত ৬৪ বছর আগে, ১৮৫৭ সালে। ব্রিটিশ ভারতে ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গ প্রধানত মুসলিম অধ্যুষিত আর কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠার অন্তত ৩৪ বছর পর্যন্ত (১৮৫৭-১৮৯০) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালনকারী সব কজন উপাচার্যই ছিলেন বিদেশি, ইংরেজ। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে শুরুর ১৪ বছরে (১৯২১-১৯৩৪) মাত্র দুজন বিদেশি উপাচার্য ছিলেন। এর পরই শুরু হয় দেশীয়দের মধ্য থেকে উপাচার্য নিয়োগ।

ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগপৎ ঘটনাটি ঘটে ত্রিশের দশকের শেষ আর চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধে। ওই সময়টিই ছিল ইংরেজ শাসককুল, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু নেতৃবৃন্দ এবং মুসলমানদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে ১৯৩৫ সালের ভারতশাসন আইন অনুযায়ী প্রদেশসমূহে নির্বাচন ও দায়িত্বশীল সরকার গঠনের জন্য রাজনীতিকদের মধ্যে ব্যাপক তোড়জোড়, অন্যদিকে মুসলিম নেতারা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের জন্য একেবারে মরিয়া। এ ছাড়া ইংরেজদের বিতাড়ন করে স্বাধীনতা লাভের ব্যাপারটি তো রয়েছেই। ঠিক এমনই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার প্রায় একই সময়ে উপমহাদেশের দুটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ভেবেচিন্তে দুজন উপাচার্য নিয়োগ দেন। এ নিয়োগের বিশেষত্ব হলো যে তাঁরা উভয়েই ছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। আলোচিত দুজন উপাচার্য হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আজিজুল হক। রমেশচন্দ্র মজুমদার সাড়ে পাঁচ বছর (১ জানুয়ারি ১৯৩৭-৩০ জুন ১৯৪২) এবং আজিজুল হক প্রায় চার বছর (৮ আগস্ট ১৯৩৮-১২ মার্চ ১৯৪২) যথাক্রমে ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচন ও বাংলা প্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে দায়িত্বশীল (নামে হলেও) সরকার গঠন, ১৯৪০ সালের লাহোর তথা পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণ, নানা আঙ্গিকের আন্দোলন, ইংরেজদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা, উপমহাদেশ বিভক্তি ও স্বাধীনতা প্রদান এবং ইংরেজদের চিরবিদায় এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের পটভূমি তৈরি হয়েছিল ওই সময়টিতে।শিক্ষাজগতে অবিভক্ত বাংলার দুই মহিরুহ ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। দুটি প্রতিষ্ঠানের দুই প্রধান নির্বাহী (উপাচার্য) হিসেবে যথাক্রমে রমেশচন্দ্র মজুমদার ও আজিজুল হক যখন নিয়োগ পান তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক আর গভর্নর স্যার জন আর্থার হারবার্ট। দ্য মারকুইস অব লিনলিথগো ছিলেন ভাইসরয়। ঢাকা ও কলকাতা উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই সময়টি খুব স্মরণীয় ও গৌরবমন্ডিত।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত ও স্বাধীন হয়। স্বাভাবিক হিসাব অনুযায়ীই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানে আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের অধীনে থাকে। যা স্মর্তব্য ও লক্ষণীয় তা হলো রমেশচন্দ্র মজুমদারের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত আরও ২৪ জন উপাচার্য দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সংখ্যালঘু (হিন্দু) সম্প্রদায়ের আর কাউকেই পদটিতে নিযুক্ত করা হয়নি। একইভাবে আজিজুল হকের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একে একে আরও ১৯ জন ব্যক্তি উপাচার্যের পদটি অলঙ্কৃত করেন। কিন্তু সংখ্যালঘু (মুসলিম) আর কাউকেই এখানেও নিযুক্ত করা হয়নি। অথচ একে সাম্প্রদায়িক বলা যাবে না; বলতে হবে ‘বিশ্ববিদ্যালয় মানে উদার, উন্মুক্ত জায়গা!’

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক।

সর্বশেষ খবর