বুধবার, ৫ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

মাতৃস্বাস্থ্য-মিডওয়াইফ ও প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা

অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম

মাতৃস্বাস্থ্য-মিডওয়াইফ ও প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩২ লাখ মা গর্ভবতী হন। তার মধ্যে প্রায় ২৩ লাখ নরমাল ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি হয় এবং ৯ লাখ ৫২ হাজার ১০৬টি সিজারিয়ান অপারেশন হয়। এ ডেলিভারির প্রায় ৫০% এখনো বাড়িতেই হয় কোনো দক্ষ/অদক্ষ ধাত্রী অথবা মুরব্বির হাতে। বাকি ৫০%-এর মধ্যে ৩২% সরকারি হাসপাতাল, ১৪% বেসরকারি ক্লিনিক এবং ৪% বিভিন্ন এনজিও ক্লিনিকে।

প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি করানোর জন্য আমরা বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করলেও গর্ভবতী মা একটি মাতৃবান্ধব জায়গা খুঁজে পান না। বাংলাদেশে সরকারি স্বাস্থ্যকাঠামো পৃথিবীর মধ্যে একটি উন্নত কাঠামো কিন্তু সে কাঠামোয় লোকবল, অন্যান্য ব্যবস্থা কখনই গর্ভবতী মায়েদের জন্য সুখকর হয় না, আস্থায় নিতে পারেন না। সেজন্য শুধু গর্ভবতী মায়েদের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালে মিডওয়াইফ ব্যবস্থা চালু করার পরামর্শ দেন। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তিন বছরের এ ডিপ্লোমা কোর্সটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিভিন্ন কোর্স কারিকুলামের সঙ্গে সংগতি রেখে করা হয়।

২০১৩ সালের কোর্সটি চালু হয়ে ২০১৫-এর ডিসেম্বরে প্রথম ব্যাচ বের হয়। গোলাপি পোশাকে গোলাপ ফুলের মতো এরা প্রস্ফুটিত হয়ে গেল, এ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার ১৬ জন মিডওয়াইফ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে পদায়ন হয়েছে ১ হাজার ১৪৯ জন। এবার পিএসসি লিখিত দিয়ে বসে আছে ১ হাজার ৮৪৭ জন।

৫ হাজার পদ সৃষ্টি হলেও নানা জটিলতায় পদায়ন হচ্ছে না। কিন্তু এরাই এখন গর্ভবতী মায়েদের জন্য বিশেষ একটি শক্তি। করোনাকালে বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় এ মিডওয়াইফদের বিভিন্ন জায়গায় পদায়ন করা হয়েছিল। তারা কী অসম্ভব রকমের সার্ভিস দিয়েছে যা কল্পনারও বাইরে। তারা নির্ভয়ে সেই ক্রান্তিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী, মুগদা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন জায়গায় দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে গেছে। তাদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব অসম্ভব নিপুণতার সঙ্গে গর্ভবতী মায়েদের সেবা ও নরমাল ডেলিভারি করেছে। তাদের পুরো কোর্সটিই ইংরেজিতে পড়ানো হয়। সেজন্য আন্তর্জাতিক যে কোনো সভা-সমিতিতে তারা বক্তব্য দিতে শক্ত ভূমিকা রেখেছে।

প্রসূতিঘরটি (লেবার রুম) প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের একটি প্রাণকেন্দ্র। আমরা প্রস্তাব করেছি এ লেবার রুমটির ইনচার্জ হবে মিডওয়াইফ। তারাই পুরোটা সময় মাকে সহায়তা দেবে এবং বিশেষভাবে পারদর্শী হবে স্বাভাবিক প্রসবের জন্য এবং মাতৃমৃত্যুর প্রধান যে দুটি কারণ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি (অ্যাকলামশিয়া) তার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণেও হবে অভিজ্ঞ। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রতিটি লেবার রুমে ফ্রিজ দিয়েছে যেখানে রক্তক্ষরণে ব্যবহৃত ওষুধটি সঠিক তাপমাত্রায় রাখা যাবে এবং প্রতিটি লেবার রুমে দুটি কিট বা বাক্স দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে সব রকমের ওষুধ থাকবে মাতৃমৃত্যু রোধের জন্য।

বর্তমানে প্রতি লাখে ১৭২ জন মা মারা যাচ্ছেন (বিডিএইচএস), ২০৩০-এর মধ্যে এ সংখ্যা ৭০-এ নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করা হয়েছে। মিডওয়াইফারি সহায়তা দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে এটি বাস্তবায়ন কোনো অসাধ্য ব্যাপার নয়।

স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে ওজিএসবি (অবসট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনি সোসাইটি অব বাংলাদেশ) প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংস্থা একযোগে মিডওয়াইফদের সহায়ক হয়ে কাজ করছে এবং স্বাভাবিক প্রসবসহ সব ধরনের জটিলতা মোকাবিলায় তাদের ভূমিকা দৃঢ় করার জন্য এগিয়ে এসেছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে করোনা মোকাবিলায় তাঁর দূরদৃষ্টির প্রমাণ রেখেছেন দ্রুত ভ্যাকসিন এনে এবং মিডওয়াইফ তৈরির এ যুগান্তকারী চিন্তার ও সিদ্ধান্তে মাতৃস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে একটি মাইলফলক দেখিয়েছেন।

গোলাপি পোশাকের গোলাপের সৌরভ ছড়িয়ে যাক। মাতৃসেবা, স্বভাবিক প্রসব এবং মাতৃমৃত্যু শূন্যের কোঠায় নেমে আসুক।

লেখক : প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, সাবেক সভাপতি, ওজিএসবি।

সর্বশেষ খবর