শনিবার, ৮ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

বাঙ্গি ও তরমুজ এখন টক অব দ্য টাউন

শাইখ সিরাজ

বাঙ্গি ও তরমুজ এখন টক অব দ্য টাউন

কদিন আগে দেখলাম এ দেশের নেটিজেনরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছেন। একদল বাঙ্গির পক্ষে আরেকদল বিপক্ষে। ঠিক এ রকম পরিস্থিতিতে বন্ধু সাগর (ফরিদুর রেজা সাগর) আমার কাছে একটি ভিডিও পাঠালেন, ‘শাইখ, ভিডিওটা দেখ, দেখলে তুমি খুশি হবে!’ মালয়েশিয়ার মতো গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে গ্রিনহাউসে জাপানি বাঙ্গি (মাস্কমেলন) চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন একদল কৃষি উদ্যোক্তা। এ নিয়ে ভিডিও প্রতিবেদন। প্রতিবেদনের মজার অংশটা হচ্ছে, মাস্কমেলনের উৎপাদন বাড়াতে এবং আকার বড় করতে উদ্যোক্তারা গাছকে প্রতিদিন নিয়ম করে গান শোনান আর প্রতিটি মাস্কমেলনকে নরম কাপড় দিয়ে ম্যাসাজ করে দেন। তারা বলছেন এতেই মালয়েশিয়ার মতো আবহাওয়ায়ও জাপানিজ মাস্কমেলনের ফলন ভালো হয়েছে। সাগরকে জানালাম, আমাদের দেশেও গ্রিনহাউসে মাস্কমেলনের চাষ শুরু হয়েছে বেশ আগেই। বছর পাঁচেক আগে প্যারামাউন্ট গ্রুপের গ্রিনহাউসে মাস্কমেলন চাষ নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম। গাছকে গান শুনিয়ে এবং ফল ম্যাসাজ করে আকার বাড়ানোর এ কৌশলটা আমাদের এখানে এখনো চালু না হলেও অনেক কৃষি উদ্যোক্তাকে বলতে শুনেছি গাছের সঙ্গে কথা বলায় ফলন বেশি পাচ্ছেন। যাই হোক, বলছিলাম আমাদের দেশের মাস্কমেলন বা বাঙ্গির কথা। বাঙ্গি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যত ট্রল আর হাসিতামাশাই হোক না কেন দেশে বাঙ্গির বাজার ক্রমে বড় হচ্ছে। বাঙ্গির নতুন নতুন জাতের আগমন ঘটছে। আপনাদের নিশ্চয়ই অজানা নয় বাঙ্গি একটি স্বাস্থ্যকর ফল। পাকা বাঙ্গির সুঘ্রাণ লুকানো খুব কঠিন। কাঁচা বাঙ্গি সবজি হিসেবে রান্না করে খাওয়া যায়। পুষ্টিবিদরা জানিয়েছেন বাঙ্গিতে আমিষ, ফ্যাটি অ্যাসিড ও খনিজ লবণ আছে। আছে ওষুধিগুণ: মূত্রস্বল্পতা ও ক্ষুধামান্দ্য দূর করতে পারে। বাঙ্গিকে কেউ বলে বানি। কেউবা বলে ফুটি, খরমুজ বা কাঁকুড়। যে নামেই ডাকা হোক, দেশের প্রায় সব এলাকায় গ্রীষ্মকালে বাঙ্গি জন্মে। এমনিতে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার টামটাসহ বিভিন্ন গ্রামে বাঙ্গি চাষের জন্য বেশ সুপরিচিত। সে অঞ্চলে গিয়ে দেখেছি মাঠের পর মাঠজুড়ে বাঙ্গির চাষ। জানা যায় ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে সে অঞ্চলে বাঙ্গি চাষ হচ্ছে বংশপরম্পরায়। খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি বাঙ্গি চাষ করে এবার ভালোই লাভ পেয়েছেন ওই অঞ্চলের কৃষক।

শুধু বাঙ্গি চাষিরা নন, তরমুজ চাষিরাও এবার ভালো লাভ পেয়েছেন। রমজানের কারণে এবার মৌসুমেও তরমুজের বেশ চাহিদা। তবে এ চাহিদা পুঁজি করে ক্রেতাদের পকেট কাটছেন একদল মধ্যস্বত্বভোগী। কৃষকের খেত থেকে ৩০-৪০ টাকা পিস তরমুজ কিনে এনে বিক্রি করছে ৫০-৬০ টাকা কেজি দরে। বাজারে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন অনেকে। বরিশাল, মাদারীপুরসহ কয়েকটি জেলায় রীতিমতো মোবাইল কোর্ট বসিয়ে কেজি দরে তরমুজ বিক্রি থামানোর চেষ্টা চলছে। একদিকে প্রচ- গরম আরেকদিকে রমজান, দুই মিলে তরমুজের প্রচুর চাহিদা। কিন্তু ক্রেতা যত বেশি দামেই কিনুন না কেন কৃষক কিন্তু তরমুজপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ টাকাই পাচ্ছেন। ৩০ টাকার তরমুজ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে ৬০০ টাকায়। কৃষক লাভের ছিটেফোঁটা পাচ্ছেন। বাকিটা বেহাত। দেখেছি তরমুজের আকারে পরিবারের আকারও প্রভাব ফেলেছে। একসময় বিশাল তরমুজ কেটে যৌথ পরিবারের সবাই মিলে খেত। কিন্তু ক্রমেই যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবারে পরিণত হয়েছে। এখন একক পরিবারের কথা চিন্তা করে তরমুজের আকারও ছোট করা হয়েছে। জাপানিরা আরও একধাপ এগিয়ে। তরমুজ পরিবহনে সুবিধা করতে তরমুজের আকারই পাল্টে দিয়েছে। গোল তরমুজকে কৌশলে করেছে বর্গাকার। যাই হোক, আমাদের দেশের কৃষক মৌসুমের চেয়ে অমৌসুমের তরমুজ চাষেই আগ্রহী। মনে পড়ছে গত নভেম্বরে হবিগঞ্জের মাধবপুর গিয়েছিলাম অমৌসুমে তরমুজ চাষের ওপর প্রতিবেদন তৈরির কাজে। হরিণখোলা গ্রামে যত দূর চোখ যায় দেখা যায়, তরমুজের বস্তা নিয়ে কৃষিশ্রমিকদের বিরামহীন স্রোতধারা। একদল কৃষিশ্রমিক ছুটছে সামনের দিকে। কে আগে যাবে, কে আগে ফসল নামিয়ে ফিরে যাবে আবাদি খেতে চলছে এ প্রতিযোগিতা। কাদামাখা ধানের আইল ধরে এমন প্রতিযোগিতায় কারও যেন একটুও ক্লান্তি নেই। প্রায় ১ কিলোমিটার আইলের পথ পাড়ি দিয়েই তারা তুলে আনছে ফসল। রাস্তার কাছে এনে ছোট ট্রাকের ওপর জড়ো করা হচ্ছে তরমুজ। গত কয়েক বছরে সেখানকার কৃষি বৈচিত্র্যে নতুন এ সংযোজন। বছরের আট মাস সুইট ব্ল্যাক, জেসমিন নামের মিষ্টি তরমুজ চাষ করে লাভবান হচ্ছে কৃষক। মাঠে গিয়ে কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, হরিণখোলার মাটিতে অমৌসুমি তরমুজ উৎপাদনের এমন সম্ভাবনা জাগিয়েছেন স্থানীয় কৃষক সংগঠক আবদুল বাছির বদু মিঞা। বিস্তৃত সবুজ খেত। থরে থরে তরমুজ ধরে আছে। বেডের মাঝে ফাঁকা রেখে আবার বেড। মালচিং পদ্ধতিতে ফলানো হয়েছে সুমিষ্ট তরমুজ। খেতের এক পাশে কেউ কেউ তরমুজ তুলতে ব্যস্ত। যেন ভরা মৌসুমে ফসল তোলার তাড়া। মাঠ থেকেই তরমুজ বিক্রি হয়ে যায়। হরিণখোলার তরমুজ চলে যায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। বছরের আট মাসব্যাপী উৎপাদিত এ ফসলে বেশ ভালো লাভবান হচ্ছেন বলে জানালেন কৃষক। খেত থেকে ফসল উৎপাদন করতে অবশ্যই বেশ কৌশল অবলম্বন করতে হয়, বলছিলেন কৃষক বদু মিঞা। না বুঝে লগ্নি করলে অনেক সময় ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ফসল আবাদে নামেন তিনি। অন্যদেরও পরামর্শ দেন। মাঠের প্রায় সব তরমুজ চাষিই বললেন, তাদের অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করেছেন বদু মিঞা। হরিণখোলার মুহাম্মদ ফয়েজ একজন বড় তরমুজ চাষি। ২০ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করে কাক্সিক্ষত লাভ পেয়েছেন তিনি। তিনি বললেন, দারুণ সুস্বাদু ও রসালো অমৌসুমি সুমিষ্ট তরমুজের আবাদ দিনে দিনে বাড়ছে ওই এলাকায়। কৃষক ফয়েজ এলাকায় পরিচিতি পেয়ে গেছেন তরমুজ ফয়েজ হিসেবে। আগামীতে আরও ১০০ বিঘা জমিতে তরমুজ আবাদের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন আরেক কৃষক মিল্লাদ হোসেন। তিনি জানালেন, ৮ বিঘায় তরমুজ আবাদে ভালো লাভ এসেছে তার। প্রথমবারের মতো সাড়ে ৩ লাখ টাকা লাভ ঘরে তুলে আগামীতে আরও ৩ বিঘা তরমুজ আবাদি এলাকা বাড়ানোর চিন্তা রয়েছে বলে জানালেন আরেক কৃষক সাজ্জাদ হোসেন রুবেল। ফয়েজ, মিল্লাদ, রুবেলের মতো বহু কৃষকের জীবন পাল্টে দিয়েছে তরমুজ। কৃষক ধনুমিঞা তাদেরই একজন। তার হিসাবে কমপক্ষে ২০০ মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেছে এ তরমুজ আবাদে। ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে চিনি কৃষক আবদুল বাছির বদু মিঞাকে। অত্যন্ত সহজসরল কৃষি-অন্তঃপ্রাণ এক মানুষ তিনি। বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন রঙের অমৌসুমি তরমুজের আবাদ করছেন। তরমুজের মতো উচ্চমূল্যের ফলফসল আবাদে তার যেমন ঝোঁক রয়েছে, একইভাবে রয়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের আগ্রহ। তিনি পণ্যের সঠিক বাজারজাত করার ব্যাপারেও যথেষ্ট সচেতন। তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি প্রতিদিন নতুন যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তা যথাসম্ভব দ্রুত পৌঁছে দেন অন্য কৃষকের মাঝে। নতুন নতুন ফল ফসল ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে গোটা এলাকাকে জাগিয়ে তোলাই তার মূল লক্ষ্য। আজকের দিনে বদু মিঞার মতো কৃষকই মাঠ পর্যায়ে অন্যতম সম্প্রসারকের ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তাদের মাধ্যমেই চোখ খুলে যাচ্ছে স্বপ্নবান কৃষকের, নতুন উদ্যোক্তার। ২০১৭ সালে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গিয়ে দেখেছি বিঘার পর বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ হচ্ছে। তরমুজ চাষ করে কৃষক খুশিই ছিলেন। তবে পটুয়াখালীর বিভিন্ন জায়গার কৃষক তরমুজ চাষ করে খুব একটা খুশি হতে পারেননি। তাদের অভিযোগ ছিল দ্বীপাঞ্চল থেকে তরমুজ পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় অনেক তরমুজ খেতেই নষ্ট হয়।

লেখাটি শেষ করার আগে তরমুজ চাষে আমাদের সাফল্যের একটি খবর স্মরণ করতে চাই। গত বছর দেশে প্রথমবারের মতো তরমুজের বীজ উৎপাদনের মাধ্যমে এর সফল ফলনের দাবি করেছিলেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান পটুয়াখালীর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা। লাল রঙের পাশাপাশি হলুদ রঙের তরমুজ উৎপাদন করেও সাফল্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা। আমাদের দেশে তরমুজের নিজস্ব কোনো বীজ না থাকায় চীন, জাপান, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে প্রতি বছর ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বীজ আমদানি করতে হয়। দেশে তরমুজের বীজ উৎপাদন করা গেলে এ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া সারা বছর তরমুজ চাষের উপযোগী। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ তরমুজ পছন্দ করেন। তরমুজের বড় একটি বাজার আমাদের দেশে রয়েছে। উদ্যোগ নিলে আন্তর্জাতিক বাজারেও আমাদের একটা অবস্থান তৈরি করে নেওয়া খুব একটা কঠিন কিছু নয়। তরমুজ কিংবা বাঙ্গি চাষ হতে পারে আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি গড়ার অন্যতম অনুষঙ্গ।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর