বুধবার, ১২ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ঈদ মুবারক

আফতাব চৌধুরী

ঈদ মুবারক

দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আবার পবিত্র ঈদুল ফিতর এসেছে। ঈদুল ফিতর এসেছে পবিত্র আনন্দের বার্তা নিয়ে। এসেছে ধনী-দরিদ্র, আপন-পর, নিকট-দূর প্রভৃতি সব ধরনের ব্যবধান ঘুচিয়ে মানুষকে একই সমতলে স্থাপনের শাশ্বত তাগিদ নিয়ে। এসেছে মানুষে মানুষে সাদা-কালো, উঁচু-নিচু, তথাকথিত আশরাফ-আতরাফ ব্যবধানের অবাস্তবতার চিরন্তন দেয়ালের লিখনের প্রতি আঙ্গুলিনির্দেশ করে। মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধানের যে প্রাচীর অন্য অনেক প্রকার সামাজিক ব্যবধানের জন্ম দেয়, যে ব্যবধান ঘোচানোর, নিদেন পক্ষে সহনীয় পর্যায়ে আনয়নের উপায় নির্দেশ করা ঈদুল ফিতরের অন্যতম আর্থসামাজিক লক্ষ্য। ইসলাম স্রেফ আচারসর্বস্ব কোনো ধর্ম নয়, তার কোনো আচার-অনুষ্ঠান কোনো অবস্থাতেই সমাজনিরপেক্ষ নয়। মানবতার কল্যাণ, সামাজিক কল্যাণ, মানুষের নৈতিক কল্যাণ, আর্থিক কল্যাণ, মোদ্দা কথায় সামগ্রিকভাবে সামাজিক কল্যাণ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেওয়া হয়েছে। মানবতার কল্যাণই যে ইসলামের সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় লক্ষ্য তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর যে আনন্দ উৎসবের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তাতে কোনো প্রকার উচ্ছৃঙ্খলার অবকাশ রাখা হয়নি। আনন্দের নামে নৈতিকতা ও শালীনতা বহিভর্‚ত কোনো কাজের অনুমোদন দেওয়া দূরে থাক, ন্যূনতম নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের সুযোগ এখানে নেই। নির্ধারিত আনন্দ চারপাশের সবার মাঝে ভাগ করে দিয়ে উৎসবকে সর্বজনীন করে দেওয়ার ব্যাপারটাকে কেবল নৈতিক পর্যায়ে সীমিত না রেখে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। যেমন ঈদের আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে জাকাত, ফিতরাসহ বিভিন্ন ধরনের সাদাকাহ ও পরোপকারমূলক দান সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। এসব বিধিবিধান কেবল শুভ ইচ্ছা কিংবা নীতিকথার স্তরে আবদ্ধ নয়, সমাজের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপকে এর সঙ্গে যোগ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে অর্থসম্পদ কেন্দ্রীভবনের অবকাশ রুদ্ধ করা হয়েছে। মহানবী (সা.) তাঁর সুদূরপ্রসারী মিশনের সুচনালগ্ন থেকেই ধনবৈষম্য অর্থাৎ বিত্তের ব্যবধান ঘুচিয়ে আনার বিষয়কে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘সব অনাচারের মূলে দারিদ্র্য। ব্যভিচার দারিদ্র্যকে অনুসরণ করে।’ সমাজে অন্যান্য বৈষম্য এবং অনাচার-অবিচার গড়ে ওঠে ধন ও ধনবৈষম্যের ওপর ভিত্তি করেই। তাই জাকাত, উত্তরাধিকার আইন, সম্পদের ওপর সম্পদের উৎপাদনকারীদের অধিকার, সব ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর রাষ্ট্র তথা জনগণের অধিকার। জমির ওপর কেবল চাষির অধিকার প্রভৃতি বিধান বিধিবদ্ধ করে সম্পদের ব্যাপক বণ্টন ও গতিশীলতা নিশ্চয়তা বিধান করেছে; যাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে এক স্থানে অলস পড়ে না থাকে। কারণ এতে সম্পদের সীমাবদ্ধতাহেতু একদিকে যেমন অনেকের বঞ্চনার পথ রুদ্ধ হয় তেমন সম্পদ স্থবির হয়ে পড়ে থেকে উৎপাদনশীলতার পথে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় সে বাধাও অপসৃত হয়। সুরা হাশরে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের ধনসম্পদ এমনভাবে বিন্যস্ত কোর না যাতে তা কেবল বিত্তশালীদের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে।’ আল কোরআনের এ নির্দেশকে ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন, রাষ্ট্রজীবন তথা বিশ্বপরিসরে প্রয়োগ করাই ছিল তাঁর অন্যতম মিশন।

ঈদে আমাদের কামনা বিশ্ব থেকে সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য-ভেদাভেদের অবসান ঘটুক। মানবসমাজের প্রত্যেক সদস্যের মুখে হাসি ফুটুক। শান্তি বিরাজ করুক সবার ঘরে, সবার হৃদয়ে। নিরাপত্তা বিরাজ করুক সবার জীবনে। ঈদে আমরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করি। প্রত্যেক মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয় মিলিয়ে একে অন্যের আপন হয়ে উঠুক, দেশ থেকে সব ধরনের শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসান ঘটুক। এটাই আমাদের একান্ত কামনা।

লেখক : গবেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর