শুক্রবার, ২১ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

কুলপোতাক- অসাম্প্রদায়িক বাংলার প্রতিচ্ছবি

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

কুলপোতাক- অসাম্প্রদায়িক বাংলার প্রতিচ্ছবি

শৈশবের স্মৃতির চিরকুটগুলোর কোনো কোনোটি এখনো মানসপটে উজ্জ্বল। সেদিনের একটি ভ্রমণস্মৃতি এখনো মনের মাঝে ঘুরে ফেরে। বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম একটি গ্রামে। আমাদের গ্রামের বাড়ি হাটনাইয়া (ছয়াশী)-এর বেশ কাছেই গ্রামটি। মনে আছে, তখন সেখানে অস্ট্রেলিয়ার কিছু নাগরিক বাস করতেন। সবুজ বনানীতে ঘেরা শান্ত ছবির মতো একটি গ্রাম। সেখানে গড়ে উঠেছে অস্ট্রেলিয়ান মিশন। অস্ট্রেলিয়ানরা মিশনটির তদারকি করতেন বলেই বোধ হয় সবাই এটিকে ‘অস্ট্রেলিয়ান মিশন’ বলত। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কল্যাণমূলক নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৫৮ সালে স্থাপিত হয়েছিল এ মিশন। গ্রামটির নাম কুলপোতাক। গ্রামের লোকেরা অস্ট্রেলিয়ান সাহেবদের বাড়িটিকে ‘মিশনবাড়ি’ বলে ডাকত। কুলপোতাক নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার সোয়াইর ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি ছোট্ট গ্রাম।

অল্প কথায় সেই ছোট্ট গ্রামের গল্পই বলছি। শৈশবে বাবার সঙ্গে ওই মিশনবাড়িতে গিয়েছি সম্ভবত দুবার। বেশ ছোট ছিলাম তখন। তার পরও সেদিনের কথা স্মৃতিতে রয়েছে। একটু একটু মনে আছে। সম্ভবত ১৯৬৬-৬৭ সালের কথা। আমি তখন সাত-আট বছরের শিশু। আমাকে একজন মেমসাহেব সুন্দর পাথরের পেয়ালায় উষ্ণ গরম দুধ পান করতে দিয়েছিলেন। দেয়ালের ওপর টালির তৈরি চৌচালা বাংলো ঘরে তাঁরা থাকতেন। দরজা -জানালা নেট দিয়ে পরিবেষ্টিত। মনে পড়ে ওই বাড়িতে একটি যান্ত্রিক পাখা ছিল। সেটি চলত কেরোসিনের সাহায্যে। পাখাটির কথা আমার মনে আছে। আর তেমন কিছু মনে নেই। তবে এখন শুনি সাহেবরা কেরোসিন দিয়ে কেমন করে ওভেন চালাতেন এবং সকালের নাশতার জন্য সেই ওভেনে কীভাবে পাউরুটি বানাতেন। ঘরে বৈদ্যুতিক বাতিও জ্বালাতেন কেরোসিনের সাহায্যেই। এ মিশনটি ছিল ব্যাপটিস্টদের একটি মিশন। এটি গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জেলার মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী গ্রামে। কুলপোতাক গ্রাম থেকে ৪-৫ মাইল দূরে। সম্ভবত ১৯৩০-৩১ সালের দিকে। গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন রেভারেন্ড এফডি আইসন্স (Reverend FD Isons), মিস জোনস (Miss. Jons), রোনাল্ড চেস্টারটন পটার (Ronald Chesterton Potter), সিরিল জেমস মুর (Cyril James Moore) ও এডনা (Edna)। মি. সিরিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে স্থানীয়ভাবে জনশ্রুতি আছে। এ বিদেশিরা ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে ময়মনসিংহ যেতেন এবং সেখান থেকে অন্য ট্রেনে করে মোহনগঞ্জ যেতেন। মোহনগঞ্জ থেকে স্পিডবোটে করে যেতেন গোবিন্দশ্রী গ্রামে, তাঁদের মিশনে। জেনেছি, ১৯৪৪ সালের ২৯ জুলাই ঘটে যায় এক মর্মন্তুদ ঘটনা। সেদিন আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল। মিশনের প্রতিষ্ঠাতাদের তিনজনই মোহনগঞ্জ থেকে স্পিডবোটযোগে যাচ্ছিলেন গোবিন্দশ্রী গ্রামে। যাওয়ার পথে মেন্দীপুর এবং গোবিন্দশ্রী গ্রামের মাঝখানে অবস্থিত একটি হাওরে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় তাদের স্পিডবোট উল্টে যায়। সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে মিশন প্রতিষ্ঠাতাদের তিনজন মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয় লোকজন তাঁদের উদ্ধার করে মিশনে নিয়ে যায়। সেখানেই তাদের কবরস্থ করা হয়েছিল। সিরিল জেমস মুর ও এডনা একে অন্যের বাগদত্তা ছিলেন। মিশনে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। গ্রামের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকসহ অনেকেই হয়তো সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা এমনই যে গ্রামের লোকেরা তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানের বদলে ভগ্নহৃদয়ে তাদের এ দুজনকে একই কবরে কবরস্থ করেন। ধর্মবর্ণ নির্বশেষে গ্রামবাসীর জন্য এটি ছিল চরম বিষাদের।

মিশনের প্রতিষ্ঠাতাদের এ তিনজনের আকস্মিক তিরোধানের পর অস্ট্রেলিয়া থেকে আরও লোকজন আসেন মিশনের দায়িত্ব নিতে। তাঁরা তখন ভাটি এলাকার পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত উজান এলাকায় অর্থাৎ উঁচু এলাকায় মিশনটি স্থানান্তরিত করার চিন্তা করেন। তাঁদের এ চিন্তা থেকে তাঁরা বর্তমান কুলপোতাক গ্রামে মিশনটি স্থানান্তর করেন ১৯৫৮ সালের দিকে। এ ক্ষেত্রেও রেভারেন্ড এফডি আইসন্স ও মিস জোনসের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। এখানেও স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। ধরণীকান্ত দাস একজন সংগ্রামী মানুষ, তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন ১৯৩৪ সালের দিকে। তিনি তাঁর নাম পরিবর্তন করেননি। তাঁর ছেলে মি. প্যানোয়েল দাস (Mr. Panoel Das) বর্তমানে কুলপোতাক গ্রামে বসবাস করছেন। তাঁর ছেলে জেমসন দাস ঢাকায় বসবাস করেন। জেমসনের দাদা ইন্টারমিডিয়েট পাস ছিলেন বলে জেমসন জানান। ধরণীকান্ত দাস গোবিন্দশ্রীর অধিবাসী ছিলেন। ১৯৫৮ সালে কুলপোতাক গ্রামে মিশন স্থানান্তরিত হওয়ার সময় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সবাই এ গ্রামেই চলে আসেন। সে সময় তাঁরা চেস্টারটন পটার, সিরিল জেমস মুর ও এডনার কবর দুটিও এ কুলপোতাক গ্রামে স্থানান্তরিত করেন।

মনে গেঁথে থাকা শৈশবের স্মৃতিকে সাথী করে ১ এপ্রিল, ২০২১ বৃহস্পতিবার গিয়েছিলাম কুলপোতাক গ্রামের সেই মিশনবাড়িতে। সঙ্গে ছিলেন আমার স্ত্রী নাফিসা বানু। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমার চাচাতো ভাই কামরুল হাসান, উপজেলা ভাইস চেয়রাম্যান বাবু দিলীপ দত্ত, স্থানীয় মুরব্বি নুরন্নবী চৌধুরী, বজলুর রহমান চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম নূর মিঞা প্রমুখ। নুরন্নবী চৌধুরী এলাকায় নুরন্নবী বিএসসি নামেই সমধিক পরিচিত। ষাট-সত্তরের দশকে এ ধরনের নামের বেশ প্রচলন ছিল। আজকাল এ রকমভাবে নতুন প্রজন্মের কাউকে ডাকতে খুব একটা শোনা যায় না। আমাদের সঙ্গে মোহনগঞ্জ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল) এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও গিয়েছিলেন। ইউনিয়নটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো আদর্শনগর। এটি মূলত একটি বেশ বড় বাজার। এখানে শহীদস্মৃতি কলেজ নামে একটি সুন্দর কলেজ গড়ে উঠেছে। এখানে ব্যাংক আছে, হাইস্কুল আছে, আছে পুলিশের ইনভেস্টিগেশন সেন্টার। আমার অনুজ প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব সাজ্জাদুল হাসানের উদ্যোগে ২০১৫ সালে এ দৃষ্টিনন্দন কলেজটি স্থাপিত হয় স্থানীয় দানশীল মানুষদের সহযোগিতায়। কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুলে চারদিক ঘেরা। চারপাশের সীমানা দেয়ালের ভিতরে বিরাট সবুজ খেলার মাঠ। সুরম্য অট্টালিকা। অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রোমাঞ্চিত হই। কলেজের লাইব্রেরিটিও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ক্লাসরুম, কনফারেন্স রুম সবই আধুনিক সাজে সজ্জিত। কলেজটির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে নেমে গেছে কুলপোতাকের রাস্তা। জিপ গাড়িতে যাচ্ছি, রাস্তার দুই ধারে অবারিত সবুজের সমারোহ। মাঠে মাঠে সবুজ ধানের চারাগুলো জানান দিচ্ছিল আর কিছুদিন পরই ওরা শস্যবতী হবে। ধারণ করবে সোনালি রং। গৃহস্থের গোলা ভরে উঠবে সোনালি ধানের বৈভবে। এক-দেড় কিলোমিটার দূরত্ব পার হতেই কুলপোতাক গ্রাম। গাড়ি থামল মিশনের কাছাকাছি। হেঁটে যেতে হবে ৫০ গজের মতো। চারদিকে তাকিয়ে একটু ভালো করে দেখে নিলাম। শৈশবে দেখা চিত্র পেলাম না। সাহেব-মেমসাহেবদের সেই ছোট ছোট বাংলোর মতো ঘরগুলো এখন ধ্বংসস্তূপ। অদূরেই গড়ে উঠেছে একটি সুন্দর চার্চ। তবে আমি সেটিতে যাইনি। যে চার্চটিতে আমি গিয়েছিলাম সেটি দেয়ালের ওপর চৌচালা টিন দিয়ে তৈরি। একসময় কুলপোতাক গ্রামের খ্রিস্টান সম্প্রদায় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। বিশ্বাসে উভয় গ্রুপই Protestant খ্রিস্টান। এ বিভাজন ছিল গোষ্ঠীগত মতানৈক্যের কারণে। জানতে পারি, মতানৈক্যের কারণেই অন্য চার্চটি পরবর্তীতে গড়ে ওঠে। এখন অবশ্য কুলপোতাকের খ্রিস্টধর্মাবলম্বী সবাই একত্রে মিলেমিশে বড়দিনের অনুষ্ঠানসহ অন্যসব ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান দুটি চার্চেই করে থাকেন। তাদের মধ্যে এখন আর অমিল নেই।

আমাকে ও অন্য অতিথিদের চার্চের ভিতরে ফুল দিয়ে বরণ করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। চার্চের প্যাস্টর (Pastor) বা যাজক বিধুভূষণ মজুমদার তাঁদের ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু পাঠ করেন। তাঁর কথাগুলোর মধ্যে ছিল- ‘এই করোনা মহামারীতে ঈশ্বর আমাদের এখনো সুস্থ রেখেছেন, এটা তাঁর কৃপা। আমরা সবাই যেন সমাজের অনাচার দূর করতে সচেষ্ট হই। প্রভুর কৃপার কথা স¥রণে রেখেই যেন আমরা আমাদের পথচলা ঠিক করি।’ এ অনুষ্ঠানটিতে গ্রামের হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টান এ তিন সম্প্রদায়ের মানুষই উপস্থিত ছিলেন। এ যেন এক অসাম্প্রদায়িক চিত্র। আমার বক্তব্য শেষ হলে তারা আমাদের চার্চের অফিসে নিয়ে যান। সেখানে যথেষ্ট ফল ও মিষ্টান্নের ব্যবস্থা ছিল। আমি হেঁটে গ্রামের কিছু অংশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। বেশ কয়েকটি বড় পুকুর আছে এ গ্রামে। তবে আমার শৈশবে দেখা এ গ্রামের সেই শ্রী আজ আর নেই। রাস্তাঘাট হয়েছে বেশ। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বেশ ছেদ পড়েছে বলে মনে হয়। চারপাশের প্রকৃতিতে এসেছে পরিবর্তন। যেমনিভাবে পাথর বাটির পেয়ালার জায়গায় স্থান করে নিয়েছে চীনামাটির পেয়ালা, যাতে করে অতিথিদের চা পরিবেশন করা হয়। দেখছি, সেখানে এখন কেরোসিনের সাহায্যে চালিত পাখার জায়গায় বৈদ্যুতিক পাখার স্থান। সময়ের পথ ধরেই এ পরিবর্তন। তবে গ্রামের মানুষের স্নেহ ও মায়ামমতার মাঝে কোনো ঘাটতি নেই। ছিল না কোনো কমতি। মহিলারা বারবার বলছিলেন, ‘স্যার আবার আসবেন, আবার আসবেন।’ শুনছিলাম, আমার স্ত্রীকেও তারা বলছিলেন, ‘আপনাদের এ আগমন আমাদের আপ্লুত করেছে।’ অনুভব করেছি এটা তাদের হৃদয়নিঃসৃত উচ্চারণ। এতে ছিল না কোনো কৃত্রিমতা। আমি তো এ ইউনিয়নেরই বাসিন্দা। কিন্তু সেই ছোটবেলার পর আর কখনো যাওয়া হয়নি এ গ্রামে। বলতে ইচ্ছে হয়, ‘বাড়ির কাছে আরশীনগর (একঘর)/সেথা পড়শী বসত করে/আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।’

কুলপোতাক গ্রামের প্রখ্যাত ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন শ্রীযতীন্দ্র বিশ্বাস। তাঁকে স্থানীয়রা একজন বড় জোতদার হিসেবে বেশ মান্য করত। মিশনের অধিকাংশ জমিই তাঁদের ছিল। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা যতীন্দ্রবাবুর কাছ থেকে জমি কিনে মিশন স্থাপন করেন। যতীন্দ্রবাবুদের পরিবারের প্রায় সবাই ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর ধীরে ধীরে ভারতে প্রত্যাবাসিত হতে শুরু করেন। তবে যতীন্দ্রবাবু দেশত্যাগ করেন ১৯৫৮ সালের পর।

কুলপোতাক গ্রাম ছাড়াও নেত্রকোনার দুর্র্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলায় এখনো কিছু খ্রিস্টধর্মানুসারী রয়েছেন। তবে তাঁরা গারো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। জেলার অন্য কোথাও সম্ভবত বাঙালি খ্রিস্টান নেই। বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী মানুষের আনুপাতিক হার সম্ভবত .৫০%-এরও কম। অর্থাৎ প্রতি ২০০ মানুষের মধ্যে একজনেরও কম। অতীতের আদমশুমারিগুলো এ রকমই ইঙ্গিত করে। নেত্রকোনার মোট জনসংখ্যার শতকরা .৮২% জন খ্রিস্টান। সমগ্র দেশের তুলনায় এখানে আনুপাতিক হার একটু বেশি। তার মধ্যে দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলায় এর আনুপাতিক হার আরও একটু বেশি যথাক্রমে ৩.৯০% ও ৩.১৭%। মোহনগঞ্জ উপজেলার কুলপোতাক গ্রামের লোকসংখ্যা ২০০০-২২০০ এর মধ্যে। এর মধ্যে হিন্দুধর্মাবলম্বীর সংখ্যা আনুমানিক ৫০%-৫৫%, মুসলিম ৩৫% এবং খ্রিস্টান আনুমানিক ১০%-১২%। গ্রামটিতে মন্দিরের সংখ্যা চার-পাঁচটির মতো (ছোট ছোট মন্দির ছাড়া), মসজিদ তিনটি, চার্চ দুটি। ঢাকার পান্থপথে Baptist Church
Fellowship-এর অফিস আছে। এদের সঙ্গে কুলপোতাকের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের যোগাযোগ আছে। ঢাকার এ অফিস এদের খোঁজখবর রাখে। কিছু দেখভালও করে।

শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে কুলপোতাক ভ্রমণ শেষ হয়। এবার মোহনগঞ্জে ফেরার পালা। চার্চের হলঘরের মানুষগুলোর কথা মনে পড়ছিল। তিন ধর্মের মানুষ একত্রিত হলেন কি পরম আনন্দে! যেন তারা একে অন্যের বন্ধু-আত্মীয়। যাজকের কথাগুলো আমার মনে অনুরণিত হচ্ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন যে অসাম্প্রদায়িক বাংলার স্বপ্ন দেখতেন এটি তো সেই বাংলা। কুলপোতাক গ্রামই যেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের এক খন্ডিত প্রতিচ্ছবি। এ গ্রামে প্রতিদিন আজানের ধ্বনি যেমন প্রতিধ্বনিত হয় তেমনি মন্দিরে শাঁখও বাজে, গির্জায় ঘণ্টাও বাজে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিখাদ চিত্র খুঁজে পেয়েছি এখানে। এখানকার মানুষগুলোর মধ্যে এ নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। এ চিত্রে যেন তাদের প্রাণের কথা রয়েছে-

আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর

থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।

আমাদের ভ্রমণ আয়োজকদের আপ্যায়নসহ সবই ছিল খুব চমৎকার। আমি ও আমার স্ত্রী ওইদিন রোজা রাখার কারণে তাঁদের আপ্যায়ন গ্রহণ করতে পারিনি। এটি আয়োজকদের একটু মনঃকষ্টের কারণ হয়েছিল। কথা দিয়েছি সুযোগ পেলে আবার আসব। গ্রামের সব মুরব্বি ও অন্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় গাড়িতে উঠি। দুই পাশে গ্রামটি দেখতে দেখতে ফিরছি। আর সেই সঙ্গে মনে পড়ছিল আমার সেই শৈশবকালের সাহেব, মেমসাহেবদের আতিথেয়তার কথা। ভাবনায় যুক্ত হচ্ছিল আজকের দেখা সম্প্রীতিপ্রিয় মানুষগুলোর আন্তরিকতা ও ভালোবাসার কথা। তাদের হাসিমাখা ভালোবাসা ও স্নেহের কথা। গ্রামটি আমার মানসপটে স্থান করে নিয়েছে। কবিগুরুর ভাষায় কুলপোতাকের রূপ বর্ণনায় বলতে চাই, পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ স্তব্ধ অতল দিঘী কালোজল, নিশীথশীতল স্নেহ।

কুলপোতাক গ্রাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। শৈশবের স্মৃতিজড়িত বহুকাল পরে দেখা এ গ্রামের সবুজ প্রকৃতি ও মানুষের সম্প্রীতির মাঝে অনন্য এক মানবিক চিত্র খুঁজে পাই। কুলপোতাক গ্রাম আমার ভাবনার এক অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে রইবে। আমি যেন এ কুলপোতাক গ্রামেরই একজন।

                লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ।

সর্বশেষ খবর