বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ভাইরাসবিরোধী যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য জোট চাই

খায়রুল কবীর খোকন

ভাইরাসবিরোধী যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য জোট চাই

চীনের ইচ্ছাকৃত ভাইরাসযুদ্ধ হোক কিংবা রাষ্ট্রীয় ‘মগ-দস্যু’ মার্কা কর্তৃপক্ষের বেকুবপনার পরিণতিতে হোক, এ কভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) সংক্রমণ সারা বিশ্বে ছড়ানোর জন্য ওই ‘তথাকথিত সমাজতন্ত্রী’ রাষ্ট্রটি দায়ী; বলা চলে শতভাগ দায়ী। চীনের বদমায়েশি না থাকলে ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মাঝে উহান নগরীতে সংক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র চীনা সীমান্ত ‘সিল্ড’ করে ওই রাষ্ট্রটি দুনিয়ার বাকি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সার্বিক যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে সংক্রমণ ছড়ানোর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারত। তারা তা করেনি, বরং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ‘দুনিয়াব্যাপী স্বাস্থ্য-জরুরি অবস্থা’ ঘোষণায় বাধা দিয়েছে- ‘ধীরে চল’ নীতি অনুসরণের জন্য লবিং করেছে জোরেশোরে।

পরে এ করোনাভাইরাস ছড়ানোর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ সৃষ্টির বৈশ্বিক কর্মকান্ডে সে এগিয়ে আসেনি; চীন নিজের ভূখন্ডে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টায় সাফল্য লাভ করেছে, কিন্তু সে বিশ্বের অন্যসব দেশকে বা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাকে এ ক্ষেত্রে এগোতে সহায়তাদান করেনি। চীন এ করোনাভাইরাস সংক্রমণের আদ্যোপান্ত গবেষণা বা আন্তর্জাতিক তদন্ত কাজটিও করতে দিল না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি দলকে তারা সহযোগিতার বদলে বিভ্রান্তিকর তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বিদায় করেছে।

এখনো এ গ্রহের ২২১টি রাষ্ট্র ও অঞ্চলে এ করোনাভাইরাস সংক্রমণের ও মারাত্মক প্রাণহানির তান্ডবে সারা বিশ্ব নিদারুণ অসহায়। পশ্চিমা বিশাল বিশাল অর্থনীতির ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোও করোনাযুদ্ধে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ। এর মূল কারণ সাধারণ মানুষ অতিমাত্রায় ভোগবাদী হওয়ায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কঠোর তৎপরতায় নিজেদের বন্দী রাখতে একেবারেই অনাগ্রহী, তারা সর্বদা চায় আমোদ-স্ফূর্তির মাঝে জনতার ভিড়ের ভিতরে হইহল্লার জীবন কাটাতে।

এর পাশাপাশি করোনাভাইরাস-প্রতিরোধী ভ্যাকসিন আবিষ্কার একটা বড় সাফল্য হলেও তা পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরির ব্যবস্থাপনা অনুপস্থিত, সে পরিমাণ বিনিয়োগও নেই। আর ভ্যাকসিন গবেষণায় ‘মাফিয়া চক্র’ সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে কি না তা-ও পরিষ্কার নয়। এ ধরনের ভ্যাকসিন নিয়ে কোন ‘মাফিয়া চক্র’ কতটা ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে দুনিয়া লুট করবে তা তো সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে না। এখানেই ধনী রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অমানবিকতা চূড়ান্ত মাত্রায় ধরা পড়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অসহায়ত্বও পরিষ্কার হচ্ছে। ‘ওষুধ মাফিয়া চক্রগুলোর’ ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার কিংবা তাদের সঙ্গে স্বার্থবিষয়ক পার্টনার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। সেটা এবার ভালোভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে।

এখন দরকার হচ্ছে সারা দুনিয়ার ২২১ রাষ্ট্রের ও অঞ্চলের একটা ঐক্যবদ্ধ ফোরাম প্রতিষ্ঠা, যার প্রধান লক্ষ্য হবে করোনাভাইরাস সংক্রমণসহ দুনিয়াব্যাপী সব ধরনের মহামারী-অতিমারী এবং অন্যসব সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে প্রচ- লড়াই করা। চীন ও উত্তর কোরিয়াকে এ উদ্যোগের প্রথম পর্যায়ে না রাখাই ভালো, যুক্তিসংগত কারণেই এ দুই রাষ্ট্র এ ধরনের বৈশ্বিক উদ্যোগে সাড়া দেবে না, বরং বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে, এর বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু করতে পারে। সেসব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র থেকে এ নতুন উদ্যোগকে দূরে রাখতে হবে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও করোনাভাইরাস লড়াইয়ে কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জনে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে কার্যকর সহায়তাদান করতে পারেনি। কানাডা, ব্রিটেন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি এসব দেশের নেতৃত্বে ২২১ রাষ্ট্রের (চীন ও উত্তর কোরিয়াকে শুরুতে এ উদ্যোগের বাইরে রাখা আবশ্যক, তাতে ২১৯ রাষ্ট্র সম্ভাব্য সদস্য) একটা আন্তর্জাতিক ফোরাম প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এ ফোরাম বিশ্বব্যাপী একটা গণতহবিল (অতীতের স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার ‘মুষ্টিভিক্ষা’ ধরনের) গড়ে তুলবে। বাড়ি বাড়ি প্রতি বেলা খাবারের রান্নার চাল থেকে এক মুষ্টি এ গণভিক্ষা তহবিলের দান হিসেবে সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। (যেসব দেশে চাল খাবারের প্রধান উপকরণ নয়, সেসব দেশে দুই বেলা খাবারের মেন্যু থেকে সামান্য কিছু কমিয়ে সে অর্থ দান করতে হবে এ খাতে) আর রাস্তায় রাস্তায় এ গণতহবিলের ‘কৌটা-ভিক্ষাপাত্র’ নিয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে লাগানো যায় দুনিয়াব্যাপী। (প্রতিটি রাষ্ট্রে একটা জাতীয় কমিটি এ তহবিল নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্রীয় বিশ্ব গণতহবিলের নিয়ন্ত্রণে থেকে)।

সারা বিশ্বের দেশে দেশে এসব স্বেচ্ছাসেবীকে (তাদের মোট সংখ্যা হতে পারে কমপক্ষে ১ কোটি/বাংলাদেশেই তাদের সংখ্যা ৩ লাখ করা যেতে পারে) কাজে লাগিয়ে এভাবে বছরব্যাপী গণতহবিলের অর্থ সংগ্রহ করা দরকার। আগামী ১২ মাস এভাবে অন্তত ১০ লাখ কোটি টাকার গণতহবিল সংগ্রহ করা সম্ভব। এ গণতহবিল দিয়ে করোনাভাইরাসসহ সব ধরনের সংক্রামক ভাইরাস ও জীবাণুর ব্যাপারে গবেষণাকর্ম চালানো এবং সব ধরনের সংক্রামক রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও তা ব্যাপকভাবে তৈরি এবং সারা বিশ্বে সব রাষ্ট্রের (বিশেষভাবে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর কাছে) কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথম পর্যায়ে ১২ মাসে ১০ লাখ কোটি টাকার গণতহবিল সংগ্রহ সমাপনের পরও এ তহবিল চালু রাখতে হবে ভবিষ্যতের নিত্যনতুন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। আর এ ১০ লাখ কোটি টাকা জনস্বাস্থ্য বিশ্ব জোটের খরচের জন্য এক বছরকালই যথেষ্ট। এ ছাড়া উপায় নেই। কারণ অতীতে আমেরিকা তহবিল প্রদান বন্ধ করায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ‘ত্রাহি ত্রাহি’ কান্না শুরু হয়েছে। তার রুটিন ওয়ার্ক বন্ধ হওয়ার জোগাড়। ওইসব ‘কান্নাকাটি’ দিয়ে তো আর বিশ্বব্যাপী বিশালকায় জনস্বাস্থ্য রক্ষার নতুন কার্যক্রম চালিয়ে সফল করা সম্ভব নয়।

এদিকে এটা তো প্রমাণিত হয়েছে, বিশ্বে এ ধরনের মহামারী-অতিমারী আরও বৃহৎ পরিসরে যে কোনো সময়ে হানা দিতে পারে; সেটা যে কোনো ভাইরাস-গবেষক রাষ্ট্রও তো করতে পারে ‘জীবাণুযুদ্ধের শয়তানির’ জন্য; আর প্রকৃতিগত কারণেও যে কোনো সময়ে এ ধরনের নতুন নতুন ভাইরাস আক্রমণ শুরু হওয়া অস্বাভাবিক নয়। প্রায় ১০০ বছর আগেকার স্প্যানিশ ফ্লুর (১৯১৮-১৯২০/প্রায় দুই বছরব্যাপী) সংক্রমণে আনুমানিক ৫ কোটি লোকের প্রাণহানি আর বিশ্বের জনসমষ্টির (তখনকার জনসংখ্যা ছিল ১৬০ কোটি) এক-তৃতীয়াংশ লোকের সংক্রমণ দুর্ভোগ, পরবর্তীকালের আফ্রিকার ‘ইবোলা’ ভাইরাস সংক্রমণ ও ব্যাপক প্রাণহানি এবং আরও কয়েকবার বার্ড ফ্লু ও সার্স, মার্স ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি আর সর্বশেষ দুনিয়াব্যাপী বিগত ১৭ মাসের কভিড ১৯ সংক্রমণ থেকে আমরা এসব শিক্ষা সহজেই পেয়েছি।

জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিশ্বব্যাপী নতুন ঐক্যজোটকে জাতিসংঘের সহায়তায় এমন একটা কার্যকর প্রক্রিয়া বের করতে হবে যাতে কোনো একক রাষ্ট্র ভাইরাস গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যে কোনো সময়ে ‘জীবাণুযুদ্ধ’ শুরুর সুযোগ না পায়। সব ভাইরাস গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ল্যাবরেটরি কার্যক্রম এ নতুন ঐক্যজোটের শতভাগ নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। কাজটি বেশ কঠিন, কিন্তু বিশ্বব্যাপী গণজাগরণ সৃষ্টির মাধ্যমে তা সফল করা সম্ভব। এটার কোনো বিকল্প নেই। চীনসহ অন্য যে কোনো রাষ্ট্র এ ভাইরাস গবেষণা নিজ নিজ নিয়ন্ত্রণে করতে সক্ষম হলে কেউ না কেউ হঠাৎ নিজের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিকে দুনিয়াসেরা করার কুবুদ্ধিতে আক্রান্ত হয়ে জীবাণুযুদ্ধ শুরু করবেই করবে। সেটা আর হতে দেওয়া যাবে না। আর বাদুড়, বনরুই ও অন্যসব প্রাণীর শরীর থেকে এ ধরনের নতুন নতুন ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমণের আশঙ্কা কতটা আছে সেসব নিয়েও কেন্দ্রীয়ভাবে এবং ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গবেষণা চালাতে হবে, সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে ‘জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিশ্বব্যাপী নতুন ঐক্যজোট। তবে এর পেছনের শক্তি হবে বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যবিষয়ক একটা ফোরাম গড়ে তোলার পক্ষে একটা অসামান্য গণজাগরণ। সেই গণজাগরণ ছাড়া এত বড় নতুন উদ্যোগ কীভাবে গড়ব আমরা।

লেখক : যুগ্মমহাসচিব, বিএনপি; সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর