শুক্রবার, ২৮ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

জীবন ও জীবিকার বাজেট

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

জীবন ও জীবিকার বাজেট

সবাই উদগ্রীব এখন জাতীয় বাজেটের জন্য। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, জীবন ও জীবিকার বাজেট জাতীয় বাজেটের থেকে আলাদা কিছু কি না। এ প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক যে জাতীয় বাজেটের মধ্যে করোনা মোকাবিলার মতো, করোনায় বিধ্বস্ত অর্থনীতি, গণস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা পুনরুদ্ধারের মতো জরুরি বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে কি না। প্রশ্ন এ কারণেও উঠতে পারে যে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রয়োজনীয় খাতে (এ মুহূর্তে যেমন জীবন ও জীবিকা) যথাযথ (ব্যয়সাশ্রয়ী, অর্থায়ন আয় বৃদ্ধি ও কৃচ্ছ্রসাধন অর্থে ব্যয় সংকোচন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি-বেসরকারি খাত দল-মত নির্বিশেষে ঐকবদ্ধভাবে দুর্যোগ মোকাবিলায়) ব্যবহৃত হচ্ছে বা হবে কি না। নতুন বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সবাই পরামর্শ দেন, সুপারিশ করেন, দাবি তোলেন কিন্তু সেই বরাদ্দের বিপরীতে অর্থায়ন ও লক্ষ্যভেদী বাস্তবায়নের পরিস্থিতি, সেই ব্যয়ের তাৎক্ষণিক, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি ইমপ্যাক্ট ও অভিঘাত সম্পর্কে অবহিত হওয়ার অবকাশ বরাবরই হালে পানি পায় না। সাধারণ সময়ে সে অবকাশ কমবেশি দেরিতে মিললেও করোনা মোকাবিলার মতো জরুরি সময়ে বরাদ্দ ব্যবহার এবং কর্মপরিকল্পনা প্রয়োগও জরুরি এ কারণে যে ‘রোগী মারা যাওয়ার পর চিকিৎসকের উপস্থিতি’র মতো পরিস্থিতির যেন উদ্ভব না হয়।

জীবন ও জীবিকার জন্য বাজেটকে জাতীয় বাজেট থেকে আলাদা অলিন্দে নয়, একীভূত হিসেবে দেখাই জরুরি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি খাতে অগ্রাধিকার ঘোষণা এবং বরাদ্দ বাড়ালেই বাজেট জনগণের বাজেট বা ইতিবাচক হয় না, স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ালেই মহামারী মোকাবিলা, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অটোমেটিক্যালি বাড়ে না, যদি এ খাতের ব্যয়ের সক্ষমতা ও সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন বহাল থাকে, দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা-অপারগতায় আকীর্ণ থাকে এবং তা নিরসন নিয়ন্ত্রণে তথা জবাবদিহিকরণে ‘কথায় নয় কাজে’ অগ্রগতি না থাকে। বাজেটে বরাদ্দ বড় কথা নয়, অর্থনীতিতে সে বরাদ্দের দ্বারা কতটা সম্পদ ও সেবা সৃষ্টি হলো, প্রভাব ফেলতে পারল সেটিই বড় কথা। করোনা সংকটে বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের কর্মসংস্থান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার মতো খাতগুলো অগ্রাধিকারপ্রাপ্য। গত বছর (এখনো পর্যন্ত চলতি বাজেট বর্ষে) করোনার প্রভাবে বাজেট প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের গুরুত্ব আলোচিত হলেও, সেখানে বরাদ্দ নমিনাল টার্মে আপেক্ষিকভাবে কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও দেখা যায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শিক্ষা, দক্ষ জনসম্পদ তৈরি, ফরমাল ও ইনফরমাল সেক্টরে কর্মসৃজনমূলক শিল্পোদ্যোগে কার্যকর পদক্ষেপের, বাস্তবায়নের খাতে বরাদ্দ সে হারে আরও বাড়ানো প্রয়োজন ছিল, যেভাবে বা হারে অন্য অনেক অগৌণ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছিল সেভাবে বা হারে করোনা যে আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি সাধন করেছে তা পুনরুদ্ধারে পরিপূরক ও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারত সেসব খাত যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাড়েনি। তথাপি এবং তদুপরি সেই বরাদ্দকৃত অর্থের বণ্টন ও ব্যবহার বা বাস্তবায়নের হিসাব মেলানোর সুযোগ সীমিত। করোনাকালে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ শিক্ষা কার্যক্রমবিহীন (বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে) খাতে ব্যবহৃত হয়েছে। বিদ্যমান ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে মহানগর ও শহরে বিকল্প (অনলাইনভিত্তিক) শিক্ষা কার্যক্রম কিছুটা চললেও দেশব্যাপী, ব্যাপক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পাঠবিমুখ করা হয়েছে। টেবিল চেয়ার পাহারা আর দায়দায়িত্ব কর্মহীন শিক্ষকের পেছনে এবং বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণে ব্যবহৃত হয়েছে সিংহভাগ বরাদ্দ। অগৌণ শিক্ষা খাতের দিকে দৃষ্টি না দিলে শিক্ষায় বা সমাজে যে ক্ষরণ ও ক্ষত সৃষ্টি হবে তা হবে করোনার চাইতে বড় অভিঘাত। করোনায় জাতীয় নয়, মহানগর-শহর যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে গ্রামাঞ্চলে সেভাবে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, অথচ জাতীয় পর্যায়ের থেকে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে, মহানগরে ও শহরে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে অনলাইনে কিছু শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও গ্রামে (যেখানে সিংহভাগ শিক্ষার্থী, যারা শহরের তুলনায় ইতিমধ্যে গুণগত শিক্ষার ক্ষেত্রে বঞ্চনা বৈষম্যের শিকার হয়ে আছে) সেসব চালুর কোনো পদক্ষেপ নেই, ফলে বৈষম্য আরও বাড়বে। জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন ক্ষেত্রে এ ধরনের বৈষম্য যত বাড়বে তত জাতীয় উন্নয়নপ্রয়াস মাঠে মারা যাবে। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা কিংবা বিকল্প শিক্ষা কার্যক্রম স্থানীয়ভাবেই সাময়িকভাবে হলেও চালু রাখার যৌক্তিতা মাথায় নিতে হবে। ‘অটো পাস’-এর মতো আত্মঘাতী পদক্ষেপে যাওয়া থেকে দূরে থাকাই হবে দায়িত্বশীলতার পরিচয়। জীবন-জীবিকার বাজেটে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখার আবশ্যকতা থাকবে। শহরে ও মহানগরে করোনার প্রকোপ থাকলেও গ্রামে করোনা ছিল না বা নেই বললেই চলে, অথচ গোটা দেশকে লকডাউনের আওতায় এনে শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গণপরিবহন বন্ধ রাখার বিষয়টি সামগ্রিকতায় পুনর্বিবেচনাযোগ্য।

বাংলাদেশ অর্থনীতির প্রাণবায়ু কৃষি খাতে কৃষির উৎপাদন কৃষি তথা সামগ্রিকভাবে কৃষি খাতের উন্নতি একটি সম্মিলিত প্রয়াস। যেখানে কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষক ও কৃষি উপকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাইভেট সেক্টর, আমিষ, শর্করা সরবরাহকারীরাও সরাসরি জড়িত। কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি/ প্রণোদনা যেন যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে সত্যিকার প্রান্তিক চাষিরা, খামারিরা পায়। নতুন নতুন উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরের অবদান কম নয়। সেজন্য পাবলিক সেক্টরের পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরেও বাজেট বরাদ্দ থাকা উচিত।

রাসায়নিক সারের তুলনায় জৈবসারে মাটির স্বাস্থ্য ভালো করে বিধায় রাসায়নিক সারের মতো বাজেটে জৈবসার উৎপাদনে ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। প্রান্তিক চাষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা, খামারি, মাছ চাষির কাছে স্টিমুলাস প্যাকেজের টাকা পৌঁছায়নি। ব্যাংক বা আর্থিক খাতে বিশাল ব্যাধির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হয়নি। ধনী আরও ধনী হওয়ার সহজ সুযোগে আয়-বৈষম্য বেড়েই চলেছে। অন্তর্ভুক্তির নামে বিচ্ছিন্নতাই বাড়তে থাকলে ‘কাউকে পেছনে ফেলা যাবে না’ এসডিজি গোল অর্জনের এ মর্মবাণী সকরুণ ব্যর্থতার বিবরে উন্নয়নশীল অর্থনীতির কপালে কালো তিলক আঁকতেই থাকবে।

এ মুহূর্তে করোনা মোকাবিলায় দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে চলমান ও টেকসই রাখতে সুপরিকল্পিত ও সম্প্রসারণধর্মী বাজেটের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, বাজেট বাস্তবায়নে যথাযথ পরিবীক্ষণ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ধর্মী যোগাযোগ ও লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সমঝোতা বৃদ্ধি, ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সবার সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করতে পারলে করোনাকালেও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বইকি। করোনাকাল সহসা চলে যাবে এমন ধারণায় চলতি বাজেট করা হয়েছিল, করোনা এখনো যায়নি, জীবন ও জীবিকার সন্ধানে ঝুঁকি নিয়ে মানুষ দ্বিতীয় ধাক্কা আসার আগে নিজের থেকে ছোটাছুটি করছে এটাকে স্বস্তির ও আত্মতৃপ্তির বিষয় ভাবা সমীচীন হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। ২০২১ সালেও করোনার অভিঘাত অব্যাহত থাকবে এটা মনে রেখে বাজেটে পরিকল্পনা আঁটতে হবে। ব্যয় কৃচ্ছ্রসাধনে ঢিলেমি কিংবা যে কোনো প্রসঙ্গ পলায়নি মনোভাব, দোষারোপ হবে অবিবেচকের কাজ।

এখন জ্বলন্ত ইস্যু হচ্ছে করোনাভাইরাস। জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন প্রথম, দ্বিতীয় ইস্যু হচ্ছে জীবিকা। তৃতীয় এবং অন্যতম ইস্যু সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত দুর্নীতি দমন। অভ্যন্তরীণ বাজার ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো। এটা এখন এক নতুন বাংলাদেশ। আগের অবস্থা আর ফিরে আসবে না। নতুন পরিস্থিতি, নতুন সমস্যা, নতুন সম্ভাবনা। অর্থনীতির কাঠামো পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে হবে। মোদ্দা কথা, অর্থনীতিতে রেজিলিয়েন্ট পাওয়ার এবং মানবদেহে ইমিউন পাওয়ার বাড়াতে হবে। সামনের চ্যালেঞ্জগুলো যেমন ব্যয়ের বাজেটে অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ (রাজস্ব) সম্পদের অপ্রতুলতা, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে দৃশ্যত স্থবিরতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অনুপস্থিতির আড়ালে, দুর্নীতিগ্রস্ততায় অর্থনীতিতে ক্ষরণ, কস্ট অব ডুয়িং বিজনেসের ঊর্ধ্বগামিতা, মেগা প্রকল্পে ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ার পরিবর্তে ব্যয় বৃদ্ধি, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা, করোনাকালে কিংবা করোনা-উত্তর অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কৃচ্ছ্রসাধন ও ব্যয় সংকোচনের দাবি ও যৌক্তিতা অনুসরণে অপারগ পরিস্থিতি ও পরিবেশ, বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া, প্রবাসীদের দেশে ফেরা, রপ্তানি বাজার সংকুচিত হওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তনহেতু বন্যা, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ে কৃষি উৎপাদন ও জানমালের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বহির্মুখীন খাত ও ক্ষেত্রসমূহ সংকুচিত হওয়া।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আপাতত রাজস্ব আহরণ খাতে চলমান সংস্কার ও অনলাইনিকরণ বাস্তবায়নে দৃঢ়চিত্ত ও সময়সূচিভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা। বিদ্যমান আইনের সংস্কার এবং অনলাইনিকরণ ছাড়া বিদ্যমান কর্মকাঠামো ও লোকবল দিয়ে রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি ও পরিবেশের উন্নয়ন সাধন সম্ভব ও সমীচীন হবে না। করদাতা এবং কর আহরণকারী দফতরের মধ্যে রাজস্ব আহরণবিষয়ক জটিলতা সমস্যা আপিল আবেদন নিষ্পত্তি উপরিদর্শনের মাধ্যমে পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কর ন্যায়পাল অফিস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা; বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অচল অর্থনীতি সচল রাখার, বেকার ও ক্ষুধা রোখার, করোনায় ক্ষতি পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন, করোনায় সৃষ্ট মন্দা মোকাবিলা এবং সম্ভাব্য সুযোগের (কৃষি, স্বাস্থ্য খাত, আইটি, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার খাতে অধিক মনোযোগ ও দক্ষ জলবল সৃষ্টিসহ বিদেশফেরত বিদেশি বিনিয়োগ ঘরে আনা) সদ্ব্যবহার ও অনিশ্চিত পরিস্থিতি মোকাবিলার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ, কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দিকনির্দেশনা ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে আয়-ব্যয় বণ্টনে, কৌশল নির্ধারণে তার প্রতিফলন থাকতে  হবে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর