শনিবার, ২৯ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

প্রবাসীদের পাসপোর্ট নবায়নের জটিলতা নিরসন হোক

শাইখ সিরাজ

প্রবাসীদের পাসপোর্ট নবায়নের জটিলতা নিরসন হোক

বন্ধু পারভেজ ইমদাদ এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে অবসর নেওয়ার পর এখন বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে। তার সঙ্গে অর্থনীতি ও দেশ-বিদেশের নানা ইস্যু নিয়ে প্রায়ই দীর্ঘ আড্ডা জমে হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারে। সেদিন কথায় কথায় উঠে এসেছিল প্রবাসীদের পাসপোর্ট নবায়নে যেসব জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় সে বিষয়টি। ইমদাদ বলছিলেন, ‘সিরাজ, তুমি হয়তো কিছুটা জানো, প্রবাসে একজনের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া কিংবা ভ্যালিড পাসপোর্ট হাতে না থাকা মানে হঠাৎ করে তার অবৈধ হয়ে যাওয়া। আর অবৈধ হয়ে যাওয়া একজন মানুষ মূলত অসহায়।’ আমার মনে পড়ল বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশি প্রবাসী অনেকের কাছ থেকেই এ সমস্যা নিয়ে শুনেছি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের এ সমস্যা প্রকট। এখন করোনার এ লকডাউনের সময় সে সমস্যা আরও বেশি জটিল আকার ধারণ করেছে। খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যে অনেক প্রবাসীর পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তারা অবৈধ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছেন। নবায়নের জন্য আবেদন করলে তিন-চার মাসেও মিলছে না নতুন পাসপোর্ট।

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কৃষি উদ্যোগ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে দেখেছি পাসপোর্ট নবায়নের জন্য বেশ জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় প্রবাসীদের। অনেক প্রবাসী বাংলাদেশির অভিযোগ, সৌদি আরবে অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কোনো তদারকি নেই। সেবার পরিবর্তে সেখানে চলে নানা অনিয়ম। প্রবাসীরা প্রতিবাদ করলেও কোনো কাজ হয় না। তাদের অনেকেই বলছিলেন, যে প্রতিবাদ করে তাকে আরও বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়; তার পাসপোর্ট নবায়ন হয় অনেক পরে। সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৮-১০ লাখ বাংলাদেশির সরকারি সেবা নিশ্চিত করেন বাংলাদেশ জেদ্দা কনস্যুলেট। পাসপোর্ট নেওয়ার জন্য কনস্যুলেটের সামনে লম্বা লাইন থাকে। অনেক প্রবাসী কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কাউন্টারে যেতে যেতে বিকাল ৪টা বেজে যায়। তখন কনস্যুলেটের পাসপোর্ট অফিস বন্ধ করে দেন কর্মকর্তারা। কাজ রেখে এসে দীর্ঘ লাইন পাড়ি দিয়েও শেষ পর্যন্ত অফিসের কর্তাব্যক্তির কাছে পৌঁছানোই সম্ভব হয় না। কোনো কোনো প্রবাসী হয়তো ৭০০-৮০০ কিলোমিটার দূর থেকেও সেবা নিতে আসেন। দিনে দিনে কাজ শেষ করা তো হয়ই না, পাসপোর্ট হয়েছে কি না তার খবর নিতেও তাকে ফের একই দূরেত্বর পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়। এটি একজন প্রবাসীর জন্য বড় ধরনের একটা ঝক্কি। অথচ এই প্রবাসীদের রেমিট্যান্সই আমাদের অর্থনীতি চাঙা রাখতে বড় ভূমিকা পালন করছে।

মধ্যপ্রাচ্যে আর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে কর্মীদের যে এজেন্সি বা মধ্যবর্তী ব্যক্তির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়, সেই এজেন্সি বা ব্যক্তি কর্মীর পাসপোর্ট নিজেদের কাছে জিম্মি রাখেন। এতে অনেক সময় পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও অনেকে টের পান না। যখন টের পান তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যায়। যার মাশুল গুনতে হয় কর্মীকে অর্থনৈতিক ও মানসিক দন্ড দিয়ে।

এ বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহর সঙ্গে। গোলাম মসীহ সম্প্রতি অবসরে গেছেন। তিনি ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি জানালেন, প্রবাসীদের পাসপোর্টের তথ্যগুলো দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পর বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর থেকে পুনরায় পাসপোর্ট প্রিন্ট হয়ে দূতাবাস বা কনস্যুলেটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেড় থেকে দুই মাস লেগে যায়। ক্ষেত্রবিশেষ এ সময়টা আরও বেশি হয়।

আমি মসীহ সাহেবকে বললাম, বাংলাদেশি প্রবাসীদের পাশাপাশি ভারতীয় প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি পাসপোর্ট নবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় একজন ভারতীয়র সে ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় না।

গোলাম মসীহ সাহেব জানালেন ভারতীয়দের বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের জন্য পাসপোর্ট প্রিন্টিং ব্যবস্থা আছে। ফলে ভারতীয় নাগরিকদের পাসপোর্ট নবায়নের জটিলতা কম পোহাতে হয়। ১০ থেকে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তারা নতুন পাসপোর্ট পেয়ে যান। গোলাম মসীহ সাহেবের কাছে জানতে চাইলাম, আপনার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে কী মনে হয়- এসব জটিলতার সমাধান কীভাবে সম্ভব? তিনি বললেন, মধ্যপ্রাচ্যে পাসপোর্টের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আকামা। পাসপোর্ট না থাকার কারণে আকামার মেয়াদ বৃদ্ধি করতে না পারার মতো জটিলতা এবং অবৈধ প্রবাসী হয়ে যাওয়ার একটা বিষয় থাকে, তাই তিনি হোস্ট কান্ট্রির দায়িত্বরত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলাপ করে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন নবায়নকৃত পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত দূতাবাস থেকে হাতে লেখা কোনো কাগজ বা সুপারিশপত্র দেওয়ার ব্যাপারে। এটিও দু-চার বছর আগের কথা। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্নতর।

চ্যানেল আইয়ের সাবেক নিউজ প্রেজেন্টার গোলাম মর্তুজা এখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী। তার ভাই গোলাম সারওয়ার মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করছেন। গোলাম মর্তুজার সুবাদে সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয়। মালয়েশিয়ায় আমাদের প্রচুর প্রবাসী আছেন। অনলাইনে গোলাম সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন, ‘আমরা হাতে লেখা পাসপোর্ট থেকে মেশিন রিডেবল পাসপোর্টে পৌঁছেছি। এখন মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট থেকে ই-পাসপোর্টে ট্রানজিশন হচ্ছিল। ঠিক এ সময়ে করোনা মহামারী আমাদের সবকিছুই অনেকটা স্থবির করে দিয়েছে। করোনার কারণে প্রবাসীদের পাসপোর্ট নবায়নের তাগিদ বেড়েছে। স্বাভাবিক সময়ে যখন ৩০-৪০ হাজার পাসপোর্ট নবায়নের জন্য জমা হয়, সেখানে ২০২০ সালের নভেম্বর, ডিসেম্বর থেকে ২০২১-এর জানুয়ারি পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন পড়েছে। একদিকে আমাদের পাসপোর্ট নবায়নের জন্য জনবল বাড়েনি, অন্যদিকে করোনার লকডাউন পরিস্থিতির কারণে যোগাযোগব্যবস্থাও স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে পাসপোর্ট নবায়ন জটিলতা আরও প্রকট হয়েছে। আমি জানতে চাইলাম, এমন পরিস্থিতিতে আপনারা পাসপোর্টে হ্যান্ডরিটেন কোনো অনুমোদন বা সুপারিশ করতে পারেন কি না? তিনি জানালেন, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটির একটা নিয়ম আছে, নভেম্বর ২০১৬-এর পর থেকে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলিংয়ে হ্যান্ডরিটেন আর অ্যালাউড নয়। তবে স্থানীয় পর্যায়ে যে কোম্পানি বা ব্যক্তির অধীনে কাজ করে তাদের কাছ থেকে পারমিশন লেটার নিয়ে কিছুদিনের জন্য চলতে পারে। আমি বললাম, যে যে দেশে প্রবাসী বাংলাদেশির আধিক্য বেশি, সেসব দেশে প্রিন্টিং মেশিন বসানো যায় কি না যেমনটা ভারতের আছে, ইন্দোনেশিয়ার আছে? তিনি জানালেন, সিকিউরিটি ইস্যুর কারণে হয়তো তা করা সম্ভব হচ্ছে না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, অন্যে যদি পারে আমরা কেন পারছি না। সারোয়ার সাহেব বললেন, ই-পাসপোর্টই হতে পারে সব সমস্যার সমাধান।

ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলি। ভারি সজ্জন লোক। প্রবাসীদের পাসপোর্ট নবায়নে বিড়ম্বনার বিষয়টি তার কাছে তুলে ধরলাম। মনোযোগ দিয়েই তিনি আমার কথা শুনলেন। জানালেন, এ সমস্যা নিরসনে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর একটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৮০টি মিশনে ই-পাসপোর্ট দেওয়ার একটি প্রকল্প। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল ই-পাসপোর্ট দেওয়ার মাধ্যমে পাসপোর্ট নবায়ন থেকে শুরু করে নতুন পাসপোর্ট ইস্যুর সব ধরনের জটিলতা কমিয়ে নিয়ে আসা। কিন্তু করোনার কারণে প্রকল্পটির কার্যক্রমে স্থবিরতা আসে। দেশের ভিতরে ৬৯টি স্থানে ই-পাসপোর্ট দেওয়ার প্রজেক্ট চালু আছে। এর মাধ্যমে প্রতিদিন ১৫-২০ হাজার ই-পাসপোর্ট ইস্যু হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ই-পাসপোর্ট ইস্যু করার ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের সঙ্গে পাসপোর্টের তথ্যের সামান্যতম পার্থক্য, এমনকি বানানের সামান্য তারতম্যের কারণেও সেটা মেশিন নিচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে নাগরিক অসচেতনতাও এক রকম দায়ী। এ ধরনের জটিলতায় পড়ে আছে প্রায় ৩৬ হাজার ই-পাসপোর্ট। করোনা মহামারী আর সব বিষয়ের মতো পাসপোর্ট ইস্যু ও নবায়নের মাঝেও স্থবিরতা এনে দিয়েছে। তবে সরকার সব ধরনের সমস্যা নিরসনে পদক্ষেপ নিচ্ছে।

কয়েক দিন আগে গোলাম মসীহ সাহেব আমাকে একটা নিউজ রিপোর্টের লিঙ্ক পাঠালেন। রিপোর্ট থেকে জানতে পারলাম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ছয়জন রাষ্ট্রদূতকে তিরস্কার করেছেন। রিয়াদে পাকিস্তানি প্রবাসীদের অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি রাষ্ট্রদূতদের কলোনিয়াল মানসিকতা পরিত্যাগ করে আধুনিক সময়োপযোগী সেবা দেওয়ার জন্য উপদেশ দেন। তিনি ভারতীয় কূটনীতিকদের প্রশংসা করে বলেন, ভারতীয় কূটনীতিকরা সক্রিয় বলেই সারা বিশ্বে নিজস্ব জায়গা করে নিতে পারছে। বিশ্বজুড়ে মহামারী করোনা প্রকোপের মধ্যেও প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী চলতি মের প্রথম ২০ দিনে ব্যাংকিং চ্যানেলে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে, তা গত বছরের পুরো মের অঙ্ককে ছাড়িয়ে গেছে। এই চলতি মের প্রথম ২০ দিনে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১৫৮ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। গত বছরের পুরো মেতে (৩১ দিনে) রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫০ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ। তাই সরকার কালোবাজার থেকে একে মুক্ত করতে বর্তমানে রেমিট্যান্সে শতকরা ২ টাকা লাভ দিচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু যারা শ্রমে-ঘামে এ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসে তাদের সেবার মানটা যথাযথ হওয়া উচিত। প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভালো থাকলে বাংলাদেশও ভালো থাকবে। কারণ তাদের পাঠানো অর্থেই হাসি ফুটছে দেশে থাকা তার স্বজনের মুখে। প্রবাসীদের সব ধরনের সমস্যায় সরকারি সহায়তা থাকবে এমনটাই প্রত্যাশা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর