মঙ্গলবার, ১ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ

চেষ্টা করি মহানন্দে বুক ভরে শ্বাস নিতে, জীবনের পরম সার্থকতা খুঁজতে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। বাঁচব কি মরব এক মুহূর্ত ভাবিনি। যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম অত্যাচার, মা-বোনের সম্মান-সম্ভ্রম হরণ, যাকে তাকে হত্যা এসব আরও মরিয়া করে তুলেছিল। তাই প্রাণপণ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। সাধারণ মানুষের প্রার্থনায় আল্লাহর আরশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা মঞ্জুর হয়েছিল। না হলে অস্ত্রবলে আমাদের থেকে হাজার গুণ বলীয়ান পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে বিজয় ছিল অসম্ভব। কোনো অত্যাচারী কখনো আল্লাহর দয়া পায় না, তাই তারা বিজয়ীও হয় না। হয়তো সাময়িক শক্তি দেখায়, অহংকার করে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তেমনটাই হয়েছিল। কিন্তু এখনো কেউ কেউ যখন হানাদার ‘পাক বাহিনী’ বলে বা লেখে তখন ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছা করে। মাঝেমধ্যে রেডিও-টেলিভিশনে পাকিস্তান হানাদার পাক বাহিনী শুনে কত যে খারাপ লাগে বলে বোঝাতে পারব না। এত খুন-খারাবি, এত লুটতরাজ, এত কিছুর পরও হানাদারই যদি ‘পাক’ হয় তাহলে দুই দিন পর মুক্তিযোদ্ধারা তো নাপাক হবে। কাকে কী বলি! হুজুর মওলানা ভাসানী নেই, রাজনৈতিক পিতা বঙ্গবন্ধু নেই, মায়ের মতো বেগম সুফিয়া খালা নেই মোট কথা অভিযোগ জানাবার কেউ নেই। তাই যা চাই না কখনো হয়তো তা-ই পাই, যা চাই তার অনেক কিছুই পাই না। শুনতে চাই ভালো কথা, দেখতে চাই ভালো, কিন্তু তা পাই কই? আর যে কটা দিন বাঁচব মহানন্দে আহ্লাদে আল্লাহ আল্লাহ করে বাঁচতে চাই। কিন্তু না, নির্বিবাদে থাকার কোনো পথ নেই। পদে পদে পলে পলে অস্বস্তি আর অস্বস্তি। সখীপুর থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলাম। পরে ছড়িয়ে পড়েছিল ময়মনসিংহ-জামালপুর-পাবনা-মানিকগঞ্জ-ঢাকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। সেই সখীপুরের মানুষ যখন কান্নায় ভেঙে পড়ে বিচার চায় তখন সাড়া না দিয়ে পারি না। দেহ ছুটে যাওয়ার আগেই মন চলে যায় তাদের মাঝে। অতি সাম্প্রতিক তেমনই একটি ঘটনা। ২০১৫-২০১৬ সাল থেকে গাজীপুর থেকে সখীপুর টাঙ্গাইল হয়ে উত্তরবঙ্গে গ্যাসলাইন যাচ্ছে। খুবই ভালো কথা। আজ তিন-চার বছর যাবৎ পাহাড়ের নির্যাতিত মানুষ বারবার এ গ্যাসলাইন নিয়ে তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে বলছে। সরকার যে ক্ষতিপূরণ দেবে তা একবারের জন্যও এলাকার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করেনি। ইচ্ছামতো জমির দাম ধরেছে। তা-ও ঠিকমতো পরিশোধ করেনি। প্রবাদ আছে, ঘ্যাগের ওপর তারাবাতি। সখীপুর-গাজীপুর-মধুপুর এসব মৌজায় এরশাদ আটিয়া বন অধ্যাদেশ নামে এক জংলি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। এরশাদ গেছেন, খালেদা জিয়া এসেছেন, তারপর নেত্রী শেখ হাসিনা। আবার খালেদা জিয়া, আবার শেখ হাসিনা। এরশাদের সব গেছে। কিন্তু সখীপুরের ২-৩ লাখ মানুষের ওপর আটিয়া বন অধ্যাদেশের সে জুলুম যায়নি। যেমনি সেদিন ব্রিটিশ-পাকিস্তান তাড়িয়ে বাংলাদেশ হাসিলের পরও ১৯২৩ সালের ব্রিটিশ আমলের যুদ্ধকালীন গোপনীয়তা আইনে মামলা দিয়ে সরকারকে অপ্রিয় করতে সাংবাদিক রোজিনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। লাভের মধ্যে শুধু সরকারের বদনাম হয়েছে। তাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তায় আঘাত লেগেছে। ঠিক তেমনি আটিয়া বন অধ্যাদেশের কারণে সবাই জেরবার। একে তো আটিয়া বন অধ্যাদেশের জুলুম, অন্যদিকে জিটিসিএল গ্যাস কোম্পানির আলাদা অত্যাচার। তারা বন বিভাগের সঙ্গে জটিলতা মিটিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর স্টিমরোলার চালিয়েছে। বহুদিন পর জিটিসিএলের এক প্রজেক্ট ডিরেক্টরের সঙ্গে হঠাৎই কথা। আমি আমার জীবনে এ রকম দাম্ভিক বেসামাল উদ্ভট মানুষের কথা শুনিনি। এত ক্ষমতা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট কেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনেরও আছে বলে মনে হয়নি। যেখানে কাজ করার তৎপরতা চালাচ্ছেন সেখানে অন্যদের সঙ্গে আমার নামেও ৭০-৮০ ডিসিমল জমি আছে। জমি অধিগ্রহণের চিঠি পেয়েছি প্রায় তিন বছর। ভদ্রলোকরা বলছেন, জিটিসিএল অধিগ্রহণের সব টাকা ডিসির তহবিলে দিয়ে দিয়েছে। অথচ আমিও টাকা পাইনি। সেদিন গিয়েছিলাম সরেজমিনে ঘটনাস্থল দেখতে। গিয়ে দেখি ঠিকাদাররা যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির। যেমনি একসময় পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালিদের ওপর কামান-বন্দুক নিয়ে হাজির হয়েছিল। টাকাপয়সা না দিয়ে কাজ করবেন কীভাবে জিজ্ঞেস করলে তারা জেলা প্রশাসককে সব টাকা দেওয়া হয়ে গেছে বলে জানান। লোকজন টাকাপয়সা না পেয়ে ঘরবাড়ি, জমি ছাড়বে না, তারা জোর করেই গ্যাসলাইন টানবে। আমি যাওয়ায় লোক জড়ো হয়েছিল। সেখানে ভুক্তভোগী অনেকেই ছিলেন। শুনলাম, অনেকের নামে মামলা দিয়েছে, কয়েকজন জেলে আছে, কয়েকজন ফেরারি। আমি ব্যক্তিগতভাবে বলেছি, আমারও যখন জমি আছে তখন আমাকে এক নম্বর আসামি করে মামলা দিন। কিন্তু গায়ের জোরে জনগণের আপত্তিতে যন্ত্রপাতি নামাবেন না। এতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। তাই গত পরশু প্রায় তিন বছর পর জেলা প্রশাসকের অফিসে গিয়েছিলাম। বিশেষ করে এর আগের জেলা প্রশাসক চলে যাওয়ার পর এই প্রথম যাওয়া। বর্তমান জেলা প্রশাসক আতাউল গনির সঙ্গে প্রথম দেখা। তার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম জিটিসিএল প্রশাসনের সঙ্গে কোনো কথাই বলেনি। তারা জোর করেই গ্যাসলাইনের কাজ চালিয়ে যাবে। কন্ট্রাক্টর হয়তো কোনো শক্তিশালী গ্রুপের লোক। তাদের আচার-আচরণ আমার কাছে ভালো মনে হয়নি। তারা পাহাড় চেনে না, পাহাড়ের মানুষ জানে না। তাই গায়ের জোরে পাহাড় ঠেলতে চায়। ডিসির কাছে শুনলাম, সখীপুর পাহাড়ের আড়াই-তিন লাখ মানুষের শত বছরের পুরনো ঘরবাড়ি, জমিজমা, বাপ-দাদার কবর আটিয়া বন অধ্যাদেশের কারণে নষ্ট হওয়ায় জেলা প্রশাসকও এর প্রতিকার চেয়ে মন্ত্রিপরিষদে চিঠি পাঠিয়েছে। সখীপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. জুলফিকার হায়দার কামাল লেবু এবং একজন এডিসির সমন্বয়ে একটি কমিটি করে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু জিটিসিএল তাতে কান দেয়নি। তাদের কাজ তারা গায়ের জোরেই করবে, খুন-খারাবি হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। মনে হয় তাদের গুন্ডাপান্ডাও আছে। প্রজেক্ট ডিরেক্টর শামসুর রহমানের যে আচরণ তাতে তার হাতে ক্ষমতা থাকলে তিনি যে দেশ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি আমার জীবনে এমন ক্ষমতা দেখানো কথাবার্তা টেলিফোনে কোনো দিন শুনিনি। ভালো যোগাযোগ থাকলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তক্ষুনি বলতাম এ রকম সরকারি কর্মচারী থাকা মারাত্মক বিপদ। দেশে এমনিই অশান্তি। তারপর সরকারি কিছু লোক ক্ষমতা দেখিয়ে সে অশান্তি ১০ গুণ বৃদ্ধি করবে তা কখনো সমর্থনযোগ্য নয়। তাই গিয়েছিলাম ডিসির কাছে। ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে বেশ ভালো লেগেছে। তার সঙ্গে কথা বলার সময় তিন এডিসি ছিলেন। তার মধ্যে একজনকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানি এক এডিসি জেনারেল পীরজাদার ভগ্নিপতির মতো মনে হচ্ছিল। ডিসি কাজ বন্ধ রাখতে বলেছেন। এডিসি গিয়ে সরজমিনে তদন্ত করে সিদ্ধান্ত নেবেন। সে সময়ই শুনলাম, কেবিনেট সেক্রেটারিকে এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

কেবিনেট সেক্রেটারি খন্দকার আনোয়ার আমার টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের মানুষ। খুব সম্ভবত কোনরা তার গ্রাম। আমার ছোট ভাই বেল্লালের সঙ্গে বর্তমান কেবিনেট সেক্রেটারি জনাব আনোয়ার লেখাপড়া করেছেন। জনাব আনোয়ারের ছোট ভাই খন্দকার দেলু একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ক্রীড়া সাংবাদিক। আমি নির্বাসনে থাকতে খন্দকার দেলু বেশ কয়েকবার ভারতে গেছে। ইংল্যান্ডেও খন্দকার দেলুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। অসম্ভব মেধাবী ভালো মানুষ। রেজিস্ট্রারি পাড়া রোডের আলম কমিশনার ও হুমায়ুনের ভাগনে। আমি এর অনেক কিছুই জানতাম না। সেই কেবিনেট সেক্রেটারিকে ফোন করেছিলাম উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে। খুব ভালো লেগেছে তার সঙ্গে কথা বলে। এর আগে একবার ছোট বোনজামাই আরিফ আহমেদ দুলালকে পাঠিয়েছিলাম। দুলালের সঙ্গেও অসাধারণ মধুর ব্যবহার করেছিলেন। কখনো বেল্লালের সঙ্গে আমাদের টাঙ্গাইলের বাসায় গেলে ছোটবোন রহিমা অনেক যত্ন করেছে এসব দুলালকে বলেছেন। এ ছাড়া সেতু মন্ত্রণালয়ে সচিব থাকার সময় ব্যক্তিগতভাবে একবারই তার সঙ্গে আমার দেখা ও ১৫-২০ মিনিট কথা হয়েছিল। তাতেও ভালো লেগেছিল। তিনি বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে দেখবেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন, আইনশৃঙ্খলার যাতে কোনো অবনতি না ঘটে সেজন্য যা করার তা তিনি করবেন এসব শুনে বেশ ভালো লাগল। কারণ খারাপ লাগতে লাগতে ভালো শোনার জন্য এত আগ্রহী হয়ে থাকি যা বলার মতো নয়। দু-একবার মনে হয়েছে আমার বোন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমন আর যদি ১০-২০ জন লোক পেতেন তাহলে বোধহয় তাঁর উৎকণ্ঠা অনেক কমে যেত, অনেক জটিলতাও দূর হতো। কী করে এমন লোক পেয়েছেন বা বেছে নিয়েছেন তা তিনিই জানেন। ভালো লোক নিয়ে কাজ করার আনন্দই আলাদা।

কদিন আগে সমুদ্রে এক মারাত্মক নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছিল। যাকে যশ বা ইয়াস বলে অভিহিত করা হয়েছে। ঘূর্ণিটি বাংলাদেশের ওপর আঘাত না হানলেও যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে তাতে পটুয়াখালী-সাতক্ষীরা-বরগুনার বহু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে কোটি কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এখনো পানিতে ডুবে আছে হাজার হাজার লাখ লাখ একর জমি। এখন মিডিয়ার কল্যাণে সহজেই অনেক কিছু চোখে পড়ে। সমুদ্রের পাশে নানা জায়গায় যে বেড়িবাঁধ সেসব কোনো কাজের কথা নয়। খেতের আইলের মতো ৮-১০ ফুট পাশ বাঁধ কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। সমুদ্রের পাড়ে নিচে দেড়-দুই-তিন শ ফুট, ওপরে ৬০-৭০-১০০ ফুট পাশের স্থায়ী বাঁধ হওয়া দরকার। প্রয়োজন হলে বাঁধের ওপর দিয়ে পাকা সড়ক করা যেতে পারে। যেমনটা জামালপুর-তারাকান্দি-ভূঞাপুর যমুনার পাড়ের বাঁধকে করা হয়েছে। তা না করে বছর বছর জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভাঙবে, আর নতুন নতুন বাজেট করা হবে, সেখান থেকে দুই পয়সা আয় হবে এ ফন্দি-ফিকির সাধারণ মানুষের জন্য মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনই এর একটা প্রতিকার হওয়া উচিত।

প্রতিটি দেশের সশস্ত্র বাহিনী তার গৌরব। বহিঃশত্রুর সঙ্গে শুধু যুদ্ধই সশস্ত্র বাহিনীর কাজ নয়। অভ্যন্তরীণ দুর্যোগ-দুর্বিপাকে তাদের কর্মকান্ড দেশের জন্য এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এবার নিম্নচাপের সময় ২৪-২৫ তারিখের দিকে চট্টগ্রাম থেকে পাথরবোঝাই ট্রলার বরিশালের দিকে যাওয়ার পথে ডুবে যাচ্ছিল। ট্রলারের নাবিকদের কান্নায় আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছিল। তাদের জীবনের কোনো আশাই ছিল না। কোনোভাবে খবর পেয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার চরম ঝুঁকি নিয়ে ১২ জন নাবিককে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে। এটা একটা জাতির জন্য গৌরবের, জাতীয় বাহিনীর জন্য চরম গর্বের। যারা এ দুঃসাহসিক কাজ করেছেন, সফলভাবে মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন বিমান বাহিনীর এ অভিযানে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া উচিত। বহুদিন পর বিমান বাহিনীর এ উদ্ধার অভিযানে গর্বে বুক ভরে গেছে। ১৮ কোটি দেশবাসীর পক্ষ থেকে বিমান বাহিনীকে, উদ্ধার অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক অভিনন্দন ও মুবারকবাদ জানাই।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর