মঙ্গলবার, ১ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

চা-কফির যুদ্ধ ও একজন রাজার কাহিনি

সাইফুর রহমান

চা-কফির যুদ্ধ ও একজন রাজার কাহিনি

এই যে আমরা বিদ্রুপ করে বলি, ‘পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়’। ছাগল যদি সবকিছু না-ই খেত তাহলে বোধকরি নিদেনপক্ষে কফি আবিষ্কারে লেগে যেত আরও কিছুকাল। হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই শুনছেন ছাগলই সেই পশু যে কি না কফির কদর সর্বপ্রথম বুঝতে পেরেছিল। সেটা বোধকরি ৮৫০ খ্রিস্টাব্দের কথা। প্রাচীন কিংবদন্তি অনুযায়ী আফ্রিকা মহাদেশের ইথিওপিয়ায় কালদি নামে একজন ছাগলপালক লক্ষ্য করলেন তার ছাগলগুলো ঝোপঝাড়ের ভিতর বেরিজাতীয় এক প্রকার গাছ থেকে ছোট ছোট ফল খাচ্ছে এবং রাতের বেলায় ছাগলগুলো না ঘুমিয়ে সারা রাত শুধু ভ্যা ভ্যা করে। পশুপালক কী করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। ছাগলপালকের বাড়ির পাশেই ছিল সন্ন্যাসীদের একটি মঠ। পশুপালক বেচারা কোনো প্রকার দিশা না পেয়ে প্রতিকারের আশায় ছুটলেন মঠের সেই সন্ন্যাসীদের কাছে। পশুপালক কালদি সবকিছু খুলে বললেন তাদের কাছে। কাপড়ের থলে থেকে কিছু কফি চেরিফল বের করে বললেন, ‘মান্যবর! দেখুন এই সেই বস্তু যা খেয়ে আমার ছাগলগুলো সারা রাত ঘুমোয় না। আমাকেও ঘুমোতে দেয় না। সমস্ত রাত শুধু ভ্যা ভ্যা করে।’ একজন সন্ন্যাসী মুখে বিরক্তির আভা ফুটিয়ে বললেন, ছাগলগুলোকে এসব ফল খাওয়া থেকে বিরত রাখলেই তো তোমার সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।

কালদি মহাশয় কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, ‘মহাত্মন! কী যে বলেন। আমি কি আর সারা দিন ওদের চোখে চোখে রাখতে পারি। একটু চোখের আড়াল হলেই তো ওরা ঝোপঝাড়ে ঢুকে ইচ্ছামতো এ ফল খেয়ে উদর পূর্তি করে।’ সন্ন্যাসীদের মধ্য থেকে একজন পর্যবেক্ষণ করার জন্য আগেই কিছু ফল হাতে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি কফি চেরিফলগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে কালদিকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘দেখ বাছা! তোমার ছাগলগুলো রাতে ঘুমোতে পারছে না এটা তোমার সমস্যা। এতে আমাদের কী করার আছে। তোমার ছাগলগুলো কি তাহলে আমরা চরাব? তাই বলছ? যাও, বাড়ি গিয়ে ছাগলগুলোকে এসব চেরিফল গাছ থেকে দূরে রাখ।’ পাশেই তোলা উনুনে সন্ন্যাসীদের জন্য মধ্যাহ্নভোজের এন্তেজাম চলছিল। সেই সন্ন্যাসী পশুপালক কালদিকে উপদেশগুলো শোনাতে শোনাতে হাতের ফলগুলো সব ছুড়ে মারলেন সেই উনুনের ভিতর। আর ওমনি ঘটল এক চমৎকার ঘটনা। যার জন্য বোধকরি কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। সুন্দর একটা সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। তখনই তাদের মাথায় অভিনব একটি পরিকল্পনা এলো। যেহেতু তাঁদের অর্থাৎ সন্ন্যাসীদের অনেক রাত জেগে প্রার্থনা করতে হয় সেহেতু তারা ভাবলেন এ ফলগুলো রোস্ট করে চুর্ণ করে পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেলে সম্ভবত সমস্ত রাত জেগে প্রার্থনা করা যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সঙ্গে সঙ্গে সেই ফলগুলো ভেজে গুঁড়ো করে পানির সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি হলো ইতিহাসে প্রথম কফি। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। উপরোক্ত কিংবদন্তিটি কিন্তু কফির উৎপত্তির একমাত্র ইতিহাস নয়। বেশ কয়েকটি ইতিহাসের মধ্যে এটিই সবচেয়ে অগ্রগণ্য, বহুল আলোচিত ও জনপ্রিয়। যদিও এ কিংবদন্তিটি সম্পর্কে আমার অনুভূতি অবিমিশ্র। কারণ কফির এ ইতিহাসটি লেখা হয়েছিল প্রায় ৮০০ বছর পর অর্থাৎ ১৬৭১ সালে। কফি জন্মের এ ইতিহাস কিন্তু ইথিওপিয়ায় শত শত বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে। আমার কদাচিৎ মনে হয় এ ঘটনা যদি সত্যি না হতো তবে ছাগলপালকের নাম যে কালদি সেটাই বা কী করে এলো? মজার বিষয় হচ্ছে, এখনো পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট কফি উৎপন্ন হয় ইয়েমেন ও ইথিওপিয়াতেই। ইথিওপিয়ায় জন্ম নেওয়া কফি গাছ থেকে পাওয়া কফিকে বলা হয় অ্যারাবিকা। এ ধরনের কফি সাধারণত মিহি, হালকা ও সুবাসযুক্ত হয়। এ জাতের কফির দামও অপেক্ষাকৃত বেশি এবং বিশ্বের প্রায় ৭০% কফিই এ জাতের। স্বাদে কিছুটা তিতকুটে এবং অতিরিক্ত ক্যাফেইন-সমৃদ্ধ আর এক ধরনের কফি হলো রোবাস্টা। এ ধরনের কফি সাধারণত ইনস্ট্যান্ট কফি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু এলাকা এবং ব্রাজিলে সাধারণত এ ধরনের কফি জন্মায়।

এবার চা কীভাবে মানুষের ভোজ্য তালিকায় এলো সে বিষয়ে কিছু বলা যাক। আমি সাত-আট বছর আগে বাংলাদেশ প্রতিদিনে একটা লেখা লিখেছিলাম ‘চা পানে নাহি দোষ চা করে চিত্তপরিতোষ’ শিরোনামে। লেখাটি পাঠকমহলে বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। সে লেখাটিতে আমি চায়ের উৎপত্তির ইতিহাস তুলে ধরেছিলাম। সে যাই হোক, অনেকে হয়তো সে ইতিহাস ভুলে গিয়ে থাকতে পারেন এজন্য এখানে সে কাহিনি পুনরায় বিদিত করছি।

পৃথিবীতে চা পানের সূত্রপাত কীভাবে ঘটেছিল সে বিষয়ে চীনে একটি মিথ ও কিংবদন্তি চালু আছে। যিশুখ্রিস্টের জন্মের ২৭৩৭ বছর আগে চীনের বিখ্যাত সম্রাট শেন নঙ যিনি চীনা ওষুধ ও কৃষি ক্ষেত্রে বিপুল বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, একবার জনগণের উদ্দেশে একটি ফরমান জারি করলেন যে শরীর সুস্থ ও ভালো রাখতে তার রাজ্যের প্রজারা দিনে অন্তত এক পেয়ালা গরম পানি পান করবেন। সন্দেহ নেই রাজা শেন নঙ নিজেও সে অনুশাসন মেনে চলতেন পুঙ্খানুপুঙ্খ। একদিন ঝোড়ো বাতাসে দূরের চা গাছ থেকে কয়েকটি পাতা উড়ে এসে পড়ল রাজার গরম পানির পেয়ালায়। অমনি সেই পানির রং, স্বাদ ও গন্ধ গেল সম্পূর্ণ বদলে। রাজা শেন নঙ অভিভূত হলেন সেই পানীয় পান করে। এর পর থেকে তিনি নিয়মিত পান করে গেলেন সেই চায়ের পাতাযুক্ত পানীয়। পরে অবশ্য চা নানা রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।

চা ও কফির মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে কোনো যুদ্ধ না চললেও ভিতরে ভিতরে কিন্তু একটি শীতল যুদ্ধ সব সময়ই বিরাজমান। চা-পায়ীরা ভাবেন চা-ই উৎকৃষ্ট। চা-ই সেরা। সেসব মানুষের ছুটির দিনে ঘুম ভাঙে ধোঁয়া-ওঠা এক কাপ চায়ের সুঘ্রাণে। প্রাতরাশ শেষ করে আরও একবার ভালো করে দুধ-চিনি দিয়ে এক পেয়ালা চা। বিকাল গড়াতেই জম্পেশ আড্ডা বসে। তর্ক জমে। সঙ্গে চায়ের কাপের টুংটাং শব্দে চা-প্রেমীরা মেতে ওঠেন চা পানে। সকালবেলায় প্রথম প্রহরেও পাড়া-মহল্লায় ও গ্রামেগঞ্জে চায়ের দোকানে বেজায় ভিড়। কারও লেবু চা, কারও লিকার চা, কারও আবার দুধ চা। এই হলো নিত্যদিনের মানুষের জীবনে চা জড়িয়ে থাকার গল্প। এই যে চা-প্রেমীরা দাবি করছেন চা-ই শ্রেষ্ঠ। এর পেছনেও কিছু কারণ আছে। পরিসংখ্যান বলছে, এ পৃথিবীতে পানির পরে দ্বিতীয় জনপ্রিয় পানীয় হচ্ছে চা। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীজুড়ে চায়ের মার্কেট ভ্যালু ৩৮.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

অন্যদিকে যেসব ভোক্তা কফি পান করেন তাদের দাবি চায়ের চেয়ে কফিই শ্রেষ্ঠ। কফি পানকারীরা সাধারণত আটপৌরে জীবনযাপন থেকে একটু আলাদা। তারা কেতাদুরস্ত ও অভিজাত। শহরের চাকচিক্যময় ও অভিজাত কফিশপে বসে তারা কফি পান করেন। কখনো কখনো তাদের দেখা যায় কফিশপের এক কোণে কম্পিউটারে বসে কাজ করতে করতে কফি পেয়ালায় চুমুকের পর চুমুক দিয়ে কফি পান করতে। তাদের দাবি, এ পৃথিবীতে কফি-ই শ্রেষ্ঠ। তাদের যুক্তিও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কারণ ব্রিটিশ কফি অ্যাসোসিয়েশনের মতে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় কফি। প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ২০০ কোটি কাপ কফি পান করা হয়। কিন্তু সমীকরণটা কি আসলেই এত সহজ? বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুটি দেশ ভারত আর চীন কফির চেয়ে চাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। আমেরিকা আর ইউরোপের মূল ভূখন্ডে কফি জনপ্রিয়। তবে এশিয়া মহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে আর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে চা-ই এখনো বেশি সমাদৃত।

রাশিয়ার প্রসঙ্গ যেহেতু এলোই সেজন্য বলছি, ১৯০০ সালের প্রথম দিকে রাশিয়ায় ধোঁয়াটে স্বাদের এক ধরনের চা ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সে চায়ের নাম ছিল ‘রাশান ক্যারাভান টি’। রুশদের কাছে বেশির ভাগ চা পৌঁছাত চীন থেকে রাশিয়ার পথে ক্যারাভান রুটে। উটের কাফেলা মাসের পর মাস ধরে ভ্রমণ করে মহাদেশজুড়ে চা বহন করে চলত। তাদের রাতের ক্যাম্প-ফায়ারের ধোঁয়া চায়ের ওপর পড়ত এবং যতক্ষণে তারা মস্কো কিংবা সেন্ট পিটার্সবার্গ পৌঁছাত চা পাতাগুলোয় এক ধরনের ধোঁয়াটে স্বাদ তৈরি হতো আর সেখান থেকে তৈরি হওয়া সেই চায়ের স্বাদ যা আজকের দিনে রাশান ক্যারাভান চা হিসেবে পরিচিত।

যা হোক, যে কথা বলছিলাম সেখানে ফিরে আসি। ভূগোলবিদ ডেভিড গ্রিগ তাঁর ২০০৬ সালে প্রকাশিত এক প্রকাশনায় উল্লেখ করেন, চা ও কফির এ দ্বন্দ্ব মেটাতে ওজন দিয়ে নয়, কত কাপ চা বা কফি পান করা হলো সেই বিবেচনায় হিসাব করা প্রয়োজন। তাঁর মতে তুলনাটা করা উচিত কত লিটার চা বা কফি পান করা হলো সেই হিসাবে। কারণ ওজনের হিসাবে প্রতি বছর পৃথিবীতে যে পরিমাণ চা পান করা হয় তার চেয়ে প্রায় ৮০% বেশি কফি পান করা হয়। মানে এক কাপ চা বানাতে ২ গ্রামের মতো চা-পাতা প্রয়োজন হলেও এক কাপ কফি বানাতে প্রায় ১০ গ্রাম কফিবীজ প্রয়োজন হয়। এ হিসাব অনুসারে তাঁর মতে এক কাপ কফির সমানুপাতিক হতে পারে তিন কাপ চা।

অনেকে হয়তো ভাবছেন চা-কফির মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কীসের এত যুদ্ধ? কীসের এত বাদানুবাদ। তাদের উদ্দেশে বলছি, চা-কফিকে মোটেও তুচ্ছ করে ভাববেন না ভায়া। ইতিহাসে অন্তত দুটি বড় ঘটনা ঘটেছিল এ চা-কে কেন্দ্র করে। আমেরিকার জনগণ এই যে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভ করে সে যুদ্ধ কিন্তু প্রথম শুরু হয়েছিল এ চা-কে কেন্দ্র করেই। চায়ের ওপর অতিরিক্ত করারোপের জন্যই ১৭৭৩ সালে আমেরিকার বোস্টন শহরের অধিবাসীরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল। এরপর রাতের অন্ধকারে ব্রিটিশ জাহাজে অভিযান চালিয়ে প্রচুর চা-পাতা তারা ফেলে দেয় সমুদ্রে। তারপর আগুন ধরিয়ে দেয় জাহাজে। এ ঘটনায় ব্রিটিশরাও চটে গিয়ে চড়াও হয় আমেরিকানদের ওপর। তাদের ওপর শুরু করে নির্যাতন-নিপীড়ন আর শুরু হয় আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধ। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সপ্তদশ শতকে চীন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে ভাঙন ধরেছিল এ চা-কে কেন্দ্র করে। ইতিহাসে যা ‘আফিম যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে প্রথম চিড় ধরে আফিমকে কেন্দ্র করে পরে সেটা চা পর্যন্ত গড়ায়।

তাহলে একটু খুলেই বলি। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে চীনে আফিম সেবন মারাত্মক আকার ধারণ করে। আমাদের বাংলাদেশে বর্তমানে যেমন ইয়াবা ড্রাগটি মহামারী আকার ধারণ করেছে সে রকম। আসলে সে রকম বলাটা ঠিক হলো না। সে সময় চীনে আফিম সেবনের ভয়াবহতা ছিল ইয়াবা সেবনের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। চীনে তখন যত্রতত্র দেখা যেত মানুষ আফিম খেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছে। আর এ আফিম ব্রিটেন রপ্তানি করত চীনে। ব্রিটেনে কিন্তু আফিম উৎপন্ন হয় না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত থেকে আফিম রপ্তানি করত চীনে। তো হয়েছে কি, এ দুরবস্থা দেখে চীনের কর্তাব্যক্তিরা আফিম নিষিদ্ধ করে দিলেন। ভারত থেকে বন্ধ হয়ে গেল আফিম রপ্তানি। কিন্তু বাংলা, বিহার ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে এই যে শত শত টন আফিম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উৎপাদন করত এগুলো তারা কী করবে। আমরা সবাই জানি ব্রিটিশ জাতি সে সময় ছিল অতি ধুরন্ধর প্রকৃতির। তারা কলকাতা থেকে সিকিম হয়ে স্মাগলারদের মাধ্যমে আফিম পাঠাতে লাগল চীনে। আর চীন এটা বুঝতে পেরে ব্রিটিশের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ব্রিটেনে চা রপ্তানি বন্ধ করে দিল। আর এতেই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলো।

চীন তো ব্রিটিশের মুখে ছাই দিয়ে তাদের চা খাওয়া বন্ধ করে দিল। এখন লালমুখো ইংরেজরা চা কোথায় পায়! আগেই বলেছি তারাও ধূর্ত কম নয়। বিশ্ববাণিজ্য সে সময় নিয়ন্ত্রণ করত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তারা একজন স্কটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী রবার্ট ফরচুনকে নিয়োগ করল যিনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদেশি বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ এবং সেগুলো অভিজাতদের কাছে বিক্রির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর ওপরই দায়িত্ব পড়ল গোপনে চীনে গিয়ে সেখান থেকে ভারতে চা গাছ পাচারের। উদ্দেশ্য, ভারতে বিকল্প একটি চা-শিল্প গড়ে তোলা। আশ্চর্যজনকভাবে তিনি নিজে ও লোক মারফত চীন থেকে প্রায় ২০ হাজার চা গাছ ও চারাগাছ দার্জিলিংয়ে পাচার করেছিলেন।

এবার কফির গুরুত্বের কথা কিছু বলা যাক। কফিকে মোটেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বিশ্ববিখ্যাত দুজন ফরাসি লেখক কফি খেতেন পাগলের মতো। রুটি-পনির না হলেও তাঁদের চলত কিন্তু কফি ছাড়া তাঁদের একদন্ড বাঁচার উপায় ছিল না। তাঁদের একজন প্রাতঃস্মরণীয় লেখক বালজাক, অন্যজন বিশ্ববিখ্যাত লেখক, চিন্তাবিদ, দার্শনিক ভলতেয়ার। ইতিহাস বলছে, তাঁরা দুজনই নাকি প্রতিদিন গড়ে ৫০ কাপ করে কফি পান করতেন। ঘরে কফি নেই তো লেখাও বন্ধ। বালজাক অর্ধেক বেলা হেঁটে কফির দোকান থেকে নিয়ে আসতেন উৎকৃষ্ট টার্কিশ কফি। অন্যদিকে কফি-ই সেই বস্তু যা ব্রাজিলকে একবার অলিম্পিকে পাঠিয়েছিল। কি, আমার এ কথাটি দুর্বোধ্য লাগছে! আচ্ছা তাহলে খুলেই বলি। ১৯৩২ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আসর বসেছিল আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে। কিন্তু ৬৯ জন দৌড়বিদের লস অ্যাঞ্জেলেসে পাঠানোর মতো অর্থ ছিল না সে সময় ব্রাজিল সরকারের। কী আর করা, ৫০ হাজার কফির বস্তা নিয়ে একটি জাহাজ বিভিন্ন বন্দর ঘুরে শেষে যাবে লস অ্যাঞ্জেলেসে। ব্রাজিল সরকার সেই ৬৯ দৌড়বিদকে তুলে দিল সে জাহাজে। কফি না হলে সেবার নিশ্চয়ই সেসব দৌড়বিদের অলিম্পিকে যোগ দেওয়াই সম্ভব হতো না।

এবার জানা যাক কফি ও চায়ের মধ্যে সবচেয়ে দামি কোনটি। ‘সিভেট’ নামের স্তন্যপায়ী এক ধরনের বিড়াল (যেটা বাংলাদেশে গন্ধগোকুল নামে পরিচিত) ও হাতি- পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কফি এ দুই প্রাণীর পরিপাকতন্ত্র হয়ে মানুষের কাছে পৌঁছায়। ‘কোপি লুয়াক’ এক ধরনের কফি যা সিভেট নামক ইন্দোনেশিয়ান এক ধরনের স্তন্যপায়ী বিড়ালের বিষ্ঠা থেকে তৈরি হয়। বিড়ালের পরিপাকতন্ত্র দিয়ে যাওয়ার সময় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কফি চেরি গাঁজানো হয়, পরে সেগুলো সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়। সিভেট নামক বিড়ালের বিষ্ঠা থেকে তৈরি কফি পৃথিবীর অন্যতম দামি কফিগুলোর একটি। ওই ধরনের কফির ১ কেজির দাম হতে পারে ১৪০০ ডলার (প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা) পর্যন্ত। তবে বর্তমানে এ ধরনের কফিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলছে ব্ল্যাক আইভরি কফি। হাতে আলাদা করা কফি চেরিগুলো খাওয়ার পর থাইল্যান্ডের হাতিদের বিষ্ঠা থেকে তৈরি হয় এ জাতের কফি। ব্লেক ডিঙ্কিন নামের একজন কানাডিয়ান আবিষ্কার করেছিলেন এই ব্ল্যাক আইভরি কফি। যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫ গ্রাম ব্ল্যাক আইভরি কফির মূল্য ৮৫ ডলারের কাছাকাছি।

একটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। চা যতই আটপৌরে ও তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের পানীয় হোক না কেন দামের দিক দিয়ে কিন্তু পৃথিবীতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট চা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্লেন্ডের কফির চেয়ে ঢের বেশি দামি। এ দুনিয়ায় সবচেয়ে উৎকৃষ্ট চায়ের নাম ডা-হোং পাও (Da-Hong Pao). অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, এর প্রতি কেজির দাম ১.২ মিলিয়ন ডলার। এ চা চীনা সরকার কর্তৃক জাতীয় সম্পদ হিসেবে গৃহীত। মিং ডাইনোস্টির সময় থেকে বিশেষ এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ চা উৎপাদন হয়ে আসছে। বিশেষ প্রক্রিয়াটা যে কী তা এখনো সাধারণ মানুষের অজানা। সেই মিং ডাইনোস্টির সময় থেকে চীন এখন পর্যন্ত এ সূত্র গোপন রেখেছে।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামি চায়ের নাম পান্ডা ডাং (Panda Dang Tea). বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘পোবর’। গরুর বিষ্ঠা যদি হয় গোবর তাহলে পান্ডার বিষ্ঠাকে তো পোবর-ই বলা যায়। কি বলেন, তাই না? এ চায়ের প্রতি কেজির মূল্য ৭০ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০ লাখ টাকা। উপরোক্ত আলোচনায় আমরা যেমন দেখেছি সিভেট ও হাতির বিষ্ঠা থেকে উৎকৃষ্ট কফি তৈরি হয়। পান্ডা ডাং চা কিন্তু সরাসরি পান্ডার বিষ্ঠা থেকে তৈরি হয় না। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না পান্ডা সাধারণত কচি বাঁশ খায়। পান্ডা তার ভোজ্য খাদ্য থেকে মাত্র ৩০ শতাংশ পুষ্টিই গ্রহণ করে বাকি ৭০ শতাংশই থেকে যায়। চা উৎপাদনকারীরা সেই পান্ডার বিষ্ঠা সংগ্রহ করে সেগুলো চা গাছের গোড়ায় সার হিসেবে ব্যবহার করে। আর এ সার থেকে উৎপাদিত চা-ই এ দুনিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎকৃষ্ট চা হিসেবে মানুষ পান করে। প্রতি কাপ ২০০ ডলার।

লেখাটি শেষ করব আজব এক চাখোর রাজার গল্প শুনিয়ে। প্রাচীনকালে চীনে ও মিসরের ফারাও সম্রাটরা মৃত্যুবরণ করলে তাদের সমাধিতে অনেক মূল্যবান নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও তৈজসপত্র দিয়ে দেওয়া হতো। কারণ সে সময় তাঁরা বিশ্বাস করতেন তাঁরা এক জীবন থেকে অন্য জীবনে প্রবেশ করছেন। সেখানে এ জিনিসপত্রগুলো না হলে তারা দিনাতিপাত করবেন কীভাবে। সেটা ১৪১ খ্রিস্টপূর্বের কথা। সে সময় চীনে ক্ষমতায় ছিলেন হান ডাইনেস্টির সম্রাট জিং ডি (Jing Di). তাঁর চা এতটাই পছন্দ ছিল যে তিনি ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা পান করতেন। একদিন তিনি তাঁর সমস্ত রাজ অমাত্য ও পারিষদকে ডেকে বললেন, আজ তোমাদের একটি বিষয় জানিয়ে যেতে চাই। আমার মৃত্যু ঘটলে আমার সমাধিতে যা দেওয়ার সে তো দেবেই কিন্তু বেশি করে উৎকৃষ্ট চা দিতে ভুলো না যেন। সম্রাট আরও বললেন, আমার অন্য কিছু না হলেও চলবে কিন্তু চা ছাড়া আমার একদন্ডও বাঁচার উপায় নেই। মৃতের সমাধিতে চা দেওয়ার প্রচলন সম্ভবত এই সম্রাটের হাত ধরেই হয়েছিল। কারণ পরবর্তীকালে মধ্য চীনের ইয়াং লিং সমাধিস্তম্ভে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যেসব নৈবেদ্য দেওয়া হতো তার মধ্যে পাতা দিয়ে তৈরি শুকনো কেক দেখা যেত। এসব পাতার মধ্যে থাকা ক্যাফেইন ও থিয়ানিন প্রমাণ করে সেগুলো প্রকৃতপক্ষে ছিল চা পাতা যা মৃতদেহের সঙ্গে দেওয়া হতো তাদের পারলৌকিক ক্রিয়ার অনুষঙ্গ হিসেবে।

 

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

ইমেইল :   [email protected]

সর্বশেষ খবর