শনিবার, ৫ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

কবরী আপা

ফরিদুর রেজা সাগর

কবরী আপা

কচি-কাঁচার মেলা তখন দেশজুড়ে সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি কচি-কাঁচার মেলার আহ্‌বায়ক। মেলা তখন প্রচুর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আমি তখন নানা কাজে জীবন-জীবিকার জন্য খুব ব্যস্ত থাকি। টেলিভিশনে অনুষ্ঠান। পত্রিকায় লেখালেখি, খাবার-দাবার মাত্র শুরু হয়েছে। আমাকে ছুটে বেড়াতে হয়। তারপর সংসারের অনেক দায়িত্ব আমার ওপর। তাই দাদাভাই কখনো আমার ওপর মনঃক্ষুণ্ণ হতেন না। রাগ করতেন না। কিন্তু কাজের পরে ইত্তেফাক অফিসে বা কচি-কাঁচার মেলা অফিসে ছুটে যেতাম। সন্ধ্যার পর মেলা অফিসে নানা কাজ করতাম।

মনে আছে, একবার ঠিক হলো প্রতিবারের মতো মেলার ভাইবোন মিলে পিকনিকে যাওয়া হবে। কেউ একজন জাহাজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। আমরা এক শীতের সকালে ঢাকা থেকে চাঁদপুর যাব। তারপর আবার ঢাকায় ফিরে আসব। আমরা মহাখুশি। একপর্যায়ে শুনলাম, এবার পিকনিকে আমাদের সফরসঙ্গী হবেন বিখ্যাত নায়িকা কবরী। শুনে আমরা মহা আনন্দিত। কবরীর সঙ্গে বাবু সাহেবও (শফিউদ্দিন সারওয়ার) যাবেন। তিনি তখন কচি-কাঁচার মেলার নারায়ণগঞ্জ শাখার সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত। বাসায় ফিরে যেই না বলেছি নায়িকা কবরী পিকনিকে যাবেন। শুনে কণা রেজা লাফ দিয়ে উঠল। এক বাক্যে বলল, আমিও যাব পিকনিকে। কবরী আমার প্রিয় নায়িকা। তাঁর সঙ্গে কথা হবে। দারুণ ব্যাপার।

আমি হইচই করে কিছু বললাম না। কারণ কবরী আমারও প্রিয় নায়িকা। সুতরাং, আবির্ভাব, সাত ভাই চম্পা, নীল আকাশের নিচে, রংবাজ, ময়নামতি, তিতাস একটি নদীর নাম, সারেং বৌ, সুজন সখী- কতসব বিখ্যাত ছবির নায়িকা তিনি। কে তাঁর ভক্ত নয়! এর পরও কবরী আমার অন্যতম প্রিয় ব্যক্তি। তিনি একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে কবরী জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য পুরো ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছেন। যথারীতি নির্দিষ্ট দিনে আমরা সদরঘাট থেকে জাহাজে উঠলাম। আমাদের মেলা অফিসের একজন ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিত্ব মোস্তফা সারওয়ার। কাঁচাপাকা চুল। দীর্ঘদেহী। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। তিনি কুমিল্লা মেলার উপদেষ্টা। জাহাজে উঠেই তাঁর সঙ্গে দেখা। মনে মনে ভাবলাম, উনি কী বাবু সারওয়ারের কেউ হন?

প্রশ্ন করলাম, আপনি কি তাঁর ভাই?

মোস্তফা সারওয়ার ভাই একগাল হেসে বললেন, ‘আজ সবাই আমাকে এ প্রশ্ন করবে। আমি জানি।’ উনি বললেন, ‘এসো আমার সঙ্গে। পরিচয় করিয়ে দিই তোমাদের সঙ্গে।’ কণা রেজা কবরীকে দেখে মুগ্ধ। তারপর গড়গড় করে বলতে লাগল কী কী সিনেমা দেখা হয়েছে। সব শুনে কবরী মিষ্টি করে হাসতে লাগলেন।

আমিও উচ্ছ্বাসভরে নানা কথা বলতে লাগলাম। কবরী অতি অমায়িকভাবে বললেন, ‘তোমরা একদিন বাসায় এসো। তোমাদের সঙ্গে গল্প হবে।’ দুপুরে খাওয়ার সময় কবরী আপা কণাকে পাশে ডেকে নিলেন। চ্যানেল আই শুরু হওয়ার পরই যুক্ত হয়ে গেলেন। তিনি আমাদের নানা ইভেন্টে অতিথি হিসেবে আসতেন।

এমনকি চ্যানেল আই লাক্স পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ডে বেশ কয়েকবার আমাদের সঙ্গে দুবাই গিয়েছেন। মঞ্চে পারফর্ম করেছেন।

সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনেক অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকতেন। মনে পড়ে, একটা গানের অনুষ্ঠানে তিনি নায়ক রাজ্জাকের পাশে বসলেন। গান শুনলেন। এমনকি তাঁদের একটা বিখ্যাত গানে লিপসিং করেছেন। উল্লেখ্য, তার আগে কিছুদিন ধরে রাজ্জাক-কবরী একসঙ্গে অভিনয় করা ছেড়ে দিয়েছেন। দুজন দুই মেরুতে তখন থাকেন। কিন্তু ‘তুমি যে আমার কবিতা’ গানটিতে লিপসিং করতে গেলেন। তাঁরা পরস্পর হাত ধরে শট দিলেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। তারপর রাজ্জাক-কবরী ছবি করেন একসঙ্গে। কবরীর প্রথম পরিচালিত ছবি ‘আয়না’। অঞ্জন চৌধুরী প্রযোজিত। পরে ছবিটি ইমপ্রেসের ঘরে আসে। কত স্মৃতিই না মনে পড়ে কবরী আপার সঙ্গে। আয়না ছবি করতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘যে কোনো উপায়ে হোক সুভাষ দত্তকে এ ছবিতে অভিনয় করাতে হবে। কারণ সুভাষ দত্ত আমার প্রথম গুরু।’ এবং তিনি ঠিকই গুরুকে একটি দৃশ্যে অভিনয় করিয়েছিলেন।

একবার দিল্লি গেলাম কবরী আপার সঙ্গে। তখন তিনি মাননীয় সংসদ সদস্য। তিনি আমাদের দলনেতা। দিল্লিতে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। আমরা সেখানে যাচ্ছি। এয়ারপোর্টে এসে দেখা গেল কবরী আপার ভিসা শেষ হয়ে গেছে দুই মাস আগে। তিনি খেয়াল করেননি। শিল্পীসুলভ ভুলোমন। কবরী আপা ছিলেন খুবই সরল। সরকারি প্রতিনিধি এবং সংসদ সদস্য। এজন্য ভিসা ছাড়াই তিনি যেতে পারলেন। সে যাত্রা তিনি ভারতে প্রবেশের অধিকার পেলেন। সরকারি বিশেষ ব্যবস্থায় তিনি দিল্লি চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিলেন। ছিলেন জাতশিল্পী। তাই ছিলেন খুব উদাসী ও ভুলোমনের মানুষ। কিছুদিন ধরে কবরী আপা বলতেন, ‘সাগর! আমি একটা ছবি বানাতে চাই। তুমি হবে প্রযোজক।’

আমি বললাম, রাজি। গত বছর ‘এই তুমি সেই তুমি’ চিত্রনাট্যের জন্য অনুদান পেলেন। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের সঙ্গে যৌথভাবে ছবিটা শুরু করলেন। একদিন আমাদের অফিসে তাঁর সঙ্গে ফিল্ম নিয়ে কথা হচ্ছে। এমন সময় খবর পাওয়া গেল সংগীত পরিচালনার জন্য রুনা লায়লা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। শুনে কবরী আপা খুব খুশি।

তারপর কবরী আপা আমাকে সুধালেন,

‘সাবিনা ইয়াসমিন কি সংগীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন?’

আমি বললাম, না। তবে আপনার সাম্প্রতিক ছবিতে তাঁকে নিতে পারেন।

‘সাবিনা ইয়াসমিন কাজ করবেন?’

আমাদের সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার আযম বাবু বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই করবেন। জাহাঙ্গীর সাঈদ আছে, ও ম্যানেজ করে ফেলবে।’ কবরী আপা রাজি হলেন। ফিল্মের কাজ শুরু হলো। এ প্রসঙ্গে আরেকটি গল্প মনে পড়ছে। সাবিনা ইয়াসমিন ‘রংবাজ’ ছবিতে কবরীর কণ্ঠে সেই বিখ্যাত গানটি গান। ‘সে যে কেন এলো না, কিছু ভালো লাগে না...’। গানটির শুরুতে ‘ধ্যাততারিকা’ একটা শব্দ আছে। সেই শব্দটি খুব বিখ্যাত হয়। কিন্তু গল্পটা হচ্ছে, কবরীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে সাবিনা ইয়াসমিন ধৈর্যহারা হন। তারপর গানের শুরুতে ‘ধ্যাততারিকা’ বলেছিলেন। গল্পটি শোনাতেই কবরী আপা হেসে উঠলেন।

দেশজুড়ে করোনার লকডাউনও শুরু হলো। চারদিকে মহামারীর আতঙ্ক। পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠল। কিন্তু অকুতোভয় কবরী আপা একদিন গান রেকর্ডিং করতে করোনার মধ্যে চ্যানেল আই স্টুডিওতে এলেন। সংগীত নিয়ে কাজ হবে। শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনকেও নিয়ে আসা হলো। কবরী আপা আমাকে ফোন দিলেন। বললেন,

‘সাগর! তুমি না এলে কী করে হয়?’ তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। বাঙালির স্মৃতিতে আপনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চ্যানেল আই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর