রবিবার, ৬ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

কৃষি ও কৃষকের বাস্তবতা এবং জাতীয় বাজেট

শাইখ সিরাজ

কৃষি ও কৃষকের বাস্তবতা এবং জাতীয় বাজেট

তখন জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব পাঠ করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। দেশের ৫০তম জাতীয় বাজেট। চ্যানেল আই সরাসরি সম্প্রচার করছে। অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম বাজেট অধিবেশন। বাজেটে আমার মূল আগ্রহের জায়গা কৃষি। ভাবছিলাম দেশের কৃষকও কি আজ গভীর আগ্রহ নিয়ে বাজেটে তাদের জন্য কী আছে না আছে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে! মনে পড়ে গেল আজ থেকে ১৬ বছর আগে ২০০৫ সালে যখন প্রথম শুরু করি প্রাক-বাজেট আলোচনা ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’, তখন মানিকগঞ্জের গড়পাড়া মাঠে হাজার তিনেক কৃষকের সামনে প্রশ্ন রেখেছিলাম, বাজেট সম্পর্কে জানেন কে কে? মাত্র চার-পাঁচ জন হাত তুলেছিলেন। সেই চার-পাঁচ জনের উত্তর থেকে বুঝেছিলাম বাজেট সম্পর্কে আসলে তারা তেমন কিছুই জানেন না। বুঝতে পেরেছিলাম প্রান্তিক কৃষকের সিংহভাগই বাজেট সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখেন না। তবে একজন কৃষক বলেছিলেন, ‘আমি সারা বছর কতটুকু আয় করলাম, সেই আয় থেকে কী পরিমাণ ব্যয় করলে পরবর্তী বছরে কোনো ঘাটতি তৈরি হবে না ইত্যাদি মাথায় রেখে সংসার চালানোই মূলত বাজেট। আর রাষ্ট্র চালানোর ক্ষেত্রে বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাবটা জাতীয় বাজেট।’ তিনি তার মতো করেই বাজেট সম্পর্কে তার ধারণার কথা বলেছিলেন। প্রথম বছর দেশের চারটি স্থানে প্রায় ৮ হাজার কৃষকের আলোচনা ও প্রকাশ্য জরিপের মধ্য দিয়ে দেখা যায় দেশের মাত্র ১ শতাংশ কৃষক বাজেট সম্পর্কে সামান্য ধারণা রাখেন। কিন্তু কৃষি খাতে তাদের বরাদ্দ ও প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সম্পর্কে তাদের ধারণা অস্পষ্ট। সাধারণ মানুষ জাতীয় বাজেট নিয়ে গভীর বিশ্লেষণে যায় না, তারা দেখে বাজেটে কোন জিনিসের দাম বাড়ছে আর কোন জিনিসের কমছে। কিন্তু কৃষককে আমি সাধারণ মানুষের বাইরে ভাবতে চাই। কৃষক তো আসলে উদ্যোক্তা। একজন ব্যবসায়ী যেমন বাজেটের কথা মাথায় রেখে ব্যবসার বিনিয়োগ, কৌশল প্রভৃতি নির্ধারণ করেন। একজন কৃষকেরও উচিত বাজেট মাথায় রেখে পরবর্তী বছরের কৃষিকৌশল নির্ধারণ করা। বাজেট সম্পর্কে কৃষক যদি কোনো ধারণাই না রাখেন তবে তিনি অধিকার-সচেতন হবেন কী করে! খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশে সব পেশাজীবীর সংগঠন থাকলেও এ অর্থে কৃষকের কোনো সংগঠন নেই। কৃষি পেশা ঘিরে রাজনৈতিক যে সংগঠনগুলো আছে, আপনারা লক্ষ্য করলে দেখবেন সেখানে প্রকৃত অর্থে কৃষক আছে কি? ফলে কৃষকের কথা কৃষককেই বলতে হবে। সে উদ্দেশ্যে শুরু করি ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’। আপনারা হয়তো জানেন কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট অনুষ্ঠানটি প্রান্তিক পর্যায়ে প্রাক-বাজেট আলোচনা, যা মূলত একটি সরেজমিন ও বৈঠকী জরিপকাজ। গ্রামের বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ বা মুক্ত আকাশের নিচে কয়েক হাজার কৃষকের মুখ থেকে তার সমস্যাটির মধ্য দিয়ে সামগ্রিক কৃষির সমস্যা, সংকট, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, চাহিদা ইত্যাদি বের করে আনার এক প্রয়াস। রাষ্ট্রীয় নীতি, পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক বিবরণীতে কৃষকের এই বাস্তবসম্মত চিন্তা, সুপারিশ, বঞ্চনা ইত্যাদি উঠে আসুক- এ প্রত্যাশায় এ কাজের সঙ্গে যুক্ত করা হয় দেশের কৃতী অর্থনীতিবিদদের, রাষ্ট্রের কৃষি ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি আমাদের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, যিনি ২০০৯ থেকে শুরু করে প্রতি বছর ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ আলোচনায় উপস্থিত থেকে কৃষকের কথা শুনেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, সরকারের কর্মকর্তা, কৃষকসহ যাদের স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশগ্রহণে আয়োজনগুলো সফল হয়েছে। কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট করতে গিয়ে দেখেছি গ্রামের সাধারণ কৃষক কী অবলীলায় গলা ছেড়ে নিজের সমস্যা, প্রত্যাশার কথা বলে গেছেন উপস্থিত মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সামনে। প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের আগে সরকারের কাছে কৃষকের মাঠপর্যায়ের এই কণ্ঠস্বর লিখিত সুপারিশ ও প্রস্তাব আকারে পেশ করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে করোনার কারণে সবই স্থগিত রাখতে হয়েছে। তবে এ সংকট সময়েও আমি চ্যানেল আইয়ের জেলা প্রতিনিধি, আমার টিম ও সহকর্মীদের নিয়ে সব সময় চেষ্টা করেছি কৃষকের সঙ্গে যুক্ত থাকতে। তাদের সমস্যা, দাবি, প্রত্যাশার কথা জানার চেষ্টা করেছি। ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট। খাতওয়ারি বিশ্লেষণে কৃষিতে এ বছর বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ২৪ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে কৃষিতে বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দ বেড়েছে ২৬৬ কোটি টাকা। মানিকগঞ্জের গড়পাড়া মাঠের কৃষকের কথামতো আয় বুঝে ব্যয়ের প্রশ্নে এ বরাদ্দ হতাশার নয়, বলব আশাব্যঞ্জক। কেননা বাজেটে সর্বোচ্চ ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে কৃষি খাতে। ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ভর্তুকি। সুপরিকল্পনা ও সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাজেটে বরাদ্দ অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশের কৃষি যে সুপরিবর্তনের দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কর্মপরিকল্পনা কাগজে-কলমে যতটুকু অনেক ক্ষেত্রে মাঠে তার প্রভাব সিকিভাগও পাওয়া যায় না। যাই হোক, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ২০.৫৫ লাখ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পরিমাণটা আরও বেশি হওয়া উচিত। আমি যতটুকু জানি সরকারের বর্তমান খাদ্যশস্য সংরক্ষণ ক্ষমতা আছে ১৯.৫ লাখ মেট্রিক টনের। যদিও সরকার বলছে তাদের খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ধারণক্ষমতা ২১.৮০ লাখ মেট্রিক টন। আমি মাঠপর্যায়ে যা দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, খাদ্যগুদামগুলো আধুনিকায়ন করা উচিত এবং শুধু ধান-চাল সংরক্ষণেই সীমাবদ্ধ না থেকে ফসল বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দিয়ে গুদামগুলোকে কৃষকের ফসল সংরক্ষণাগার হিসেবে গড়ে তুলে সংরক্ষিত খাদ্যশস্যের বিপরীতে কৃষিঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আমি আশা করব, বাজেট প্রস্তাবে যে খাদ্যগুদাম সম্প্রসারণের কথা উল্লেখ রয়েছে তা যেন বাস্তবায়ন হয়। সরকার কৃষক থেকে যত বেশি খাদ্যশস্য সংগ্রহ করবে কৃষক তত বেশি লাভবান হবেন এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হবে। এবারের বাজেটে শিল্পায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যে মূল্য সংযোজনে উদ্যোক্তাকে ১০ বছর মেয়াদে কর অব্যাহতি দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ, শাকসবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন ও শিশুখাদ্য উৎপাদন। এ ছাড়া ১০ বছর মেয়াদে কর অব্যাহতি পাবেন কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী উদ্যোক্তাও। এটি কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভালো ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। কৃষকের কৃষিযন্ত্রের ক্রয়মূল্যের ওপর ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সহায়তা একটা বড় ব্যাপার। তবে মাঠে গিয়ে দেখেছি, প্রান্তিক বা ক্ষুদ্র কৃষক এর সুবিধা ঠিক পাচ্ছেন না। দেখেছি কৃষি যন্ত্রপাতিগুলো যারা কিনছেন তারা সাধারণত সেগুলো বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করছেন।  প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী বিদেশি মাংসে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হলে বিদেশি মাংস আমদানি কমবে। এটা খামারিদের অনেক দিনের দাবি। আবার মাশরুম আমদানিতে আমদানি শুল্ক ৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে দেশে মাশরুম চাষের প্রসার হবে। বিদেশ থেকে (মালয়েশিয়া, চীন ইত্যাদি থেকে) যে মাশরুম আমদানি হয় বিশেষ করে বাটন মাশরুম, সেগুলো বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাত করে ক্যানের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। আমাদের দেশে সুপার শপগুলোয় বাটন মাশরুম কখনো কখনো পাওয়া যায়। অল্প সময়ে নষ্ট হয়ে যায় বলে সুপার শপগুলো মাশরুম রাখতে চায় না। তাই মাশরুম চাষ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পেরও প্রসার প্রয়োজন। শিল্প লবণের ওপর কর বাড়ানো হয়েছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। এত দিন শিল্প লবণের নামে ভোজ্য লবণ আমদানি হতো। এতে আমাদের লবণ চাষিরা খুব লোকসানে ছিলেন। কয়েক বছর ধরেই লবণ চাষিদের হতাশা আর ক্ষোভ নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করেছি। আশা করি লবণ চাষিদের সমস্যা সমাধান হবে। বাজেটে মুরগি ও মাছের খাবারের উপকরণ আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতে মুরগি, মাছ ও গবাদি পশুর খাবারের দাম কমানোর সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এর ফল খামারিরা পাবেন কি না। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে যতটুকু বুঝি এ সুযোগের সুফল পান আমদানিকারকরা। খামারি পর্যন্ত আসতে আসতে কিছুই থাকে না। এর চেয়ে সারে যেভাবে ভর্তুকি দেওয়া হয়, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবারের ক্ষেত্রে সেভাবে ভর্তুকির ব্যবস্থা করলে খামারি সরাসরি সুবিধা পাবেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)-এর একটি গবেষণার তথ্যমতে করোনায় দেশের ৬২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছে। ৮৬ শতাংশের আয় কমেছে। খরচ কমিয়েছে ৭৮ ভাগ মানুষ। এর মধ্যে ৫২ শতাংশ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। আবার অনেকের ঋণ বেড়েছে। কেউ কেউ সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছে। তবে আশার কথা, কাজ হারানোদের বড় একটি অংশ কৃষিতে যোগ দিয়েছে। এ সময়ে কৃষি খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। কৃষিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকার সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করি। এবারের বাজেট প্রস্তাবে ৪১টি কৃষক বাজারের উল্লেখ আছে। কৃষকের নিজস্ব বাজার তৈরি হওয়াটা খুব প্রয়োজনীয় ব্যাপার। পাশাপাশি কৃষিপণ্য বিক্রির আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশের কৃষিপণ্য বিক্রির বড় কোনো আন্তর্জাতিক বাজার এখনো তৈরি হয়নি। এর প্রধান কারণ হতে পারে মানসম্পন্ন বিপণন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, ফুডগ্রেড সংরক্ষণ, মানসম্পন্ন প্যাকেজিং এবং আন্তর্জাতিক সরবরাহব্যবস্থায় সংযুক্ত হওয়ার বিপণন ব্যর্থতা। আশা করি এ সংকট থেকে এ অর্থবছরে কাটিয়ে উঠব।

আমি আশাবাদী মানুষ। বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষককে নিয়ে আমার স্বপ্নের শেষ নেই। অসম্ভবকে সম্ভব করার একমাত্র নায়ক আমার দেশের কৃষক। শত প্রতিকূলতার ভিতর থেকেও ঠিকই মাটির বুক থেকে সোনার ফসল ফলিয়ে এনে মিটিয়ে যাচ্ছেন আমাদের খাদ্য চাহিদা। করোনাকালে কৃষক ও প্রবাসী ভূমিপুত্রদের পাঠানো রেমিট্যান্স সচল রেখেছে এ দেশের অর্থনীতি। প্রশ্ন হচ্ছে, বাজেটে আমরা তাদের জন্য কী রেখেছি? তবে অদম্য শক্তি আছে যে দেশের মাটি ও মানুষের, সে দেশের মাটি ও মানুষকে একটু ছায়া, একটু ভরসা দিলে অনুপম এক দিন আমাদের এনে দেবে, এ আমার বিশ্বাস।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। 

[email protected]

সর্বশেষ খবর