মঙ্গলবার, ৮ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

নাগরিক জীবন নিরাপদ করতে যা যা করা দরকার

খায়রুল কবীর খোকন

নাগরিক জীবন নিরাপদ করতে যা যা করা দরকার

কঠিন করোনা পরিস্থিতিতেও রাজধানী নগরীর প্রান্তে আশুলিয়ায় চলন্ত বাসে ছয় দুর্বৃত্ত এক নারীকে ধর্ষণ চালাতে পারে এটা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে! আমরা কোন বর্বর চেঙ্গিস-হালাকু খাঁ যুগে বাস করছি!

ভারতে বছর পাঁচ-ছয় আগে বাসে এক নারী চিকিৎসা-শিক্ষার্থীকে গণধর্ষণ ও হত্যার নির্মম ঘটনাটি সে দেশের জনতার উত্তাল বিক্ষোভে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। সেই দুর্বৃত্তপনার কঠিন কঠোর বিচারকাজও সম্পন্ন হয়েছে, দস্যু-দুর্বৃত্তরা বেশ কঠিন শাস্তিই পেয়েছে। সেই ঘটনা থেকে নতুন দুর্বৃত্তরা যেখানে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের অপরাধবৃত্তির কালো হাত গুটিয়ে নেবে, সেখানে উল্টোটাই ঘটছে আমাদের দেশে। শুধু বাংলাদেশেই সেই ঘটনার পরে বাসে নারীর ওপর যৌন-নিপীড়নের সহিংসতা ঘটেছে ১৫-২০টি এবং এখনো বিরামহীন সেসব নারীপীড়ন চলছে। আর সাধারণভাবে নারীধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক হিসেবে তো ঘটেই চলেছে। আর রাস্তাঘাটে, জনপরিবহনের বাস, মোটর-লঞ্চ, ফেরি-জাহাজ, ট্রেনে তরুণী, যুবা-মহিলারা তো নিরাপদ নয়ই, বয়স্ক নারীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন সর্বদা। ইভ টিজিং শয়তানির তো এতটুকু কমতি নেই কোথাও।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ আর প্রাণহানিতে বিশ্ব মানবসমাজ যেখানে ১৭ মাস ধরে দিশাহারা সেখানে অপরাধপ্রবণতা বেড়েই চলে কীভাবে? এ পরিস্থিতিতে অপরাধীরা দুষ্কর্ম করার এ দুঃসাহস পায় কোথা থেকে? এমনকি যারা ধর্মভীরু এবং পাপকর্মের হোতাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার নিশ্চিত রোষানলকে ভয় পান তারাও তো থেমে নেই নানা অপরাধ সংঘটনে। খাবার ও পানীয় পণ্যে ভেজাল দেওয়া, মানহীন দূষিত খাদ্য ও পানীয় পণ্য তৈরি এবং বাজারজাতকরণ, পণ্যের মাপে ঠকানো, সব পণ্যের কালোবাজারি, চোরাকারবার, এমনকি ওষুধে ভেজাল দেওয়া ও মানহীন ওষুধ তৈরির দ্বারা সেসব বাজারজাত করে মানুষ ঠকানো, ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, এলএসডি, আফিমসহ সব ধরনের মাদকদ্রব্যের চোরাই ব্যবসা করে জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতিসাধন ইত্যাদি সমানে চলছে দেশে। সাধারণ অপরাধ, নারীর ওপরে সহিংসতা, জমিজমা নিয়ে মারামারি, খুনোখুনি তো প্রতিদিনই পত্রিকার পাতা ভরে খবর হয়।

সাধারণভাবে দৈনন্দিন জীবনের নানারকম স্বার্থ আদায় ও ক্ষতির ঘটনায়ও ভুক্তভোগী মানুষের মধ্যে এসব হামলা-মামলা, খুনোখুনি ও অন্যসব অপরাধপ্রবণতা চলে অবিরাম। রাজনৈতিক স্বার্থান্ধতায়ও হানাহানি প্রতিদিন খবর হয় মিডিয়ায়। ক্ষমতাসীন দলের ‘অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, নিরেট-মগজ’ (কখনো বা সার্টিফিকেটধারী অশিক্ষিত) নেতা-কর্মী-সংগঠকদের মধ্যে দলের পদ দখল আর চাঁদাবাজি ও দস্যুতার অর্থের ভাগাভাগি নিয়েও হরদম মারামারি লেগে আছে। তাতেও প্রচুর খুন-জখম হচ্ছে ওইসব লোক। সমগ্র সমাজের মাঝে সুশিক্ষার নিদারুণ অভাব আর রাষ্ট্রের প্রশাসনে সুশাসনের সংকট এসব অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন। এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না বলেই আইনশৃঙ্খলার অবনতির এতটুকু কমতি নেই। মানুষের মধ্যে নিয়তির অভিশাপ, সৃষ্টিকর্তার বিচার এসব ভয়ভীতিও তো কাজ করছে না আজকাল। আইন-আদালতের বিচারের সম্ভাবনাও তো আছে অপরাধীদের জন্য, সেসব তোয়াক্কা করছে না কেন এই দস্যু-ডাকাত দুর্বৃত্তরা? সারা দেশে চুরি, ছিনতাই, দস্যুতা, ডাকাতি, মানুষ অপহরণ ও জিম্মি করে অর্থ আদায়ের মতো দুর্বৃত্তপনা, নারী ও শিশু পাচার এসব খবর তো আমাদের পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলে প্রকাশ পাচ্ছে হরদম। অর্থের লোভে ভাড়া খেটে মানুষ খুন, জমিজমা দখলে প্রতিবাদী-লোকজনকে হত্যা এসব গুরুতর অপরাধ তো কমছেই না।

তা ছাড়া আছে আরও ভয়ানক সাইবার অপরাধ। বিশেষভাবে তরুণী ও যুবা-মহিলাদের (ক্ষেত্রবিশেষ বয়স্ক নারীদেরও) বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে ‘ট্র্যাপ’ করে সুকৌশলে অশালীন ছবি তুলে সেসব দিয়ে পরে ভয়ংকর ব্ল্যাকমেইলিং তৎপরতা চালায়। এসব তরুণী ও যুবা মহিলা স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। কিছু কর্মজীবী নারীও শয়তান তরুণের পাল্লায় বা বয়স্ক দুর্বৃত্তের খপ্পরে পড়ে যায়। পরিবারের লোকজনের মধ্যে সুশিক্ষা ও সচেতনতার অভাবেই এসব অল্পবয়সী কিশোর-কিশোরী, তরুণী, যুবা মহিলা সহজেই অপরাধপ্রবণতার শিকার হয় অথবা নিজেরাই অপরাধ করে অন্যদের অনাচারের শিকার বানায়।

তাই বলা চলে তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অপরাধপ্রবণতার ধরন ও কৌশল পাল্টেছে এবং অপরাধীদের দুর্বৃত্তপনার ক্ষেত্রও বিস্তৃত হয়েছে। সাইবার অপরাধের মাধ্যমে তরুণী ও যুবা মহিলারা ‘ট্র্যাপড’ হয়ে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের দ্বারা ভয়ানক নিষ্ঠুরতার শিকারে পরিণত হন; পাশাপাশি, ওইসব সাইবার দুর্বৃত্তরা ব্যাংকিংয়ের কোষাগারের অর্থ ও অন্যসব অফিসের (বিশেষভাবে সরকারি অফিসের) তহবিলের অর্থ হ্যাকিংয়ের দ্বারা ভয়ংকর ডাকাতির সুযোগ পায়। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তেমন একটা সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। কিন্তু এ সাইবার অপরাধীরা প্রতিদিনই অধিক মাত্রায় শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

এখন প্রশ্ন হলো, অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর শক্তি বৃদ্ধিও তো কম হয়নি। পুলিশসহ এ বাহিনীগুলোর বার্ষিক বরাদ্দও বেড়ে চলেছে প্রতি বছর। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশকিছু উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়েছে, পুলিশের ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুলও তো দীর্ঘকাল কাজ করে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান বিভাগগুলোতেও অপরাধবিজ্ঞান বিষয়ের স্টাডি কাজ কিছু কিছু তো চলেই আসছে। তার পরও অপরাধ দমনের ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সাফল্য খুবই সীমিত কেন? পুলিশ ও অন্যসব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশে সাধারণভাবে অপরাধপ্রবণতা বাড়ার ব্যাপারে একমত- তারা চেষ্টা করছে এসব নিয়ন্ত্রণে রাখার, কিন্তু পারছেন না। কেন পারছেন না? কারণ, একশ্রেণির পুলিশ ও অন্যসব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য অপরাধীদের ধরে ব্ল্যাকমেইলিং কালচারে অর্থ উপার্জনের সীমাহীন লালসায় ডুবে আছে। সেখান থেকে তারা বেরোতেই পারছেন না। তারা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নিজেদের অবসরকালীন ভোগ-বিলাসের নিশ্চয়তা বিধান ইত্যাদিতে ডুবে আছেন, সততার, নিজ কর্তব্যবোধের জীবন তারা হারিয়ে ফেলেছেন।

যেসব উদ্যোগ জরুরি : ১. পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যসব বাহিনীকে দিয়ে শতভাগ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে প্রতিটি নাগরিকের জানমাল-সম্মান-ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের ব্যবহারের চেষ্টা শতভাগ প্রতিরোধ করতে হবে। ২. পুলিশ ও অন্যসব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপযুক্ত বেতন-ভাতা নিশ্চিত করা, পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্টের ব্যবস্থা করা, উপযুক্ত ব্যক্তির যথোপযোগী পদায়ন এবং অভ্যন্তরীণ কঠোর শৃঙ্খলার বাহিনীতে রূপান্তরিত করতে হবে।

৩. প্রতিটি পরিবারে বাবা-মাকে নিজ নিজ সন্তানের বেড়ে ওঠার সময়ে কঠিন কঠোর বিধি অনুসরণ, বিশেষভাবে কিশোর-কিশোরীদের ও তরুণ-তরুণীদের ‘ফ্রিস্টাইল’ জীবনযাপন নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে সব সময় মনোযোগী থাকতে হবে। কোনো কিশোর বা কিশোরী, তরুণ বা তরুণী বাবা-মায়ের অনুশাসনের বাইরে চলে যেতে থাকলে তাদের নিয়ম-শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে পুলিশের বিশেষ সেল কাজ করবে। কিশোর সংশাধন কেন্দ্র ব্যবহার না করেও পরিবারের মধ্যে রেখেই বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তার সুব্যবস্থা সম্ভব। পুলিশ বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্ট শিক্ষক এ বিষয়ে বাবা-মাকে সহায়তাদান করতে পারেন।

৪. এ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ‘প্রক্টোরিয়াল বডি’ থাকবে যারা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আনয়নের ব্যবস্থা কার্যকর রাখবে অবিরাম। সেজন্য এ খাতে উপযুক্ত তহবিলের ব্যবস্থা করা দরকার।

৫. ইউনিয়ন পরিষদ, পঞ্চায়েত কমিটি, এনজিও ও সমাজসেবা সংস্থাসমূহের বিশেষ কার্যক্রম রাখতে হবে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের অপরাধমুক্ত ব্যবস্থপনায় রাখার লক্ষ্যে। এসব সংস্থা সমন্বিত পন্থায় পাড়া ও মহল্লাভিত্তিক কমিটি করতে পারে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে।

৬. বিশেষভাবে মনোযোগী হতে হবে সাইবার-অপরাধের ব্যাপারে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমকে ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফির প্রসারের ফলে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী গোষ্ঠী এবং যুবসমাজকে যৌন বিকারগ্রস্ততা ও যৌন অপরাধে ডুবিয়ে দেওয়ার প্রবণতা প্রতিরোধে পুলিশের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন মিডিয়া এবং চলচ্চিত্রশিল্পকে এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে, যাতে ইভ টিজিং, নারী ধর্ষণ, নারীর ওপর অন্যসব সহিংসতা এবং সাধারণ অপরাধপ্রবণতা কোনোভাবে এসব মিডিয়ার কল্যাণে প্রসার লাভ করতে না পারে।

লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর