মঙ্গলবার, ৮ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

ইসলাম প্রতিটি শিশুকে সুশিক্ষার তাগিদ দিয়েছে

এম. এ. মান্নান

ইসলাম প্রতিটি শিশুকে সুশিক্ষার তাগিদ দিয়েছে

শিশুদের সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী তা ফুটে উঠেছে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহুসংখ্যক হাদিসে। যেমন জনৈক ব্যক্তি রসুল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আমার এই ছেলের অধিকার কী? রসুল (সা.) বললেন, তুমি তার সুন্দর একটি নাম রাখবে, তাকে ভদ্রতা শিক্ষা দেবে এবং তাকে উত্তম স্থানে লালনপালনের জন্য হস্তান্তর করবে। (তৎকালীন সময়ে শিশুকে উন্নত ভাষা শিক্ষাদানের লক্ষ্যে শৈশবকালে উত্তম শিষ্টাচার-সমৃদ্ধ গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হতো)’ আত্তুসি। উপরোক্ত হাদিসে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিশুদের শিক্ষাদানে উত্তম স্থানে লালনপালনের তাগিদ দিয়েছেন। সেই প্রাচীন যুগে মহানবী (সা.) নিজেও তাঁর শিশুকাল কাটিয়েছেন শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে এমন এক সম্প্রদায়ের মাঝে। আজকের যুগে আমরা শিশুদের শিক্ষাঙ্গনে পাঠাই একই উদ্দেশ্যে। পিতা বা অভিভাবকদের ওপর সন্তানের হক সম্পর্কে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পিতার ওপর সন্তানের অধিকার হলো তাকে লেখাপড়া শিক্ষা দেওয়া, সাঁতার শিক্ষা দেওয়া, তীর নিক্ষেপ শিক্ষা দেওয়া এবং তাকে ভালো ও পবিত্র খাবার খাওয়ানো।’ বায়হাকি।

বড়দের কাছ থেকে অর্থাৎ বাবা-মা, অভিভাবক এবং স্বজনদের কাছ থেকে শিশুরা স্নেহ পাওয়র অধিকার রাখে। এটি শিশুদের অধিকার। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না, সৎ কাজের আদেশ করে না এবং অসৎ কাজে নিষেধ করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ ইবনে হিব্বান।

রসুল (সা.)-এর সাহাবিরাও শিশু ও এতিমদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করতেন, যার বর্ণনা বিভিন্ন হাদিসে এসেছে। হজরত নিমরান ইবনে উতবা জিমারি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা উম্মে দারদা (রা.)-এর কাছে গেলাম এবং আমরা ছোট এতিম শিশু ছিলাম। তিনি আমাদের মাথায় হাত বোলালেন এবং বললেন, হে আমাদের সন্তানেরা! তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। আমি আশা করি তোমরা তোমার বাবার সুপারিশকৃতদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ ইবনে হিব্বান। ইসলামে সব মানুষের নিরাপত্তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিশুরা এ বিষয়ে অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে। বিশ্বাসীদের আদি পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর কাছে যে মুনাজাত করেছিলেন সে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে আল কোরআনে। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ কর যখন ইবরাহিম বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! এ শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার শহর বানিয়ে দিন এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে মানে তাদের সব ধরনের ফলের রিজিক দান করুন। উত্তরে তাঁর প্রভু বললেন, আর যে মানবে না, কয়েক দিনের এ জৈব-জীবনের সামগ্রী তাকেও আমি দেব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে জাহান্নামের আগুনে বলপূর্বক নিয়ে যাব এবং তা নিকৃষ্টতম স্থান।’ সুরা বাকারা, আয়াত ১২৬। মানববসতি স্থাপনের জন্য হজরত ইবরাহিম (আ.) তিনটি বিষয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন। ১. সব ধরনের নিরাপত্তা ২. ফলমূল থেকে পুষ্টিকর আহার ৩. ধর্মকর্ম সমন্বয়ে সুশিক্ষার মাধ্যমে আদর্শ মানব হিসেবে গড়ে তোলা। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা ও আদর্শ সমাজ নির্মাণের অনুপ্রেরণার বীজ এখানেই লুক্কায়িত। আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিশুর শিক্ষাদীক্ষা ও অঙ্গীকারের প্রতি যত্নশীল হওয়া প্রত্যেক মোমিনের কর্তব্য হওয়া উচিত। সুরা বাকারার নির্দেশনা অনুসারে প্রতিটি শিশুকে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হবে যেখানে শিশুর শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশের স্কুল হোক আর মাদরাসা প্রচলিত বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে শিশুদের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। অনেক ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের সঙ্গে নির্দয় আচরণ করা হয়। যা তাদের মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলে। যে কারণে শিশুকে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হবে যেখানে ইসলামের নৈতিক শিক্ষায় শিশুকে যেমন দীক্ষা দেওয়া হবে তেমন তার জন্য স্নেহশীল পরিবেশ থাকবে। শিশুর খেলাধুলার প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া হবে। শিক্ষকদের সে দেখবে ভয় নয় শ্রদ্ধার চোখে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্তে আনার সুযোগ থাকবে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সুস্থ-সবল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য থাকবে খেলাধুলা এবং শরীরচর্চার সুযোগ। ইসলামী শরিয়তে সুস্বাস্থ্যকে মহান আল্লাহর নিয়ামত হিসেবে বিশ্বাস করা হয়। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমার শরীরের প্রতি তোমার কর্তব্য ও অধিকার রয়েছে।’ (মুসলিম)। কেন এ অধিকার বা হক? এর জবাবে বলা যায়, শরীর সুস্থ থাকলে একজন মুসলমান ভালোভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে পারে। অসুস্থ শরীরে ইবাদতের বিঘ্ন ঘটে। শিশুরা যাতে পড়াশোনায় উৎসাহী হয়, এটিকে যাতে বোঝা হিসেবে না ভাবে তেমন পরিবেশ তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হয়। যা কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। রসুল (সা.) শিশুদের স্নেহ করতেন। শিশুদের প্রতি যারা নির্যাতন চালায় তারা কোনোভাবেই নিজেদের রসুল (সা.)-এর অনুসারী বলে দাবি করতে পারেন না। শিশুদের ওপর নির্যাতন চালানোর আগে সবাইকে এ বিষয়টি ভাবতে হবে। এ ধরনের অপরাধে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনাও জরুরি।

 

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর