বুধবার, ৯ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

‘হইলে চরিত্র নাশ, সর্বনাশ হয়’

মহিউদ্দিন খান মোহন

‘হইলে চরিত্র নাশ, সর্বনাশ হয়’

আমি তখন ক্লাস ফাইভের ছাত্র। উপজেলা সদর শ্রীনগর বাজারে আমার বাবার দোকানের কাছাকাছি ছিল প্রমথ পোদ্দার নামে এক অতিশয় ভদ্রলোকের বড় একটি দোকান। একদিন বাবা বললেন, তোর প্রমথ কাকার দোকানে আয়নায় বান্ধানো একটা কবিতা আছে। যা লেইখ্যা নিয়া আয়। ধীর পায়ে গেলাম সেই দোকানে। প্রমথ কাকা আমাকে চিনতেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী কাকা, কিছু বলবা? বললাম, কাকা, বাবা ওই কবিতাটি লিখে নিয়ে যেতে বলেছেন। তিনি বললেন, ‘নাও, নাও, লিখে নাও। তবে লিখে নিলেই হবে না, কবিতায় কী বলা হয়েছে তা বুঝতে হবে এবং জীবনের চলার পথে তা মনে রাখবা কাকা।’ আমি কবিতাটি আমার খাতায় লিখলাম। ঠিক কবিতা নয়, কোনো কবিতার অংশবিশেষ। তাতে লেখা ছিল- ‘যদি অর্থ নষ্ট হয়, তায় কী বা আসে যায়/যদি স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, তাতে কিছু হয় ক্ষয়/হইলে চরিত্র নাশ, সর্বনাশ হয়’। আরও অনেক পরে ঠিক একই ভাবার্থের একটি ইংরেজি প্রবচন জেনেছি, ‘মানি লস্ট, নাথিং লস্ট/ হেলথ লস্ট, সামথিং লস্ট/বাট ক্যারেক্টার লস্ট, এভরি থিং ইজ লস্ট’। বাংলা ও ইংরেজি এ প্রবচন দুটির কোনটির সৃষ্টি অগে জানি না। তবে দুটির সারমর্মই এক। কেননা আর্থিক ক্ষতি পরিশ্রম করে পুষিয়ে নেওয়া যেতে পারে। স্বাস্থ্যহানি ঘটলে চিকিৎসা বা ওষুধপথ্য খেয়ে তা পুনরুদ্ধার সম্ভব। কিন্তু যার চরিত্র একবার নষ্ট হয়ে যায় মানুষ হিসেবে সে আর গণ্য থাকতে পারে না।

প্রমথ কাকার দোকানের সেই কবিতাংশটি আমি মোটা কাগজে লিখে আমাদের ঘরে লাগিয়ে রেখেছিলাম। প্রমথ কাকা এবং আমার বাবার অনুশাসনে তখনই আমার মনে এ ধারণা প্রোথিত হয়েছিল যে, মানুষকে যদি মানুষ হতে হয় তাহলে তার চরিত্র ঠিক রাখতে হবে সবার আগে। একজন মানুষের চরিত্রই তার সবচেয়ে বড় সম্পদ। একজন মানুষ তখনই আক্ষরিক অর্থে মানুষ হয়ে উঠতে পারে যখন তার চারিত্রিক গুণাবলি অন্য মানুষদের আকৃষ্ট করে, তিনি হয়ে ওঠেন অন্যদের অনুকরণীয়-অনুসরণীয়। বলা হয়, মানুষ এবং অন্যান্য জীবজন্তুর সঙ্গে প্রধান পার্থক্য হলো বিবেক ও চরিত্র। সৃষ্টিকর্তা এ দুটি গুণ তাঁর সৃষ্টির অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে দেননি, দিয়েছেন তাঁর ঘোষিত ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ মানুষের মধ্যে। পশুপাখিদের কোনো বিবেক নেই, চরিত্র বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ওগুলোর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। গবাদি পশু তার ক্ষুধা মেটানোর জন্য যেখানে তৃণলতা দেখে সেখানেই মুখ দেয়। সেটা ধান খেত না ঘাস খেত তা বিবেচনা করে না। পাখিরাও তাই করে। ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে শস্য খেতে বসে সাবাড় করে শস্যদানা। মালিকের তাতে ক্ষতি হলো কি না তা ভেবে দেখে না। ক্ষুণ্ণিবৃত্তিই ওদের প্রধান লক্ষ্য। কোনটা উচিত কোনটা অনুচিত তা বিবেচনা করার শক্তি ওদের নেই। আর তা থাকবেই বা কী করে? সৃষ্টিকর্তা ওদের মধ্যে সে বিবেচনাবোধই দেননি। তাই যিনি বা যারা ওইসব গবাদি পশু পালেন বা পোষেন, তাদের দায়িত্ব হয়ে পড়ে ওদের সামলে রাখার। আর শস্য খেতের মালিককে ব্যবস্থা নিতে হয় বাবুই কিংবা চড়ুই পাখির কবল থেকে তার খেত রক্ষার।

পশুপাখির কথা থাক। আশরাফুল মাখলুকাত মানুষের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। সারা পৃথিবীর কথা এখানে না তুলি। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায়ই আলোচনা করা যাক। সমাজের একশ্রেণির মানুষের চারিত্রিক অধঃপতনের বিষয়ে কারও দ্বিমত আছে বলে মনে হয় না। ওই শ্রেণিটির এতটাই অধঃপতন হয়েছে, এরা সজ্ঞানে নানা অপকর্ম করে চলেছে। প্রায় প্রতিটি পেশায় এ অধঃপতিত শ্রেণির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, পেশাজীবী সবখানেই চরিত্রহীনের ব্যাপক উপস্থিতি। অবশ্য আমাদের দেশে নৈতিক অবক্ষয় বা চারিত্রিক অধঃপতনের কথা উঠলেই মানুষ আঙুল তোলে রাজনীতিকদের দিকে। সব দোষ নন্দ ঘোষের মতো সব দায় তাদের ওপর চাপিয়ে বাকিরা ধোয়া তুলসীপাতা সেজে বসে থাকার কসরত করেন। যে সরকারি কর্মকর্তাটি ঘুষের টাকায় পকেট ভর্তি করে ফেলছে, সেও চায়ের টেবিলে বসে ‘রাজনীতিকরা দেশটাকে শেষ করে দিল’ বলে হতাশা ব্যক্ত করেন। যেন দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব শুধুই রাজনীতিকদের, অন্যদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে হলে সে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ইতিবাচক ভূমিকা যে অপরিহার্য, এ কথাটি আমরা যেন বেমালুম ভুলতে বসেছি। সমাজ বা রাষ্ট্রে যার যে অবস্থান সে যদি সেখানে তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে তাহলে দেশ ও জাতির অগ্রগামিতায় তার অবদান রাখা হয়ে যায়। আলাদাভাবে কিছু করতে হয় না।

তবে হ্যাঁ, রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততার কারণে রাজনীতিকদের দায় এবং দায়িত্ব বেশি। তাদের সঠিক ও সৎভাবে দায়িত্ব পালনের ওপর দেশ ও জাতির কল্যাণ এবং অগ্রগতি বহুলাংশে নির্ভর করে। তারা যখন ভুল করেন তার খেসারত গোটা জাতিকে দিতে হয়। আমাদের রাজনীতির একটা সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। কেউ কেউ সবকিছু নষ্টের জন্য রাজনীতির ওপর দোষ চাপান। কিন্তু তারা এটা বিস্মৃত হন যে এই রাজনীতিই আমাদের একটি স্বাধীন দেশ এনে দিয়েছে। আর সে রাজনীতির পেছনে ছিলেন আমাদেরই সৎ, নির্লোভ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিকরা। তাঁদের কল্যাণচিন্তা সব সময় আবর্তিত হয়েছে দেশ ও মানুষকে ঘিরে। ব্যক্তিগত লোভ-লালসা তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। আর সে কারণেই তারা আজও প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন আমাদের কাছে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, রাজনীতি ও রাজনীতিকদের সে ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখতে পারিনি। একশ্রেণির দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ এই মহান ব্রতকর্মটিকে করে তুলেছে বিতর্কিত, ক্ষেত্রবিশেষ নিন্দিত। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। রাজনীতিকরা হবেন সমাজের অন্যান্য শ্রেণির অনুসরণীয়- এটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু সে প্রত্যাশার আলোর ওপর হতাশার কালো মেঘ এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত। সৎ ও নিষ্ঠাবান রাজনীতিক একেবারে নেই এ কথা মোটেই সত্যি নয়। আছেন তারা। তবে কোণঠাসা অবস্থায়। অবৈধ অর্থের দাপটে দুর্বৃত্ত শ্রেণির কিছু ব্যক্তি এখন রাজনীতির গ্রামে মোড়ল সেজে বসে আছে। এরা টাকা দিয়ে সবকিছু কিনে নিতে চায়। আর নিতেও পারে অনেক সময়। আর তাই মানব এবং অর্থ পাচারকারী শহিদ ইসলাম পাপুলদের মতো লোক জাতীয় সংসদের ফ্লোরে বসার সুযোগ পায়। শুধু কি তাই খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, সরকারি সম্পদ দখলসহ সন্ত্রাসের গডফাদারও বনে যান ‘মাননীয় সংসদ সদস্য’। এসবই চরিত্রনাশের উদাহরণ।

তবে ওই চরিত্রহীন দুর্বৃত্তপরায়ণ ব্যক্তিদের সম্মানীয় আসনে বসার ক্ষেত্রে আমজনতার অবদানকে খাঁটো করে দেখার অবকাশ নেই। আমরা মানে জনসাধারণ যদি তাদের প্রত্যাখ্যান করতে পারতাম তাহলে তারা কখনো জাতীয় সংসদে প্রবেশের সুযোগ পেত না, রাজনীতির আসরে কল্কে পাওয়া তো দূর কি বাত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। তারাই নিয়ন্ত্রণ করার কথা রাষ্ট্রক্ষমতার চাবিকাঠি। কিন্তু সেখানেও রয়েছে গোলমাল। জনগণের একটি অংশও চরিত্র হারিয়ে নষ্টদের পক্ষে মাঠে নামছে, গলায় গলা মিলিয়ে কোরাস গাইছে। তারা ভোটাধিকারের মতো পবিত্র আমানতকে বিক্রি করে দিচ্ছে কয়েকটি নোটের বিনিময়ে। দেশে সুশাসন নেই বলে অনেককেই হা-হুতাশ করতে দেখা যায়। কিন্তু কাক্সিক্ষত সে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আমরা কি কোনো ভূমিকা রাখছি, নাকি দায়িত্ব পালন করছি? জনগণ যদি তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না হয় তাহলে সুশাসন যে সোনার হরিণ হয়েই থাকবে তা বলাই বাহুল্য। বিশ্ববিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল ১৮৬১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার’ (Consideration of Representetive Government) গ্রন্থে বলেছেন, ‘যখন নিজেদের সরকারে যথেষ্ট স্বার্থ নেই বলে নির্বাচকমন্ডলী ভোট দিতে আগ্রহান্বিত হয় না, অথবা যদি বা ভোট দেয়, তবু জনস্বার্থের ভিত্তিতে ভোটাধিকার ব্যবহার করে না, অথবা টাকা নিয়ে ভোট বিক্রি করে, অথবা তাদের ওপর যাদের ক্ষমতা আছে এমন লোকের ইঙ্গিতমতো ভোট দেয়, অথবা ব্যক্তিগত কারণে যাকে তারা খুশি করতে চায় এমন লোককে ভোট দেয় তখন প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রবিধি নিতান্ত অনর্থক হয়ে পড়ে, এমনকি একটি ষড়যন্ত্র আর উৎপীড়নের যন্ত্রেও পরিণত হতে পারে। জনগণের নির্বাচন যদি এভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তবে তা কুশাসনের প্রতিষেধক না হয়ে বরং কুশাসনের যন্ত্রে একটা অতিরিক্ত চাকা যোগ করে দেয়।’ ১৬০ বছর আগে জন স্টুয়ার্ট মিল ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক যেসব বিষয়ের উল্লেখ করে গেছেন, আমাদের বর্তমান সমাজে তার সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না।

রাজনীতি আর রাজনীতিকদের নিয়ে অনেক কথা বলা হলো। এবার অন্যদিকে চোখ ফেরানো যাক। নৈতিক অবক্ষয় বা চারিত্রিক অধঃপতনের ধারায় কারা নেই? বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদবিটি শুনলেই একসময় শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয়ে আসত। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনেক মেধাবী, দায়িত্ববান ও ন্যায়নিষ্ঠ ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন, আজও যাঁদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। তাঁদের কোনো উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁরা আর কিছু পাওয়ার জন্য লালায়িত হতেন না। ফলে রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকারপ্রধান তাঁদের সমীহ করতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা কী দেখি? বিশ্ববিদ্যালয় ভিসিদের একটি অংশ (সবাই নন) দলীয় রাজনীতির পায়রবি করে চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি, অবসরের পর কোনো উচ্চপদে নিয়োগ প্রাপ্তির চেষ্টা করেন। এমনকি তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম এবং নীতি-নৈতিকতা-বহির্ভূত কার্যকলাপেরও অভিযোগ পওয়া যায়। অতিসম্প্রতি দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তাঁর শেষ কার্যদিবসে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন পদে বিতর্কিত নিয়োগ দিয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। ওই নিয়োগ প্রক্রিয়ার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সর্বত্র নিন্দার ঝড় উঠেছে। তখন তাঁকে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মনে হয়নি। মনে হয়েছে কোনো দুর্নীতিপরায়ণ আমলা। বেশ কয়েকজন ভিসির অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনও করেছেন। কারও কারও বিষয়ে তদন্তে নেমেছে দুদক। চরিত্রে ধসনামা আর কাকে বলে!

আসলে আমাদের নির্ভরতার খুঁটিগুলোয় ঘুণপোকায় ধরেছে। ফলে নড়বড়ে হয়ে গেছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো। যাদের চারিত্রিক বল জাতিকে শক্তি জোগানোর কথা তাদের চরিত্রই আজ কলুষিত। তাহলে জাতির ভবিষ্যৎ কী? উত্তর একটাই- যাদের চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে, যাদের মস্তিষ্কে ধরেছে পচন তাদের ছুড়ে ফেলতে হবে আঁস্তাকুড়ে। কেননা তারা আবার ভালো হবেন এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং জাতিকে যদি রক্ষা করতে হয় তাহলে নতুন একটি চরিত্রবান ও দায়িত্বশীল প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে। সে চেষ্টাতেই যত্নবান হওয়া বোধকরি সঠিক কাজ হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর