বৃহস্পতিবার, ১০ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

জেল খাটা সেই দিনগুলো...

মাকিদ হায়দার

জেল খাটা সেই দিনগুলো...

বিগত ১৪ মাস গৃহবন্দী হয়ে আছি। এর আগে জেলবন্দী হয়েছিলাম মাত্র সাত দিনের জন্য। সেই ১৯৬৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রনেতা টিপু বিশ্বাস এবং বারী সরদার, নিখিল সাহাদের নেতৃত্বে বিশাল এক মিছিল এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বেরিয়ে প্রথমে জিলা স্কুলের ছাত্রদের এবং পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের ছাত্রদের স্কুল থেকে বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন ছাত্রনেতারা। পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান গেট আটকে দিয়েছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক সত্যেন পাল। তাই ওই স্কুল থেকে কোনো ছাত্রই সেদিন মিছিলে যোগ দিতে পারেনি। অন্যদিকে পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের চারদিকে কোনো দেয়াল না থাকায় যে কেউ যে কোনো দিক দিয়েই বের হতে পারত। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মথুরানাথ মুখোপাধ্যায় (এমএসসি. ক্যাল) প্রতিটি ক্লাসেই খবর পাঠিয়েছিলেন কোনো ছাত্রই যেন কলেজ- ছাত্রদের মিছিলে যোগদান না করে। সম্ভবত মথুরানাথকে জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক সত্যেন পাল (এমকম. ক্যাল) ফোনে বিষয়টি জানিয়েছিলেন তাঁর স্কুলের প্রধান গেটে কলেজছাত্ররা হামুদুর শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে মিছিল করছেন এবং স্লোগান দিচ্ছেন আইয়ুব খান নিপাত যাক। আমি আমার কোনো সহাপাঠীকে কিছু না জানিয়ে স্কুলের পেছনে সাইকেলস্ট্যান্ড থেকে আমার প্রিয় সাইকেলটি নিয়ে অতি দ্রুততার সঙ্গে মিনিট পাঁচেকের পথ পাড়ি দিয়ে জিয়া স্কুলের গেটের সামনে আসতেই শুনি, ‘হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিল করতে হবে’। স্লোগানে আমিও গলা মেলালাম এবং একপর্যায়ে চিৎকার করে বললাম জিলা স্কুলের টেলিফোনের লাইনটি বিচ্ছিন্ন করে দিতে। মিছিলের সামনে জনাকয়েক পুলিশ এবং সাদা পোশাকের অনেককেই দেখলাম, তখন আমি এসবি ডিবি বা সিআইডিদের কাউকেই চিনতাম না এমনকি তাদের নামও শুনিনি কোনো দিন, শুধু জানতাম পুলিশ নামের একটি বাহিনী আছে। যদিও আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র এসবি, ডিবি, সিআইডি এ নামগুলোর সঙ্গে পরিচিত না হওয়াই আমার অজ্ঞতা এবং কাল হয়েছিল।

জিলা স্কুলের টেলিফোনের লাইনটি বিচ্ছিন্ন করার কথা বলতেই আমার পাশে দাঁড়ানো এক সাদা পোশাকধারী আমার মাথার চুল ধরে হামিদ রোডের ওপর ফেলে দিতেই সেই সাদা পোশাকধারী এক পুলিশকে বললেন উত্তমমধ্যম দিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগাতে। আমি উঠে দাঁড়াতেই আরেক পুলিশ তার বন্দুকের ‘কুঁদো’ দিয়ে আমার বাঁ বুকে এমন জোরে আঘাত করল, আমি আবার রাস্তায় পড়ে যেতেই তাকিয়ে দেখি আগের তুলনায় বেশ কয়েকজন পুলিশ জড়ো হয়েছে। এমন সময় পাবনা পুলিশপ্রধান এবং জেলা প্রশাসক সিএসপি জাকির হোসেন সাহেব জিপ থেকে নেমেই পুলিশপ্রধানকে নির্দেশ দিলেন ছাত্রনেতাসহ উপস্থিত সবাইকে জেলখানায় পাঠাও। সেদিন কাউকে হাজতে না পাঠিয়ে সরাসরি আমাদের ৫১ জনকে কমবেশি উত্তমমধ্যম দিয়ে জেলখানায় সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া হলো, যেহেতু ৫১ জনকে হাজতখানায় পাঠালে স্থানসংকুলান হবে না জেনেই যেতে হলো জেলখানায়। জিলা স্কুলের গেট থেকে পুলিশ পাহারায় আমরা এক লাইনে হেঁটে জেল গেটে পৌঁছাতে লাগল মিনিট পাঁচেক। এদিকে আষাঢ়-শ্রাবণে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির ভিতরে হঠাৎ শুনলাম একজন পুলিশ আরেকজন পুলিশকে বলল, এই ছেলেটির সাইকেলটি গেটের এক পাশে পড়ে আছে। সাইকেলটি কালু মিয়ার চায়ের দোকানে রেখে কালু মিয়াকে বলবে সাইকেলটি যেন তার দোকানেই রাখে, কোনো ছেলে গিয়ে সাইকেলটি ফেরত চাইলে যেন ফেরত দিয়ে দেয়। কালু চাচার চায়ের দোকানটি পাবনা পুলিশ অফিসারদের ক্লাবের দক্ষিণ দিকে। যত দূর মনে পড়ে কালু চাচাদের বাড়ি আমাদের বাড়ির পেছনের কয়েকটি বাড়ি পরই। আমরা ৫০ দশকের শেষের দিকে জিলাপাড়া ছেড়ে দোহারপাড়ায় চলে এলেও কালু চাচা আমাদের সব ভাইবোনকে চিনতেন।

জিলাপাড়ার চুনু ভাই, নান্নু ভাই, আমার ফুফুর ছেলে, বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় এবং ফুফা ছিলেন ব্যবসায়ী। চুনু-নান্নু ভাইদের আরেক ভাই বাচ্চু আমার সহপাঠী ছিলেন কয়েক বছর আগে পাবনা জিলা স্কুলে। ওই বাচ্চুদের বাড়ি থেকে জিলা স্কুলের দূরত্ব দুই মিনিটের পথ। বাচ্চু কার কাছ থেকে শুনেছিল আমাকে পুলিশ ধরে জেলে ভরেছে। সেই আষাঢ়-শ্রাবণের টিপটিপ বৃষ্টির ভিতরে জিলাপাড়া থেকে দোহারপাড়ায় গিয়ে আমার দ্বিতীয় মায়ের কাছে খবর দিয়েছিল, পুলিশ রোকনকে জেলখানায় ঢুকিয়েছে। আমার মা এবং বাবা তখন ঢাকায় ছিলেন, তাই তারা কোনো খবরই পাননি- এমনকি টেলিফোনের সুযোগ না থাকায় বাবা-মা, জিয়া ভাই, রশিদ ভাই কেউ জানতেই পারলেন না আমি জেলখানায়। বৃষ্টি কিছুটা থিতু হওয়ার পর দুজন পুলিশ একজন ছেলেকে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে জেলগেটে আনতেই দেখি ছেলেটির হাতে ফুলতোলা টিনের একটি বাক্স। আমাদের দেখে ছেলেটি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে জানাল, ‘আমি পাবনা পলিটেক স্কুলে পড়ালেখা করি। আমার নাম জগদীশ পাল, সবে পাবনা বাসস্ট্যান্ডে নেমেছি ঠিক তখনই আমাকে পুলিশ ধরেছে। আমি জানি না কোন অপরাধে আমাকে ধরা হলো।’ এক পুলিশ জগদীশ পালকে ধমক দিতেই সে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘মা কালীর দিব্যি আমি কিছু জানি না।’ এমন সময় দারোগা সাহেব এলেন এবং তিনি কাকে যেন বললেন, জেলে ছাত্রদের ঢোকাবার আগে প্রত্যেকের নাম-ঠিকানা, কে কোথায় লেখাপড়া করে, সঙ্গে যার যা কিছু আছে তা যেন সিজার লিস্ট ভালো করে করা হয়। আমরা আগে ছিলাম ৫১ জন, জগদীশসহ হলাম ৫২। এমন সময় আরেকজনকে পুলিশ ধরে নিয়ে এলো, সে নাকি ঈশ্বরদীর রূপপুরে তার খালার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল, তাকেও ধরা হয়েছে বাসস্ট্যান্ড থেকে। তখনকার দিনে পাবনা বাসস্ট্যান্ড ছিল আজকের ডায়াবেটিক হাসপাতালের উত্তর দিকে। সংখ্যায় হলাম গিয়ে ৫৩ জন। শেষে যাকে পুলিশ ধরেছিল সেই ছেলেটির নাম মোতালেব হোসেন খান, ছোটখাটো ব্যবসায়ী পাবনা বড় বাজারের। বন্দুকের কুঁদো দিয়ে গুঁতো দেওয়ায় আমার বাঁ পাশের বুকের ব্যথাটা অসহনীয় হলে চিৎকার করে কাঁদছিলাম। টিপু বিশ্বাস এবং বারী সরদার বললেন, ‘যেহেতু আমরা গুনাগুনতির পর লকআপে আছি সবাই, কাল সকালে যখন লকআপ খুলে দেওয়া হবে তখন জেল সুপারের মাধ্যমে জেলখানার ডাক্তারকে খবর দেওয়া হবে।’ পরদিন সকাল বেলায় আমাদের সবাইকে একটি দোতলার বিশাল হলরুম থেকে বের করে দুই সেপাই গুনে দেখল আমরা সবাই আছি কি না। জেলখানার ভিতরের বড় একটি কাঁঠাল গাছের নিচে আমাদের মাটিতে বসিয়ে দিয়ে অন্য তিনজন সেপাই পোড়ারুটি আর অখাদ্য সবজি নিয়ে এলো। আমরা যখন খাচ্ছিলাম তখনই জেল সুপার আমাদের দেখতে এলেন, জানতে চাইলেন রাতে কষ্ট হয়েছে কি না? টিপু ভাই বললেন, ‘কম্বলভর্তি ছারপোকা আর মশার কামড়ে কেউই ঘুমাতে পারিনি। মাকিদ বুকের ব্যথায় সারা রাত চিৎকার করেছে।’ জেলার সাহেব জানতে চাইলেন মাকিদ কে? টিপু ভাই আমাকে দেখিয়ে দিলে জেল সুপার সাহেব আমার কাছে এসে প্রথম প্রশ্ন করলেন, কী কারণে বুকের ব্যথা হলো। আদ্যোপান্ত বলায় তিনি জানতে চাইলেন কী করা হয়? বললাম পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের দশম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের কথোপকথনের ভিতরে টিপু ভাই, বারী ভাই দুজনই এসে জানালেন, ‘ওই একমাত্র আসামি স্কুলে পড়ে। আপনি যদি দয়া করে ডাক্তার পাঠাতেন।’ বিনয় মাখানো কথায় জেল সুপার বললেন, ‘ছেলেটির তো এখনো গোঁফ ওঠেনি, ঠিক আছে ডাক্তার বড়ুয়াকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ ঘণ্টাখানেক পর ডা. বড়ুয়া যখন এলেন তখন আমরা দোতলার সেই ঘরটিতে। গুনাগুনতির পরে ডা. বড়ুয়ার নির্দেশে আমাকে দুজন সেপাই ঘর থেকে বের করে নিচে নিয়ে গেলেন। সেই বড় কাঁঠাল গাছটির নিচে। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কয়েকটি ট্যাবলেট নিয়ে আসতে বললেন এবং আমাকে যথারীতি লকআপে ঢুকিয়ে ফিরে গেলেন। ঘরে ঢুকে দেখি ময়মনসিংহের সেই ছেলেটি হাউমাউ করে কাঁদছে। নিমাই দা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘এক দুই সপ্তাহ পরে আমাদের কোর্টে তুলবে তারপর ছেড়ে দেবে।’

আমাদের স্কুলের সবাই জেনে গেছে আমি জেলখানায়। তখন নাকি পুলিশকে ঢিল মেরেছিলাম সে অপরাধে ধরেছে পুলিশ। আমার সহপাঠী ছিলেন অমল বড়ুয়া ওর বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। ও যখন জানল আমি জেলে তখন অমল নাকি বলেছিল, ওর বড় ভাই জেলখানার ডাক্তার তাকে রাতে বলবে মাকিদকে যেন জেলখানার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অমল সত্যিই তার ভাইকে বলেছিল বলেই পরদিন স্বয়ং ডাক্তার সাহেব দুজন সেপাই দিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘অমল তোমার সহপাঠী ও রাতে আমাকে বলেছিল আমি যেন তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি করি। সকালের নাশতা এখন তুমি হাসপাতালে গিয়ে খাবে। আর পরে যত দিন থাকো হাসপাতালের বেডেই থাকবে। তবে বের হবে না। আর তুমিই তো একমাত্র সবচেয়ে কম বয়সী বন্দী। উপরন্তু অমলের বন্ধু। সামনের বছরের মার্চে তোমাদের মেট্রিক পরীক্ষা। জেল থেকে ছাড়া পেলে ভালো করে পড়াশোনা করবে।’

ডা. বড়ুয়ার কথাগুলো এখনো আমার মনে আছে। তবে আমি লুকিয়ে গিয়ে একটি লোকের সঙ্গে বার দুয়েক কথা বলেছিলাম। যার সঙ্গে কথা বলেছিলাম তিনি ছিলেন পাবনা জেলখানার ফাঁসিদাতা। ভদ্রলোকটির চোখ দুটি লাল টকটকে। ফাঁসি কোথায় দেয়, সে জায়গাটি তিনি আমাকে দেখিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘জেলখানা থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভালো করে লেখাপড়া কোরো।’ দেখতে ভদ্রলোকের ছেলে বলেই মনে হয়। আমাদের হায়দার পরিবারের পাঁচ ভাই জেল খেটেছি। জিয়া ভাই পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়ার সময় সেই ১৯৫৩-৫৪ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাওয়ার অপরাধে কামাল লোহানী, রণেশ মৈত্র, আমিনুল ইসলাম বাদশা ভাইসহ জনাকয়েক জেল খেটেছিলেন তিন মাস। রশীদ ভাই জেল না খাটলেও আমি জেল খাটলাম ১৯৬৪ সালে। বিনা অপরাধে বলেই আমার এখনো মনে হয়। অবশ্য পুলিশ বা এসবি, সিআইডি, ডিবি এদের চোখে অপরাধী যদি না-ই হব তাহলে আমাকে জেলই বা খাটতে হলো কেন! মজার ব্যাপার, কয় ভাই প্রায় কয়েক বছর পরপরই জেলে ঢুকেছি। যেমন আমি ১৯৬৪ সালে, দাউদ ঢুকেছিল ১৯৭৪ এবং জাহিদ ১৯৭৮, আবিদ ঢুকেছিল জাসদ করার অপরাধে, সেও গত শতকে। তবে ভাগ্যবান রশীদ হায়দার এবং আরিফ হায়দার, আমার ওই দুই ভাই আমার মতো একাধিকবার হাসপাতালে যাননি, এমনকি জেলখানায়ও নয়। ১৯৫৭ সালে প্রথম হাসপাতালে গিয়ে মাসখানেক ছিলাম। নিজেদের সুপারিবাগান থেকে সুপারি পাড়ার সময় পড়ে গিয়ে, তারপর একাধিকবার অসুখ-বিসুখে।

আমার প্রিয় শহর পাবনায় যাই না বছর দুয়েক। আমাকে ‘তুই’ বলার মতো একজন বন্ধু ছিলেন তিনি গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। তবে অনেক অনুজপ্রতিম এখনো আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করেন। আলোচনা করেন পাবনা শহরের শিল্প-সাহিত্য-কবিতা নিয়ে এবং সবার একই অভিযোগ, শহরের কোথাও তরুণ কবি-গল্পকার-শিল্পী-সাহিত্যিকদের বসার জায়গা নেই। ডা. মোকলেস মুকুল [লেখক-গল্পকার-ঔপন্যাসিক] তিনি ক্ষোভ জানিয়ে বলেছিলেন, বগুড়া এবং টাঙ্গাইলে শিল্পী-সাহিত্যিকদের জন্য কবি ইসলাম রফিক বগুড়ায় এবং কবি মাহমুদ কামাল টাঙ্গাইলে নিয়মিত তরুণ কবি-গল্পকার-ছড়াকার নিয়ে সাহিত্যবাসর করলেও আমাদের পাবনা শহরের কোথাও সাহিত্যবাসর করার মতো জায়গা নেই। কথাটি শুনে আমি মর্মাহত হয়েছিলাম এবং বুঝতে পেরেছিলাম তার এবং তাদের ক্ষোভের কারণ। কিছুদিন আগে ঢাকার নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক ভূইয়া (অতিরিক্ত সচিব)। ভূইয়া সাহেব মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক নামে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ লেখেন, সেই সূত্রেই আমাদের হায়দার পরিবারের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা।

বছর দুই-তিনেক আগে হঠাৎ একটি টেলিফোন এলো আমার কাছে। টেলিফোনের অন্য প্রান্তের ভদ্রলোক জানালেন, ‘আমি নজরুল ইনস্টিটিউটের সচিব। নাম আবদুর রশীদ, স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।’ তখনই জানলাম ওই ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক হয়েছেন মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক। তিনি পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমি আপনার অগ্রজ রশীদ হায়দারের চেয়ারে স্থলাভিষিক্ত হয়েছি।’ খুব ভালো বলতেই রাজ্জাক সাহেব জানালেন, ‘আপনাকে বরগুনায় যেতে হবে জাতীয় কবি নজরুলের ওপর এক অনুষ্ঠানে। ঢাকা থেকে যাবেন সেলিনা হোসেন, নেত্রকোনা থেকে আসবেন শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. রফিক উল্লাহ খান, গায়ক সোহরাব হোসেন, ফাতেমা-তুজ জোহরা, নাশিদ কামাল এবং আসাদ চৌধুরী।’ প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। যেহেতু যাওয়া-আসা বরিশাল পর্যন্ত বিমানে। সেখান থেকে জিপে। পরে বরিশাল থেকে আমরা সদলবলে বরগুনার সার্কিট হাউসে গিয়ে উঠলাম, নির্বাহী পরিচালক রাজ্জাক, ইনস্টিটিউটের সচিব এবং ঊর্ধ্বতন নির্বাহী কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন। সার্কিট হাউসেই পরিচয় হলো বরগুনার জেলা প্রশাসক কবির মাহমুদের সঙ্গে। অত্যন্ত হাসিখুশি এবং কর্মঠ। ওইদিন রাতেই তিনি এবং জনাকয়েক ম্যাজিস্ট্রেটসহ অনুষ্ঠান কোথায় হবে দেখতে গেলাম। বেশ অনেক রাত ধরে গল্পগুজব হলো এবং পরদিন শুরু হলো অনুষ্ঠান। হাসিখুশি কবির মাহমুদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তুখোড় ছাত্র। ফলে বিসিএস পাস করতে তার বেগ পেতে হয়নি। সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক শাখাওয়াত হোসেন খান এবং অধ্যাপক (পরে ভিসি) আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। আমার মেজভাই রশীদ হায়দারের ছোট মেয়ে শাওন্তী হায়দার বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক। শাওন্তী হায়দারের এক ক্লাস নিচে পড়তেন কবির মাহমুদ, জেলা প্রশাসক বরগুনা। হঠাৎ বছর দু-তিন আগে আমাকে কবির মাহমুদ ফোন করে জানালেন তিনি পাবনার জেলা প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছেন, সংবাদটি খুশির। দীর্ঘক্ষণ কথা শেষে জানালেন আমি পাবনায় গেলে অবশ্যই যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করি।

করোনাভাইরাসের আগে পাবনায় গিয়েছিলাম পারিবারিক কাজে। তার আগে ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে আমি গ্রহণ করায় জেলা প্রশাসক কবির মাহমুদ আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। পাবনায় পৌঁছানোর পরদিন শহরের প্রেস ক্লাবে ক্লাব সভাপতি প্রফেসর শিবুজিত নাগ এবং ক্লাব সদস্যরা মিষ্টিমুখ করিয়েছিলেন একাডেমির পুরস্কার প্রাপ্তিতে। ওই দিন সন্ধ্যায় অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির দক্ষিণ দিকের একটি স্কুলে সাবেক প্রেস ক্লাব সভাপতি সাংবাদিক রবিউল ইসলাম রবি, বিশিষ্ট বামপন্থি নেতা রণেশ মৈত্র এবং প্রায় ২০-২৫ জন আমার একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া উপলক্ষে খিচুড়ি মাংস এবং মিষ্টি এনে খাইয়েছিলেন। স্থানীয় পত্রিকায় আমার পাবনা উপস্থিতির কথা জানিয়েছিলেন অনুজ সাংবাদিকরা। ফলে পরদিন সকালের দিকে আমাদের দোহারপাড়ার বাড়িতে জনাকয়েক কবি-গল্পকার এসে জানিয়েছিলেন তাদের মনের আকুতি। পাবনা শহরের কোথাও কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের বসার জায়গা নেই। ঔপন্যাসিক মোকলেস মুকুল অন্য সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শহরের নতুন ব্রিজের পুবের দিকে পুলিশ আইল্যান্ডের দক্ষিণে সরকারি কিছু জায়গায় আমরা সামান্য ইট-সিমেন্ট দিয়ে একটি বেদির মতো বানিয়েছি। তবে সেটি বসার মতো উপযুক্ত জায়গা নয়। জায়গাটিকে উপযুক্ত করতে গেলে পাবনার জেলা প্রশাসক মহোদয়ের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন। আপনি যদি আগামীকাল জেলা প্রশাসককে গিয়ে অনুরোধ করেন তিনি ওই ঘোড়াস্ট্যান্ডে একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা করে দেন তাহলে ছেলেমেয়েরা কবিতা পাঠ-গান বাজনা করতে পারবে। পয়লা বৈশাখ, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরের মতো বিশেষ বিশেষ দিনে অনুষ্ঠান করতে পারবে এই শহরের ছেলেমেয়েরা।’ প্রস্তাবটি আমি পরদিন জেলা প্রশাসককে জানাতে তিনি সাগ্রহে বললেন এনডিসিকে পাঠাবেন এবং জায়গাটি সরেজমিন দেখে একটি দৃষ্টিনন্দন মঞ্চ/কেন্দ্র বানিয়ে দেবেন।

কবির মাহমুদ জানতে চাইলেন কেন্দ্রটি যার নামে হবে তাকে পাবনার কৃতীসন্তান হতে হবে শিক্ষা-দীক্ষায়। সমগ্র দেশের লোকজন যেন জানতে পারেন সেই ভদ্রলোকটির নাম। চা-বিস্কুট খেতে খেতে আমি জানালাম মঞ্চ বা কেন্দ্রটি আমার অগ্রজ জিয়া হায়দারের নামে হলে কী রকম হয়? প্রস্তাবটি তিনি সাদরে গ্রহণ করে জানালেন জুন, ২০২১ সালের ভিতর আশা করি সম্পন্ন করা যাবে। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ি ফেরার আগে মোকলেস মুকুলকে জানিয়ে দিলাম জেলা প্রশাসক মহোদয়ের ইচ্ছার কথা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক প্রবন্ধে জানিয়েছেন, ‘আমাদের চিত্তযাত্রী দিগকে ভালোবাসে সংসারে কেবল আমাদেরই মধ্যে সে বিরল লাভ করে।’ বোধকরি কথাটি প্রযোজ্য হবে পাবনার জেলা প্রশাসক কবির মাহমুদের জন্য।

লেখক : কবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর