বৃহস্পতিবার, ১০ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনাকালীন বাজেট ও পর্যটনশিল্প

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

করোনাকালীন বাজেট ও পর্যটনশিল্প

প্রতি বছরের মতো জুনে বাংলাদেশের বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৭.৫ শতাংশ। নতুন অর্থবছরে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন খাতের জন্য ৪ হাজার ৩২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি প্রস্তাবিত বাজেটের শূন্য দশমিক ৬৬ শতাংশ। এ বরাদ্দ প্রস্তাব গত অর্থবছরে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ৩ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকার চেয়ে ৩৪৪ কোটি টাকা বেশি। তবে সর্বশেষ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এই মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ২ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। সে হিসেবে গত বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে ৩৫ শতাংশ বেশি বা ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছরের মতো এ বাজেটটি একটি বিশেষ সময়ে ঘোষণা করা হয়েছে। সারা বিশ্ব এখন করোনা নামক এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ফলে বর্তমান সময়টা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হচ্ছে সরকারকে। এ বাজেটকে বলা হচ্ছে মানুষের টিকে থাকার বাজেট, যেখানে জীবিকা ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল রাখার পাশাপাশি মানুষের জীবনের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। ২০২০-২১ সালের অর্থবছর ছিল করোনাময় একটি বছর। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য। ২০২০ সালের শেষের দিক থেকে কিছুটা স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে এলেও পর্যটনশিল্পের জন্য তা এখনো ভয়াবহ রূপে আছে। তার ওপর ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় লকডাউনে তা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। লকডাউন শিথিল করা হলেও এখনো রয়ে গেছে বিধিনিষেধ। তবে মানুষের জীবনযাত্রা কবে পরিপূর্ণভাবে স্বাভাবিক হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটনশিল্প। যেখানে বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের মোট জিডিপির পরিমাণ ছিল গড়ে সাড়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশের ্রওপর। সেখানে বর্তমানে সব কর্মকান্ড ঠিক রেখে বিশ্ববাজারে টিকে থাকাই মানুষের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ।

২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালের শুরুটা পর্যটনের জন্য বেশ ভালোই ছিল। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পর্যটকের সংখ্যা বিগত বছরের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি ছিল। তবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় পর্যটকশূন্য দেশগুলো। বিশ্বব্যাপী লকডাউন জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকের সংখ্যাও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। জুনের শুরু থেকে কিছু দেশ লকডাউন শিথিল করলেও পর্যটনে খরা কমেনি। আর বিশ্বে করোনার প্রভাব কত দিন থাকবে তা এখনই সঠিক করে বলা যাচ্ছে না। বিশ্ব পর্যটন সংস্থা তিন ধরনের পূর্বাভাস দিয়েছে। যদি জুলাই পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে তবে বিগত বছরের তুলনায় প্রায় ৫৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কম হবে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হলে তা ৭০ শতাংশ হবে আর ডিসেম্বর পর্যন্ত হলে তা গিয়ে দাঁড়াবে ৭৮ শতাংশে, যা পর্যটনশিল্পের জন্য এক ভয়াবহ পরিস্থিতি নির্দেশ করছে। একই সঙ্গে এর প্রভাব পড়বে পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মসংস্থানে। বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই সময়ে প্রায় ১০০ থেকে ১২০ মিলিয়ন চাকরি ক্ষতির মুখে পড়বে। বাংলাদেশও এমন প্রতিকূল অবস্থায় রয়েছে। এ বাস্তবতা সামনে রেখে বাংলাদেশেও ২০২১-২২ সালের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে।

আমরা দেখেছি, বাজেটে বরাবরই অবহেলিত থেকে যায় এ দেশের পর্যটন খাত। ২০১৩-১৪ সালে পর্যটন খাতে বরাদ্দ ছিল ৩০৭ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫ সালে ১৫৯ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ সালে ৩৭১ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ সালে ৬৮৬ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ সালে ৬৮৬ কোটি টাকা এবং ২০১৮-১৯ সালে ১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পরিচালক ও উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। এ বছর কিছুটা বরাদ্দ বেড়েছে।

প্রতি বছর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এ খাতের জন্য বরাদ্দ হয়ে আসছে। এ বাজেটে নামমাত্র পর্যটনের জন্য ৫০-৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ পায়, আর বাকি টাকা বরাদ্দ হয় বেসামরিক বিমান পরিবহনের জন্য। ট্যুরিজমের জন্য আলাদা বাজেট এখন সময়ের দাবি। অন্তত বাজেটে বড় ধরনের বরাদ্দ প্রয়োজন এ শিল্পকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য।

করোনায় বাংলাদেশের পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। এর ফলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান-গুলোকে টিকে থাকতে প্রয়োজন সরকারের বিশেষ প্রণোদনা। পর্যটনের সঙ্গে জড়িত অনেকের কর্মসংস্থানও হুমকির মুখে। পর্যটনশিল্পকে টিকে থাকতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে সুচিন্তিত পদক্ষেপ দরকার। তা ছাড়া বাংলাদেশের পর্যটন খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েক লাখ লোকের চাকরিও চরম ঝুঁকিতে। তাই পর্যটন সম্পৃক্ত সবার টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন বিশেষ প্রণোদনা।

সরকার বিভিন্ন শিল্পের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। সেখানে পর্যটনের মতো বৃহৎ শিল্পটি রয়ে গেছে অবহেলিত। অথচ পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত আছে কয়েক লাখ ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প। যার মধ্যে বেশির ভাগ শিল্পই আছে ঝুঁকির মুখে। এসব শিল্পকে সহায়তা না করা গেলে টিকে থাকতে পারবে না। ফলে তৈরি হবে চরম অনিশ্চয়তা। বেকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে লাখ লাখ মানুষ। তাই অন্যান্য শিল্পের মতো পর্যটন খাতের জন্য দরকার স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা।

মানুষের সঞ্চয় কমে গেছে। ফলে জীবনযাত্রার মানও কমে গেছে। তাই মানুষ আগের চেয়ে ভ্রমণ কম করবে। তা ছাড়া স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে সবাই ভ্রমণ পরিকল্পনা করবে। এসব কারণে করোনার প্রভাব চলতি বছরের  মধ্যে শেষ হয়ে গেলেও পর্যটন খাত স্বাভাবিক হতে আরও দু-তিন বছর লাগতে পারে। তাই সংকটময় এই সময়ে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন বিশেষ বরাদ্দ।

লেখক : চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর