সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

তোমার ছোঁয়া

হোসেন আবদুল মান্নান

তোমার ছোঁয়া

তোমার চলে যাওয়ার পর পুরো এক বছর পূর্ণ হলো আজ। কবিদের মতো করে বললে, অসুস্থতা নিয়েও আমাদের এই পৃথিবী আরও একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে সক্ষম হয়েছে। ভাবতেই অবাক হয়ে যাচ্ছি, শিউরে উঠছি বারবার। অবশেষে এ-ও সম্ভব হলো। আমি এবং তোমার আদরের সন্তানরা, স্নেহের জামাই, দুই ভাই, আত্মীয়-স্বজন এমনকি যাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তায় বিদীর্ণ হতে সেই আম্মাও করোনাক্রান্ত হন এবং ভালো আছেন। তোমার পর আমরা সবাই একে একে আক্রান্ত হই। হাসপাতালে গিয়েও একেবারে পাতালে যাইনি। সত্যি বলতে, তুমি ছাড়া নিষ্ঠুরতম এই করোনা আমাদের আর কাউকে এখন অবধি হত্যা করতে পারেনি। আমাদের চারপাশের সর্বত্র এখনো তুমি। তোমার স্পর্শ থেকে বের হয়ে আসতে একবিন্দুও এগোতে পারিনি। বিগত তিন শত পঁয়ষট্টি দিবসের যাপিত সময়ে তোমাকে বিস্মৃত হয়ে একটানা একটি ঘণ্টাও কাটাতে পারিনি। বলা যায়, তোমার বত্রিশ বছরের দেনা-পাওনার হিসাব প্রতিক্ষণের অব্যক্ত যন্ত্রণার বিনিময়ে আমি শোধ করে যাচ্ছি।

২) তোমার শূন্যতায় সন্তানরাও একইভাবে শোকাবহ জীবনের সঙ্গী হয়ে বেড়ে উঠতে চাচ্ছে। তোমার সবচেয়ে আদরের কনিষ্ঠ পুত্র অম্লান তোমারই স্বপ্ন পূরণে দৃঢ় শপথে বলীয়ান হয়ে এখন প্রায় স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। মাঝে মধ্যে ভাবী, তোমার অকাল প্রস্থান কোনো কোনো সরব উপস্থিতির চেয়েও অধিক কার্যকর। তোমার আদিত্য ডাক্তার হয়ে দেশেই এক বিদেশি সংস্থায় কর্মরত আছে। নাতনি সুন্দরীকে দেখনি সে ভালোই হয়েছে। তার বয়স এখনো পাঁচ মাস হয়নি। তাতে কী? এখন তো সে-ই আমার সব। তোমার সাজানো সংসার আজ তার দখলে। কী যে হিংসা হতো তোমার, এসব ভেবে আজকাল প্রায়ই আমি আনন্দাশ্রুতে স্নাত হয়ে উঠি। তবে কাউকে বলি না। তুমি তো জান, আসলে আমার বলার তেমন কেউ নেই। আমাদের কেমন দুর্ভাগ্য দেখ! উভয়ই নিজেদের বার্ধক্যের সৌন্দর্য থেকে আকস্মিক বঞ্চিত হলাম। অপরাহ্ণের অস্পষ্ট আলোয় হাত ধরে হাঁটাটা আর হলো না। শোন, তুমি নেই বলে অফিসে আর কোনো দিন খাবার নিয়ে যাইনি। তাছাড়া আমি এখন আর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে নেই, যা দেখে যাওয়ার জন্য অযথা দুটো দিন অপেক্ষার পর তুমি হাসপাতালে গিয়েছিলে। কেন যে এমনটি করেছিলে? দুই দিন আগে হলে হয়তো বা বেঁচে যেতে পারতে। না, এসব আমার অনর্থক ভাবনা। এর কোনো মানে হয় না। পাগলের প্রলাপতুল্য বচন। এসব মূলত সান্ত¡না খুঁজে ফেরার অপপ্রয়াস। কখনো বেদনার্ত হৃদয়ে ভাবী, তোমার চলে যাওয়ার দিন বাংলাদেশে করোনায় মোট এক হাজার মানুষও মৃত্যুবরণ করেনি। আজ এ সংখ্যা তেরো হাজারের কাছাকাছি। অথচ সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা দৃশ্যমান নয়।  ৩) কী বিস্ময়কর এক ভবিষ্যদ্বাণী করে গেলে! আমাদের লাল পাসপোর্ট আজও অব্যবহৃতই রয়েছে। অভিশপ্ত করোনা বিদেশ ভ্রমণের ওপরও কঠোর হস্তক্ষেপ করেছে। ভালোই হয়েছে। এখন স্বদেশই আমার কাছে বিদেশ-বিভূঁইয়ের মতো। আজকাল হঠাৎ করে ফেসবুকের কল্যাণে মাঠ প্রশাসনের চাকরিকালীন নানা গ্রুপছবিতে তোমাকে পেয়ে যাই।

অথচ ওরা জানে না এসব আমাকে শুধু শুধু কষ্ট দেয়, চোখের কোণে অযথা এক ফোঁটা জলের কারণ হয়ে ওঠে। অফিসার্স ক্লাবের তৎকালীন মহিলা কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্যরাও নানা সময় গ্রুপছবি পোস্ট করে থাকেন। এতেও লক্ষ্য করলে দেখি, তুমি ছাড়া প্রায় সবই বহাল তবিয়তে করোনার দুনিয়ায় বেঁচে আছেন।

৪) আমার পাঠাভ্যাস এবং লেখালেখির বাতিকগ্রস্ততা আগের মতোই রয়ে গেছে। মনে পড়ে, যেদিন বহুল আলোচিত দৈনিক পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশ হতো মুখে প্রকাশ না করলেও তোমার আনন্দ আমি অনুভব করতাম। তোমার দেওয়া সেই টেবিলটা বেডরুমের যথাস্থানেই আছে বরং নতুন সংগৃহীত বইয়ের জন্য আরও একটি শেলফ কেনা হয়েছে। বইয়ের ভিতর দিয়ে জীবনকে ভাগ করে নেওয়া ছাড়া আপাতত আমি কোনো অবলম্বন পাচ্ছি না। আমার মতো বাচ্চারাও বলে, ঘরের সব জায়গায় নাকি কেবল তোমার ছোঁয়া। আম্মা এখন আমাদের সঙ্গেই থাকেন, নিজেই অসুস্থ অথচ আমার শারীরিক অবস্থা ও খাবার-দাবার নিয়ে সারাদিন উদ্বীগ্ন হয়ে থাকেন। মনে হয়, পঁয়ত্রিশ বছর আগে তোমাদের কিশোরগঞ্জের বাসার মতো তিনি পাশে বসে আমাকে খাওয়াচ্ছেন। সময়ের কী অদ্ভুত পুনরাবৃত্তি! কী নিষ্ঠুর নিয়তি! এ যেন অসীম শূন্যতার মধ্যে হাত বাড়ালেই জীবনের পরমাণুভূতি।

৫) তিলে তিলে গড়ে তোলা তোমার গার্হস্থ্য অর্থনীতি, কৃষিজপণ্য, ধান কাটার মৌসুমের দীর্ঘদিনের সাহায্যকারীগণ সবাই আছে। গাভী, গরু, কবুতরের বাসা, ফলদ বৃক্ষ, লতাগুল্ম সবই যে যার স্থান দখল করে আছে। মনে হয়, ছেলেরা এগুলো সহজে হারিয়ে যেতে দেবে না। তারা এখন বেশ পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত। যেখানে তোমার হাতের ছোঁয়া লেগে আছে সেখানেই তারা অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমার প্রবল আস্থা, তোমার মেয়ে এবং ছেলেরা এমন কষ্টার্জিত অর্জনগুলোকে কখনো অবহেলা করবে না। বরং একাগ্রতায় ধারণ ও লালন করবে।

৬) গত বছর শেষবারের মতো তোমাকে নিয়ে যে জায়গাটায় হেঁটে হেঁটে বলেছিলাম, ভবিষ্যতে এখানে একটি গার্লস স্কুল বা হাসপাতাল নির্মাণ করব। আর তুমি হবে এর প্রধান কর্ণধার। তুমি বলেছিলে, ‘আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয়, আমি এখন বিশ্রামে থাকব’। তখন বুঝতে পারিনি, এ কেমন বিশ্রামের কথা জানিয়েছিলে। সেদিন থেকে মাত্র তেরো দিন পরই তুমি চিরবিশ্রামের নামে হারিয়ে যাও।

এই একই জায়গায় আজ তোমার নামে কমিউনিটি ক্লিনিক হয়েছে। এটি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত ভাবনাপ্রসূত গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার এক অভূতপূর্ব তৃণমূল কেন্দ্র। সাধারণের প্রবেশাধিকারের এক অনন্য প্রতিষ্ঠান এটি। যুগ যুগ ধরে অসহায়, নিঃস্ব ও সুযোগবঞ্চিতদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার এক মহান অবলম্ব^ন হয়ে টিকে থাকবে এই মডেল ক্লিনিক। সঙ্গে তোমার নাম।

মানুষ তোমাকেই স্মরণ করে যাবে অনাগত কাল। আসলে তুমিই ভাগ্যবতী! তুমি অনন্যা! অসাধারণ এক বিদূষী নারী। তুমি আমার রত্নগর্ভা মহীয়সী। ভালো থেক।

 

লেখক : গবেষক ও গল্পকার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর