মঙ্গলবার, ১৫ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

মসজিদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী

আলম রায়হান

মসজিদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী

মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় দৃষ্টিনন্দন ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করছে সরকার। আরব বিশ্বের মসজিদ কাম ইসলামিক কালচারাল সেন্টারের আদলে এসব মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ৫০টি মডেল মসজিদের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ জুন।

আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত সুবিশাল এসব মডেল মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সে নারী ও পুরুষের আলাদা অজু ও নামাজ আদায়ের সুবিধা, লাইব্রেরি, গবেষণা কেন্দ্র, ইসলামী বই বিক্রয় কেন্দ্র, কোরআন হেফজ বিভাগ, শিশু শিক্ষা, অতিথিশালা, বিদেশি পর্যটকদের আবাসন, মৃতদেহ গোসলের ব্যবস্থা, হজযাত্রীদের নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণ, ইমামদের প্রশিক্ষণ, অটিজম কেন্দ্র, গণশিক্ষা কেন্দ্র ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থাকবে। এ ছাড়া ইমাম-মুয়াজ্জিনের আবাসনসহ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অফিসের ব্যবস্থা এবং গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা রাখা হয়েছে উল্লিখিত মডেল মসজিদ কমপ্লেক্সে।

কোনো দেশে সরকারিভাবে একই সময়ে এত বিপুলসংখ্যক মসজিদ নির্মাণ এটিই বিশ্বে প্রথম। আর শুধু রেকর্ড সৃষ্টি করা নয়, এ মসজিদের থাকছে যেমন বহুমুখী ব্যবহার, তেমনই এর রয়েছে সুদূরপ্রসারী বহুমাত্রিক প্রভাব। আলেম-ওলামাদের আশাবাদ এসব মসজিদের মাধ্যমে ইসলামকে সঠিকভাবে জানার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে ধর্মান্ধতা, উগ্রতা ও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া হ্রাস পাবে। আলেম-ওলামাদের এ আশাবাদের সঙ্গে অনেকেই একমত।

বোদ্ধা এবং নানান তত্ত্ববিদরা যতই জ্ঞানের কথা বলুন না কেন, আসলে ধর্মকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় মানবজীবন। মানুষের রাজনৈতিক চিন্তা, সাংস্কৃতিক চেতনা ও অর্থনীতিতে বিশেষ প্রভাববলয় সৃষ্টি করে ধর্ম। এক কথায়, জীবনের কেন্দ্রে রয়েছে ধর্ম। ঐতিহাসিকভাবেও তা সত্য। আবার কোনো কোনো দেশে ধর্মকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চিন্তার কারণে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িকতা। এ সাম্প্রদায়িকতার সামগ্রিক চরিত্র মধ্যশ্রেণির আর্থিক জীবনের রেষারেষির দ্বারা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনার গভীরে ধর্ম গভীরভাবে প্রোথিত; যা কোনোভাবেই উপড়ে ফেলা যায় না। যারা এ অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। চিন্তাবিদ বা দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাননি। ধর্মবিশ্বাসের বিপরীতে যারা দাঁড়িয়েছেন তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। অন্তত গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হননি। মানুষের মননে ধর্মের শক্তিশালী শিকড় এতটাই গভীরে যা উপড়ে ফেলা যায় না!

ধর্মবিশ্বাস মানুষকে সাধারণত পরিশীলিত করে, সঠিক পথে পরিচালনায় সহায়ক হয়। আবার এ ধর্ম ব্যবহার করেই মানুষকে করা হয় বিপথগামী। বিপত্তি এখানেই। ধর্মকে ব্যবহার করে নানান অধর্মের কমর্কাণ্ড যুগে যুগে দেশে দেশে চলে আসছে। এ শুধু মানবসভ্যতাকে বিপদগ্রস্ত করা নয়, খোদ ধর্মকে সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাওয়ারও এক অপকৌশল। যে অপকৌশলের প্রধান টার্গেট সম্ভবত এখন ইসলাম।

শান্তির ধর্ম ইসলামকে ব্যবহার করে বিশ্বময় এক ধরনের অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। ইসলামকে সন্ত্রাসবাদের সমার্থক হিসেবে দাঁড় করানোর অপকৌশল স্পষ্ট। আবার অঘোষিতভাবে ডারউইনের তত্ত্ব ব্যবহার করে এ সন্ত্রাসের হাত থেকে একেকটি জনপদ রক্ষার নামে মুসলমানদেরই নিধন করে চলেছে কথিত বিশ্বমোড়ল চক্র। আর এর ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয় ইসলাম রক্ষার নামে জিহাদের আওয়াজ দিয়ে একদল লোককে বিপথগামী করে। পাশাপাশি ইসলামকে চিহ্নিত করা হচ্ছে জঙ্গিবাদের সূতিকাগার হিসেবে। বিশ্বব্যাপী এ কুচক্রী তাণ্ডবের স্পষ্ট আঁচ লেগেছে বাংলাদেশেও। যদিও সাম্প্রদায়িকতার বিষয়ে জন্মলগ্ন থেকেই সতর্ক রয়েছে বাংলাদেশ।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুসারে সাম্প্রদায়িকতা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী বৈধতা হারায়, অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক বিধির আওতায় জামায়াত এবং ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো আবার প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায়। আর বিএনপির ২০-দলীয় জোটেও জামায়াতসহ ইসলামী রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য দৃশ্যমান। বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মহাজোটেও বেশ কিছু ইসলামী দল রয়েছে।

বড় দুই জোটের বাইরেও ইসলামভিত্তিক কিছু সংগঠন বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে বড় ‘ফ্যাক্টর’। এর মধ্যে প্রধান হলো হেফাজতে ইসলাম। শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশকে সমর্থন দিয়েছিল বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এবং সাফল্যের প্রায় দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। এমনকি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য নেতা নির্ধারণও করে ফেলেছিল। এই হচ্ছে রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহারের তাণ্ডবীয় উদাহরণ। কেবল বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই রাজনীতিতে ধর্মের বেশ প্রভাব রয়েছে, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

যদিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার অর্থাৎ ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা বেআইনি। এর পরও ধর্মের ভিত্তিতে একাধিক দল আছে এখানে। বড় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে ধর্মকে নানাভাবে ব্যবহার করে। সেক্যুলার এবং জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর রয়েছে ধর্মভিত্তিক অঙ্গসংগঠন। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের একটি বিএনপি, যারা নির্বাচনের আগে ইসলাম রক্ষার কথা বলে ভোট চেয়েছে। তাদের প্রচারণা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশে ইসলাম থাকবে না। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ভোটের রাজনীতিকে ‘টার্গেট’ করেই সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করেছিলেন। এরপর সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন ভোটের রাজনীতিকে ‘টার্গেট’ করেই। ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলে ধর্মকে ব্যবহারের এ ধারাই একসময় জঙ্গিবাদের পথ সুগম করেছে।

ঐতিহাসিকভাবে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমান আবার বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সুযোগ করে দেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে একসময় জঙ্গিবাদকে নানাভাবে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ একেবারে ভিত্তিহীন তা কিন্তু বলা যাবে না। যার মূর্তমান প্রকাশ হচ্ছে বাংলা ভাইয়েরা। এ পথ ধরে অসংখ্য বাংলা ভাই সৃষ্টি হয়েছে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের শক্ত অবস্থান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতার কারণে প্রায়-দানব হয়ে ওঠা জঙ্গিপ্রবণতা অনেকখানি দমন করা গেছে। হোলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ন্ত্রণের সাফল্য এর এক বড় প্রমাণ। আর এখানেই শেষ নয়, নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া চলমান। কিন্তু চূড়ান্ত বিবেচনায় চলমান এ প্রক্রিয়াই শেষ কথা নয়, হতেও পারে না। এ বিবেচনায়ই সরকার সম্ভবত মূলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এরই একটি দিক হচ্ছে সারা দেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ।

কোনো দেশে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রধানত ক্ষমতাসীনদের ধর্মবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্মরণ করা যেতে পারে, এ রকম অপচেষ্টা বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধেও করা হয়েছে এবং এ অপচেষ্টা যে একেবারে সফল হয়নি তা কিন্তু নয়। একই তরিকায় বঙ্গবন্ধুকন্যার সরকারের বিরুদ্ধেও অপপ্রচার চালানো হয়েছে। ‘ইসলামবিরোধী’ তকমা দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সব সময় কোণঠাসা রাখার চেষ্টা করে আসছে বিশেষ একটি গোষ্ঠী। ভোটের সময় এটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করে বিরোধী পক্ষ। অথচ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাবলিগ জামাতের জন্য কাকরাইলে মসজিদ ও টঙ্গীতে ইজতেমার জায়গা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদরাসা শিক্ষার প্রসারে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। কওমি মাদরাসার সনদ দিয়েছেন, আলিয়া মাদরাসার জন্য স্বতন্ত্র আরবি বিশ্ববিদ্যালয় করে দিয়েছেন। এর পরও অপপ্রচার আওয়ামী লীগের পিছু ছাড়ছে না।

আর এ অপপ্রচারে জোর হাওয়া লেগেছে ‘গো রক্ষা’র নামে ভারতে মুসলমানদের ওপর বর্বরতম নির্যাতন ও হত্যালীলায়। ভারতের এ ঘটনার দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া থেকে দেশকে রক্ষা করা গেছে। চাপা ক্ষোভ কিন্তু ঠিকই সৃষ্টি হয়েছে। যা এ জমিনে জঙ্গিবাদ সৃষ্টিতে মদদ দিয়েছে। আর এ মদদের বিপরীতে যুগান্তকারী ব্যবস্থা হচ্ছে সারা দেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন প্রক্রিয়া।

এর মধ্য দিয়ে ইসলাম প্রসঙ্গে শাসকদের মনোভাব কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অধিকতর স্পষ্ট হলো। একই সঙ্গে ইসলামের মূলবাণী প্রচারের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক টেকসই ব্যবস্থা হলো। এ উদ্যোগ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সুদূরপ্রসারী সুফল বয়ে আনবে। কেবল তাই নয়, পাশাপাশি একদল কাঠমোল্লার ধর্মব্যবসা কঠিন করে দেবে, রাশ টেনে ধরবে জঙ্গিবাদের।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর