মঙ্গলবার, ১৫ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

পাহাড়ে কাজুবাদাম চাষ

ড. মো. জামাল উদ্দিন

পাহাড়ে কাজুবাদাম চাষ

বাংলাদেশের এক-দশমাংশ পার্বত্যাঞ্চল। পার্বত্য জনগোষ্ঠীর একটি অতিপরিচিত ফসলের নাম কাজুবাদাম। এটি তাদের আয়ের অন্যতম একটি উৎস হিসেবে হাতছানি দিচ্ছে। পাহাড়ের একেক জনগোষ্ঠী একে একেক নামে ডাকে। চাকমা ভাষায় তাজুবাদাম বা তাংগুলো, মারমা ভাষায় বাদাংসি, বম ভাষায় ক্যাশনাক, ত্রিপুরা ভাষায় বাদাম-বাথাই আর চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষায় টাম এবং ইংরেজিতে ক্যাশনাট আর বাংলায় কাজুবাদাম নামে পরিচিত। যে যে নামেই ডাকুক না কেন তার কদর বাড়ছে দিন দিন। ২০-৩০ বছর ধরেই কাজুবাদাম পাহাড়ে চাষ হয়ে আসছে অনেকটা অবহেলিত অবস্থায়। তার কদর তখন কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। যুগের পরিবর্তনে এর চাহিদা বেড়ে এখন আকাশচুম্বী। আন্তর্জাতিক বাজারেও এর ব্যাপক চাহিদা। ফলে রপ্তানির একটা অমিত সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিশ^বাজারে রপ্তানি করতে হলে এর গুণগতমান সবার আগে বিবেচনায় রাখতে হবে। তার জন্য গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গবেষণার মাধ্যমেই উন্নত জাত উদ্ভাবন, মানসম্মত বাদাম উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমেই রপ্তানি সম্ভব। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কাজুবাদাম চাষ উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও রপ্তানির বিষয়ে বেশ আন্তরিক। ফলে নতুন নতুন প্রকল্পও গ্রহণ করছে; এ উদ্যোগ দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

দেশের সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্যের তালিকায় বাদাম-জাতীয় ফসলে কাজুবাদাম শীর্ষে রয়েছে। এ ফসলের যেমন রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব তেমন পুষ্টিগুণও। যা স্বাস্থ্যের জন্য বেশ চমকপ্রদ। কাজুবাদাম হৃৎপিণ্ডের জন্য শক্তিদায়ক, ডায়াবেটিসের জন্য উপকারী, হজমে সহায়ক, ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে, পিত্তথলি ও কিডনিতে পাথর তৈরিতে বাধা দেয়, রক্তশূন্যতায় কাজ দেয়, হাড় ও দাঁত গঠনে সাহায্য করে, ব্লাড প্রেসার কমায়, অবসাদ দূর করে, ভালো ঘুম আনয়নে সাহায্য করে। পাহাড়ি অঞ্চলকে কাজুবাদাম চাষ সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের দ্বার বলা যায়। এ অঞ্চলের আবহাওয়া, জলবায়ু, মাটি সবই কাজুবাদাম চাষের জন্য বেশ উপযোগী। তা ছাড়া এখানে বহু পতিত ভূমি রয়েছে। কাজুবাদাম চাষের মাধ্যমে যা আবাদের আওতায় আনা সম্ভব। দেশে যে পরিমাণ কাজুবাদাম উৎপন্ন হয় তার অর্ধেক আসে বান্দরবান পার্বত্য জেলা থেকে। উন্নত জাতসহ আধুনিক চাষাবাদে সহায়তা পেলে পুরো তিন পার্বত্য জেলায় এ কাজুবাদাম চাষের বিপ্লব ঘটবে। যেহেতু কাজুবাদাম একটি উষ্ণমণ্ডলীয় ফল তাই খরা অবস্থায়ও এটি টিকে থাকে। কাজুবাদাম চাষে খরচ তুলনামূলক অনেক কম। পোকা-মাকড়ের আক্রমণও তেমন হয় না বললেই চলে। যেসব রোগবালাই সচরাচর দেখা যায় তা দমন করা গেলে উৎপাদন আরও বাড়বে। বর্তমানে প্রতি হেক্টরে কাজুবাদামের গড় উৎপাদন (ফলন) ১.৫-১.৮ টন বলে জানা যায়। গবেষণার মাধ্যমে এর উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব।

লাভের দিক বিবেচনা করলে কাজুবাদাম একটি অত্যন্ত লাভজনক ফসল। কেননা এ শুধু বাদাম নয়, এর বহুমাত্রিক ব্যবহার বিদ্যমান। বলা যায় একই অঙ্গে বহুরূপ। বাদামের খোসা থেকে উৎপাদিত তেল দিয়ে উৎকৃষ্টমানের জৈব বালাইনাশক, ভিনেগার, অ্যালকোহল তৈরি করা যায় বলে বিশেষজ্ঞদের মত রয়েছে। বাদামের সঙ্গে লাগোয়া ওপরের ফল থেকে জুস তৈরি করা যায়। এ কাজু অ্যাপল ফলে ৮০ শতাংশ জুস থাকে। এটি ওষুধিগুণ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। এ জুসে কমলালেবুর চেয়ে ৬ গুণ বেশি ভিটামিন সি পাওয়া যায়। এসব প্রক্রিয়াজাত জুস বেচেও অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব। প্রতি ৩.৫-৪.০ কেজি খোসাযুক্ত বাদাম থেকে ১ কেজি প্রক্রিয়াজাত বাদাম পাওয়া যায়। যার গড় বাজারমূল্য প্রতি কেজি ৭০০-১২০০ টাকা। আর খোসাযুক্ত বাদামের কৃষক পর্যায়ে মূল্য ৫০-৬০ টাকা। মূলত প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এ বাদামের অধিক মূল্য পাওয়া সম্ভব। তাই প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। বর্তমানে রাঙামাটি, বান্দরবানের মুসলিমপাড়া ও চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় প্রক্রিয়াজাত কারখানা রয়েছে। উৎপাদান বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কারখানা বাড়ানো দরকার।

পাহাড়ে কাজুবাদাম চাষে প্রধান চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান জাতের উৎপাদন বাড়িয়ে চাষিদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। কাজুবাদাম গাছের শিকড় অগভীর হওয়ায় ফলবান বড় গাছ ঝোড়ো হাওয়ায় উপড়ে পড়ে যায়। এটা রোপণ পদ্ধতি সঠিক না হওয়ার কারণেও ঘটে। কাজুবাদাম সংগ্রহ, শুকানো ও সংরক্ষণের ব্যাপারে কৃষক উদাসীন ও অনভিজ্ঞ। কাজুবাদাম পাকা অবস্থায় গাছ থেকে ঝরে পড়ে। কৃষক মাটি থেকে সঠিক সময়ে সংগ্রহ না করায় মাটির সংস্পর্শে এসে বা বৃষ্টির পানিতে ভিজে কালো হয়ে যায় এবং গুণগতমান নষ্ট হয়। ফলে বাজারমূল্য অনেক কমে যায়। তা ছাড়া বেপারীদের দৌরাত্ম্য তো আছেই। এ ক্ষেত্রে ঝরে পড়া বাদাম তাড়াতাড়ি সংগ্রহপূর্বক ভালোভাবে শুকিয়ে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা দরকার। অধিক উৎপাদনশীল জাত প্রবর্তন, আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশল, সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতকরণ বিষয়ে চাষিদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান জরুরি। প্রক্রিয়াজাতকারী কারখানায় গ্রেডিং করে মানসম্মত বাদাম সরবরাহ করা গেলে অধিক মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। সেই সঙ্গে উত্তম কৃষি চর্চা (গ্যাপ) নীতিমালা অনুসরণের মাধ্যমে মানসম্মত কাজুবাদাম উৎপাদন করতে পারলে রপ্তানির সুযোগ বাড়বে বহুগু।

লেখক : জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাবেক ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

ইমেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর