শিরোনাম
বুধবার, ১৬ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

জাতীয় বাজেট : অর্থমন্ত্রীর ভানুমতীর খেল

জাফরুল্লাহ চৌধুরী

জাতীয় বাজেট : অর্থমন্ত্রীর ভানুমতীর খেল

রাস্তার মোড়ে বানর নিয়ে বাজিকরের ভানুমতীর খেলা সবাই উপভোগ করে, খুশি হয়ে দু-চার টাকাও ছুড়ে মারে, খেলা শেষ হওয়ার পর আগের বাস্তবে ফিরে আসে, দুঃখভরা মনে বাড়ি ফেরে।

২৫০ বছরেও মৃত লর্ড মেকলের কালো ইংলিশম্যান বানানোর স্বপ্ন থেকে ভারতবাসী মুক্তি পেল না। কালো ছোট সুটকেস নিয়ে অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংসদে প্রবেশ করেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে গতানুগতিক বাজেট পড়ে শুনিয়ে হাততালি নিয়ে খুশিমনে পড়া শেষ করেন। বাজেটে কার জন্য কী থাকবে তা নির্ভর করে অর্থমন্ত্রীর সামাজিক শ্রেণিচরিত্রের ওপর। বর্তমান অর্থমন্ত্রী জাতীয় বাজেট ২০২১-২২ জাতিকে সংসদে পড়ে শোনানোর আগে তাঁর পার্টির মধ্যে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেছেন কি? প্রস্তাবিত বাজেট সাত দিন ধরে জনগণকে দেখতে দিলে, পড়তে দিয়ে আলোচনা করার সুযোগ দিলে কি সংবিধান অশুদ্ধ হয়ে যাবে? জনগণের মতামত, প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে চূড়ান্ত বাজেট অর্থমন্ত্রী সংসদে পেশ করলে বাজেটের গুরুত্ব বাড়ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রস্তাবটা বিবেচনা করে দেখুন।

অর্থমন্ত্রী গুণী চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তিনি বড় ব্যবসায়ী ও করপোরেট হাউসের হিসাবপত্র ঠিক করে দিয়ে থাকেন। তাই বাজেটে তিনি মূলত ব্যবসায়ী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের খুশি করেছেন। অর্থমন্ত্রীর পেশা ও শ্রেণিচরিত্র হেতু আমলা-তোষণ ও আমলাদের খুশি করতে পিছপা হননি। আমলারা এ দেশের সরকার চালায়, একেক সচিব ঢাকায় বসে জেলা নিয়ন্ত্রণ করেন নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমলাদের জন্য ব্যয় বরাদ্দ ১১.৮% এবং তাদের পেনশন বাবদ ৭.৭% রাখা হয়েছে। সর্বোচ্চ ব্যয় আমলাদের জন্য। চলতি বছরে আমলাদের জন্য ব্যয়িত হয়েছে ৫৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। আমলাদের গাড়ি কেনার জন্য বিনা সুদে ৩০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয় এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ৫০  টাকা। ঋণের টাকায় কেনা গাড়ি ৬৫% সরকারি কর্মকর্তা ব্যবহার করেন না। উবারে ভাড়া খাটাতে পাঠিয়ে দেন অতিরিক্ত আয়ের জন্য। তারা একাধিক সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন। নিজে একটা এবং পরিবার-পরিজন দ্বিতীয়টি। মারহাবা! মারহাবা!!

কিছু ভালো সিদ্ধান্ত : উপকৃত হচ্ছে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এবং ব্যবসায়ীরা। প্রথমত, ২ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে, বাড়ির নকশা অনুমোদন করতে, সমবায় সমিতির নিবন্ধনে এবং ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমে অংশগ্রহণের জন্য, মোটরসাইকেল, গাড়ি, জায়গাজমি, ফ্ল্যাট কিনতে হলে অবশ্যই ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর (TIN) দেখাতে হবে। আরও নিয়ম করা প্রয়োজন যে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির টিআইএন নম্বর থাকতে হবে এমনকি আয়করযোগ্য আয় না থাকলেও কিংবা বেকার হলেও। এজন্য বছরে মাত্র ২০০ টাকা টিআইএন (TIN)  রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হবে। গৃহকর্মীদের, রিকশা-ভ্যান, বেবিট্যাক্সি, মোটরগাড়ি চালকদের টিআইএনের জন্য বছরে ২০০ টাকা ফি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেবেন বাড়ির কর্ত্রী ও গাড়ির মালিকরা। কৃষিশ্রমিকদের রেজিস্ট্র্রেশন করাবেন জমির মালিকরা। এতে প্রায় নতুন ২ কোটি লোক ইনকাম ট্যাক্স নিবন্ধনের আওতায় আসবেন যারা আগামী পাঁচ বছরে ইনকাম ট্যাক্স দেওয়ার উপযুক্ততা অর্জন করবেন। ন্যূনতম ফি বাবদ বছরে আয় হবে ২০০ টাকা = ২ কোটি = ৪০০ কোটি। ভবিষ্যতে বেকার ভাতা প্রচলন করলে এ পদ্ধতি সুফল দেবে।

দ্বিতীয়ত, দেশে বর্তমানে টিআইএন আছেন ৬১ লাখ। কিন্তু আয়কর রিটার্ন জমা দেন ২৫.৪৩ লাখ মাত্র।

বাংলাদেশ স্বল্প আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে কিন্তু মনোবৃত্তির পরিবর্তন হয়নি। জনগণের আয় বেড়েছে কিন্তু সরকারের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। ফলে হয়রানি, তদবির ও দুর্নীতির ব্যাপক প্রসারে জনগণ আয়করের জন্য নিবন্ধিত হতে চায় না। ব্যক্তিগত আয় ৩ লাখের পরিবর্তে ৫ লাখ টাকা অবধি শূন্য আয়কর আওতা আনা যুক্তিসংগত হবে এবং ব্যক্তিগত আয়কর ২০%-এর অধিক হওয়া উচিত নয়।

রাজস্ব বৃদ্ধির সহজ উপায় : বিদেশে বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসবাসকারী বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে লব্ধ টাকা ‘হুন্ডির মাধ্যমে’ বিদেশে স্থানান্তর করেন। অধিকাংশ  ছেলেমেয়ে সরকারকে ন্যূনতম একটা ট্যাক্স দিয়ে বৈধ পথে বিদেশে-আমেরিকায় টাকা নিতে আগ্রহী, কিন্তু কোনো নিয়ম নেই। সম্পত্তি বিক্রয়লব্ধ অর্থ ১০% ট্যাক্স দিয়ে বৈধ পথে বিদেশ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।

অর্থমন্ত্রী ছোট ব্যবসার বিনিয়োগকারী নারীদের ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়করমুক্ত করে ভালো প্রণোদনা দিয়েছেন। মধ্যবিত্তের গৃহস্থালি ও বসবাসে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির উৎপাদনকে ১০ বছর ‘ট্যাক্স হলিডে’ দিয়ে স্বচ্ছ চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন। তবে ভ্যাট প্রত্যাহার ভুল সিদ্ধান্ত। স্মরণ প্রয়োজন, মূল রাজস্ব আসে ভ্যাটের মাধ্যমে ৩৮.৭%। দ্বিতীয়ত আয়কর থেকে ৩১.৮%। ব্যবসায়ীদের মিষ্টি কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে উভয় ক্ষেত্রে ন্যূনতম ২৫% রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্যোগ নিন। তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের চাকরি দিলে কর রেয়াত ভালো পদক্ষেপ। তবে ১০০ জনের সীমা নামিয়ে ১০ জনে সীমিত করুন। ভ্যাট পরিশোধ সময়মতো না করলে সরল সুদের জরিমানা সঠিক পদক্ষেপ।

সব মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সামগ্রীর (অ্যানালাইজার, ক্যাথ ল্যাব, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, ডিফিবরিলেটর, ভেন্টিলেটর, কার্ডিয়াক মনিটর, সিটি অ্যাপারাটাস হাসপাতাল শয্যা, ব্লাড ব্যাংক, সিরিঞ্জ পাম্প, সার্জিক্যাল স্টেরাইল গ্লাভস, বায়োসেফটি কেবিনেট প্রভৃতি) ওপর সকল প্রকার শুল্ক, অগ্রিম ইনকাম ট্যাক্স (AIT) এজেন্সি ট্যাক্স (AT) প্রত্যাহার করে নিন। সব আমদানি থেকে অগ্রিম ইনকাম ট্যাক্স প্রত্যাহারের জন্য ব্যবসায়ীদের দাবিও বিবেচ্য।

হেমোডায়ালাইসিসের প্রত্যেক রোগীর জন্য একটি ব্লাড টিউবিং ব্যবহার করতে হয়, তার ট্যাক্স ছিল ২৫%। তা কমিয়ে ৫% করেছেন এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। কারও বিকল কিডনি সমস্যা হলে ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে গিয়ে রোগী সর্বস্বান্ত হয়ে যায় তিন বছরের মাথায়। এজন্য সব দরিদ্র বিকল কিডনি রোগীকে প্রতি হেমোডায়ালাইসিসের জন্য ১ হাজার টাকা ভর্তুকি দেওয়া উচিত। বর্তমানে সরকার ভারতীয় কোম্পানি ‘স্যানডর’-কে প্রতি রোগীর হেমোডায়ালাইসিসের জন্য ২ হাজার ২০০ টাকা ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে পাঁচ বছর ধরে। বিকল কিডনির সর্বোত্তম চিকিৎসা হচ্ছে কিডনি প্রতিস্থাপন। দেশে প্রয়োজন প্রতি বছর ১০ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন, কিন্তু দেশে প্রতিস্থাপন হয় ২০০-এর অনধিক। বেশির ভাগ রোগী একজনকে সঙ্গে নিয়ে যান ভারতে, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, আমেরিকায়। এতে প্রায় হাজার কোটি টাকা বিদেশে ব্যয়িত হয়। এজন্য মূলত দায়ী স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। তারা গত দুই বছর ধরে হাই কোর্টের নির্দেশ পালন করছে না। হাই কোর্ট একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছে যে নিকটাত্মীয় ছাড়াও অনাত্মীয় ব্যক্তি বা বন্ধুর জন্য যে কেউ স্বেচ্ছায় কিডনি দান করতে পারবেন।

ফোয়ারার যন্ত্রপাতির ট্যাক্স ৫% থেকে কমিয়ে ১% করে ভুল করেছেন, প্রকৃতপক্ষে এটা নিদেনপক্ষে ১০% হওয়া উচিত।

চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি : অন্য একটি ভালো কাজ করেছেন স্থানীয়ভাবে ওষুধশিল্পের প্রায় সব কাঁচামালের (Active Pharmaceutical Ingredient-API) রেয়াতি সুবিধা দিয়ে। দেশে API উৎপাদন হলে সব ওষুধ কোম্পানিকে স্থানীয় API কোম্পানি থেকে কাঁচামাল কেনা বাধ্যতামূলক করুন। অন্য কোথাও থেকে আমদানি করা যাবে না। এর ওপর প্রত্যেক API কোম্পানিকে রপ্তানির জন্য আগামী পাঁচ বছর ২৫% নগদ প্রণোদনা (Cash Incentive) দেওয়া প্রয়োজন বিশেষত ভারত ও চীনের উৎপাদক কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সামর্থ্য অর্জনের জন্য। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ৯২টি দেশে ওষুধের কাঁচামাল রপ্তানির যে তথ্য দিয়েছেন তা সঠিক নয়। বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করে, ওষুধের কাঁচামাল রপ্তানি করে না।

মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ক্যান্সার ও হৃদ রোগের কতক ওষুধে রেয়াতি সুবিধা দিয়েছেন, এতে ওষুধ প্রস্তুতকারকরা লাভবান হবেন, কিন্তু ওষুধের দাম কমবে না। ফলে সরকারের সৎ উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। ওষুধের মূল্য জনগণের ক্ষমতার মধ্যে আনতে হলে ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি অধ্যাদেশের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়মাবলি যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বর্তমানে ১১৭টি ওষুধ, ভ্যাকসিন, পরিবার পরিকল্পনার সামগ্রী ছাড়া অন্যসব ওষুধের মূল্য ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিসমূহ নিজেরা সরাসরি স্থির করে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে জানিয়ে দেয়। ঔষধ প্রশাসন কেবল মূসক (ভ্যাট) যুক্ত করে ওষুধের মূল্য ঘোষণা করে। এটি মূল্য নির্দেশক (Indicative Price) পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতি যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে ওষুধের  খুচরা মূল্য (Maximum Retail Price) ন্যূনপক্ষে ৫০% কমে আসবে। তিনটি শুল্ক দরের পরিবর্তে একটি শুল্ক স্থির করুন দুর্নীতি কমবে।

বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত অনেক কাঁচামালের শুল্ক কমিয়েছেন এসআরও ১১৪/২০২১-এর মাধ্যমে। এখানে একটি বড় ভুল করেছেন, কয়েক ক্ষেত্রে ০%। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৫%, কয়েক ক্ষেত্রে ১৫% শুল্ক ধার্য করেছেন, এতে সমস্যা হবে, দুর্নীতি হবে। তিনটির (০%, ৫%, ১৫%) পরিবর্তে একটি শুল্ক দর স্থির করে দিন।

সব আমদানিকৃত খাদ্য ও বিকারক (Reagents) চিনিযুক্ত কনফেকশনারি, সাবান বাদে এক শুল্ক দর করে দিন। আপনি স্থির করেছেন সাবানের শুল্ক ২৫% এবং কনফেকশনারিতে ৬০%। সুগন্ধি সাবান, বিদেশি কনফেকশনারি শুল্ক ও সম্পূরক সমেত ২০০% করুন। এগুলো দেশে তৈরি হয়, আমদানি অপ্রয়োজনীয়, বিলাসিতা মাত্র।

২০০% শুল্ক ও সম্পূরক কর প্রয়োগ হওয়া উচিত আমদানিকৃত টাইলস, মারবেল এবং বিদেশি মদ ও সিগারেটের ওপর। মদের ওপর মাত্র ২৫% কাস্টমস ডিউটি কোনোক্রমে গ্রহণযোগ্য নয়।

ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রীর রেগুলেটরি ডিউটি ১০%, ১৫%, ২৫%-এর পরিবর্তে সব ক্ষেত্রে একটি দর হওয়া উচিত। তাতে হয়রানি কমবে, দুর্নীতি রহিত হবে।

মোপেড ও অ্যাম্বুলেন্সের আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করে মধ্যবিত্তদের খুশি করেছেন। তবে এসব ক্ষেত্রে একাধিক শুল্কের পরিবর্তে সব ক্ষেত্রে ২০% বা ২৫% একদর স্থির করুন। সব প্রয়োজনীয় মেডিকেল যন্ত্রপাতিযুক্ত ২০০০/৩৫০০ সিসির শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অ্যাম্বুলেন্স আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে ২০% স্থির করুন।

শিল্পের কাঁচামালের একাধিক রেয়াতি শুল্ক ০%, ৫%, ১০%, ১৫% প্রভৃতি থাকায় ব্যবসায়ীদের প্রতি কনসাইনমেন্ট খালাসের সময় হয়রানি, দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা ও অফিসারদের সঙ্গে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের দরাদরির সুযোগ থাকছে। সহজ সুরাহা হলো এক শুল্ক দর করে দেওয়া ৫% বা ১০%।

ফ্লোমিটারযুক্ত অক্সিজেন সিলিন্ডারে সকল প্রকার অগ্রিম আয়কর, শুল্ক সম্পূরক ও অন্যান্য সব করমুক্ত করে ব্যাপক আমদানির সুবিধা করে দিন।

মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা বৃদ্ধি : লাখ অনধিক মুক্তিযোদ্ধার মাসিক ভাতা ১২ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করে আপনি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী তাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, মুক্তিযোদ্ধারা যখন দেখবেন করোনার কারণে চাকরি, ব্যবসাচ্যুত তার পাশের বাড়ির দরিদ্র পরিবার সপ্তাহের কোনো না কোনো দিন প্রায় অনাহারে দিনপাত করছে, তখন কি মুক্তিযোদ্ধা আহার গ্রহণ করতে পারবেন?

কৃষকের প্রতি নজর দিন। কালবৈশাখী ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ১ লাখ কৃষকের জন্য ২৫ কোটি টাকা রেখেছেন। মনটা বড় করুন। নিদেনপক্ষে ৫ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিন। বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ সংরক্ষণ, কফি, কাজুবাদাম, হলুদ, আদা পাহাড়ি এলাকায় চাষাবাদ প্রণোদনা বাবদ ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দিন। দেশি উৎপাদন থেকে শিশুখাদ্য উৎপাদন ও কৃষিযন্ত্র উৎপাদনকারী শিল্পকে ১০ বছরের করমুক্ত সুবিধার প্রস্তাব করেছেন। অথচ সরাসরি কৃষকের পানি সেচ, সার, বীজে পর্যাপ্ত ভর্তুকি, কৃষি উৎপাদন ও বাজারজাত করার জন্য সমবায় সৃষ্টি করে সিন্ডিকেট ভাঙার কোনো পদক্ষেপের উল্লেখ নেই।

সরকারের একটি ন্যক্কারজনক বিধান, অন্যটি আনন্দের।

সরকারের দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা- প্রথমটি কান্নার, পুলিশকে কবজার মধ্যে এনে, জনগণের স্বার্থবিরোধী ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মামলার ভয় দিয়ে জনগণের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করেছে। দ্বিতীয়টি শেখ হাসিনা সরকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী পরিবারকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে গ্রামবাসীর মুখে হাসি ফুটিয়েছে। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ২২৭ মেগাওয়াটে উন্নীত করায় বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৯৯ শতাংশ উন্নীত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

অর্থমন্ত্রী মিথ্যাচার করেছেন দারিদ্র্যের হারের ব্যাপারে, দরিদ্রতা কমে ২০.৫ শতাংশ হয়নি, বরং কভিড প্রভৃতির কারণে ৪২% উন্নীত হয়ে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা অন্যূন ২ কোটি বেড়েছে। কুইক রেন্টালের দুর্নীতির ব্যাপারে একটি শব্দও বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী তোলেননি।

বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি (এফবিসিসিআই) সভাপতি জসিম উদ্দিন প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘ব্যবসা ও বিনিয়োগ বান্ধব’ বলেছেন। অর্থমন্ত্রী বিড়ি-সিগারেট, মদ, গুলে ট্যাক্স না বাড়ানোয় এবং করপোরেট ট্যাক্স কমানোয় ব্যবসায়ীরা খুশি হয়েছেন। এনার্জি পানীয়তে ৫০% ও মদে ২০০% শুল্ক ধার্য করা ন্যায়সংগত হবে। সিগারেটের স্তর অনুসারে ১০ শলাকার মূল্য ৬০ থেকে ২০০ আর বিড়ি ২৫ শলাকার মূল্য ৫০ টাকা স্থির করুন, সঙ্গে একই সম্পূরক শুল্ক ৬৫%। বাজার, লঞ্চঘাট, স্টেশন, পার্ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালত প্রাঙ্গণ এবং সব পাবলিক প্লেসে ধূমপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইন করতে হবে, ন্যূনতম জরিমানা ১ হাজার টাকা অনাদায়ে সাত দিন জেল হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালত ও অন্যসব পদে ধূমপায়ীদের নিয়োগ আইন করে রহিত করা বাঞ্ছনীয়।

আগামী ১৫ বছরে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা প্রায় ২৫০ মিলিয়নে উপনীত হবে। একটি কেন্দ্র থেকে এত বড় দেশ শাসনের চেষ্টা হাস্যকর ও বিপজ্জনক বটে। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে বাংলাদেশ ক্রমে মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হবে। বিগত ১০ বছরে গণতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে গেছে, রাতের আঁধারে আমলা-পুলিশরা ভোট ডাকাতি করে ভোটবিহীন নির্বাচনের অপূর্ব (?) উদাহরণ সৃষ্টি করেছে পৃথিবীতে। সুষ্ঠু গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের পূর্বতন জেলাসমূহকে ভিত্তি করে বাংলাদেশকে ১৭টি স্টেট/প্রদেশে বিভক্ত করা প্রয়োজন। জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৫০-৭০ জন স্টেট সংসদ নির্বাচিত হবেন। বিরোধী দল থেকে ‘স্পিকার’ ও ন্যায়পাল (Ombudsman) মনোনীত হবেন। স্টেট মন্ত্রিসভায় ১০ জন অনধিক মন্ত্রী থাকবেন, তার মধ্যে ন্যূনতম তিনজন মহিলা। রাষ্ট্রপতি মনোনীত করবেন স্টেট/প্রদেশ গভর্নর। পররাষ্ট্র, বৈদেশিক বাণিজ্য, আন্তস্টেট যোগাযোগব্যবস্থা, বিমান ও সমুদ্র বন্দর, আয়কর শুল্ক ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, প্রতিরক্ষা, বর্ডার গার্ড, উচ্চশিক্ষা ও প্রান্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা (Tertiary Health Care) কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে, সুপ্রিম কোর্ট ঢাকায় থাকবে। কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের আকার ২/৩ কমানো হবে। প্রতি স্টেটে পাঁচজন বিচারপতির একটি হাই কোর্ট থাকবে, দুজন বিচারপতি ডিস্ট্র্রিক্ট জজ থেকে হাই কোর্টের বিচারপতি পদে উন্নীত হবেন। সুপ্রিম কোর্ট হাই কোর্টের নজরদারি করবে। স্টেট রাজধানী, হাই কোর্ট, স্টেট সংসদ ও সচিবালয়, নতুন শিল্প বিদ্যালয়, প্রান্তিক হাসপাতাল, সংসদ, মন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিচারপতি ও সিনিয়র আমলাদের বাসস্থান নির্মাণের জন্য সর্বোচ্চ ১০০ একর জমি/ভূমি দখল করার প্রয়োজন হবে। বর্তমান জাতীয় বাজেটে ন্যূনতম ১২% বরাদ্দ দিন। ন্যূনতম ৫০ হাজার জনসাধারণ লিখিতভাবে আবেদন করলে তা অবশ্যি স্টেট সংসদে আলোচিত হবে।

লেখক : ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।

সর্বশেষ খবর