শিরোনাম
শুক্রবার, ১৮ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

বেসরকারি ভার্সিটির আয়ে করারোপের প্রস্তাব প্রসঙ্গে

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

বেসরকারি ভার্সিটির আয়ে করারোপের প্রস্তাব প্রসঙ্গে

সম্ভবত এখন বাজারে সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ে ১৫ শতাংশ কর ধার্যের প্রস্তাব। এ প্রস্তাব পেশের আগে থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি তার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। বাজেট প্রস্তাব পেশের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেনের প্রতিবাদটি সম্ভবত সাম্প্রতিককালে সর্বাধিকসংখ্যক প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় পত্রপত্রিকার লেখালেখিতে না হোক টকশোয় বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। একপর্যায়ে শোনা গেল যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর প্রস্তাবিত কর প্রস্তাব বাতিল করতে যাচ্ছেন। পরে দেখা গেল বিষয়টি গুজব।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির বক্তব্য হচ্ছে, তাদের কোম্পানি আইনে নিবন্ধিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একই বন্ধনী যুক্ত করা হয়েছে যা অবৈধ, কেননা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ট্রাস্ট আইনে পরিচালিত যার উদ্বৃত্ত আয় একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ছাড়া অন্য কোনো খাতে ব্যবহার নিষিদ্ধ। এ মর্মে একটি মামলায়ও এনবিআর হেরেছে বলে মনে হয়। সমিতি আরও বলে যে করোনার দাপটে খাবি খাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করারোপের কারণে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অনেকে এ যুক্তি গ্রহণ করতে রাজি নন। তারা বলেন, কারও আয় না থাকলে বা লোকসান হলেই তারা তো করমুক্ত। সমিতির সভার আলোচনায় দেখা যায়, একবার এ কর বসানো হলে কর কর্তৃপক্ষের পাথর চেপে পানি সিঞ্চন কৌশলের কারণে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আর উদ্বৃত্ত আয়ে থাকবে না। তাদের কিছু না কিছু কর দিতেই হবে। এমনকি বর্তমানে কাক্সিক্ষত ৭.৮০ কোটি টাকার করের পরিমাণ হয়তো সর্বসাকল্যে ৪৫ কোটি টাকায় উন্নীত হবে। তবে তার ফলে মাত্র ২০-২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যগুলো অকাল মৃত্যুবরণ করবে। তখন সরকারকেই এসবের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে এবং কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার দায়ভার তৎক্ষণাৎ নিতে হবে। এমনকি বিদেশ গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীদের অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের এক বিরাট অংশও ব্যয় করতে হবে। তা ছাড়া প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে প্রদত্ত বিভিন্ন নামের বিপুলসংখ্যক বৃত্তি প্রদান থেমে যাবে কিংবা সংকুচিত হতে হবে। আয়কর আরোপিত হলে তার অভিঘাত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ওপর নিপতিত হওয়ার আশঙ্কায় ছাত্রদের একাংশ আন্দোলনের হুমকি দিয়ে বসে আছে। এখনই অভিঘাতের সম্ভাবনা ক্ষীণ, তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেঁচে থাকলে কোনো না কোনো দিন করের অভিঘাত শিক্ষার্থীদের ওপর বর্তাবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন একজন সংসদ সদস্য। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভায় উপস্থিত অন্যান্য সংসদ সদস্য অনেক বিষয়ে আলোকপাত করে করের বিষয়টি অর্থমন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্বরিত নজরে আনার পরামর্শ দেন। তারা সরকারের সঙ্গে দেনদরবার ছাড়াও সংসদে বিষয়টি উত্থাপনের আশ্বাস দিয়েছেন।

অর্থমন্ত্রীকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। সরকারপ্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনার নজরে আনার জন্য একটি চিঠি সমিতি তার বরাবর দিয়েছে। সভায় আলোচিত সব কথা চিঠিতে স্থান পায়নি। কেউ কেউ এ কথাও বলেছেন যে সর্বোচ্চ ৪৫ কোটি টাকা কর হিসেবে প্রাপ্তির আশায় বা আকাক্সক্ষায় এত বড় বদনামের বোঝা কেন একটি জনপ্রিয় ও মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি সরকার গ্রহণ করতে যাবে? সভায় ইউজিসির ২০১৯ সালের পরিসংখ্যানের বরাতে বলা হয়েছে, ২০১৯ অর্থবছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় হচ্ছে ৩৬৩১৫৮.১২ লাখ টাকা আর ব্যয় হচ্ছে ৩৫৮০০১.৮৮ লাখ টাকা অর্থাৎ উদ্বৃত্ত হচ্ছে ৫৮.৬৪ কোটি টাকা। ১৫% হারে এ উদ্বৃত্ত আয়ের ওপর কর আসবে ৮.৮০ কোটি। এই সামান্য পরিমাণ করের জন্য একটা অবৈধ ও অনৈতিক পদক্ষেপ অবাঞ্ছিত বটে। সময়ে হয়তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড়জোর ৪৫ কোটি টাকা কর হিসেবে সরকারি কোষাগারে আসতে পারে, করোনাকালে তা-ও সম্ভব হবে না। করারোপের ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ লক্ষাধিক না হোক বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্ব সরকারের কাঁধে বর্তাবে। এ খাতের প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কি দুর্দশা হবে, তা-ও বিবেচ্য।

অন্য এক বক্তা বললেন যে টেকনিক্যাল, নন-টেকনিক্যাল নির্বিশেষে একজন ছাত্রের স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের জন্য সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে ২১ লাখ টাকা সরকার ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। ৫ লাখ শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিলে ভর্তুকির পরিমাণ নির্ণয় কঠিন নয়।

বাইরে আলাপ করে দেখেছি যে জনগণ বলে, তার চেয়ে যারা কাজকর্মহীন শতভাগ বেতন-ভাতা ভোগ করছেন তাদের সে সুযোগ ১০ ভাগ কমিয়ে দেওয়া হোক। অনেকে কালো টাকা সাদা করার অবাধ সুবিধা চাচ্ছেন। এটা অসম ব্যবস্থা, অনৈতিকও বটে। তবে তার সুফল বিবেচনায় নিয়ে অন্য প্রসঙ্গগুলো ভুলে যাওয়ার পরামর্শ অনেকের। কালো টাকা থেকে সরকার বিগত সালে বিশাল অঙ্কের কর পেয়েছে। এ সাদা টাকা করজালে আবদ্ধ হলে ক্রমে তা সন্তান দান করতে থাকে।

ব্যাংক বা সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখলে সুদ আসবে যার ওপর কম করে ১০ ভাগ কর দিতে হবে। আবগারি শুল্ক দিতে হয় উচ্চহারে আর বছর শেষে সম্পদকর গুনতে হবে। এ টাকা বিনিয়োগ করলে কর্মসংস্থান হবে আর খরচ করলে ভ্যাট বা ব্যয়কর দিতে হবে, অর্থাৎ সরকারি কোষাগার স্ফীত হবে। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণও কমিয়ে আনা যাবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাদাকরণের সুফল প্রণিধানযোগ্য। কালো টাকা বালিশের নিচে থাকে বা সিন্দুকে থাকে, বিদেশে পাচার হয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে চাঁদা হিসেবে দিয়ে আখিরাতের পথ পরিষ্কার করার নামে জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করে কিংবা রাজনৈতিক হানাহানি বা প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তারে ব্যবহৃত হয়। ৩১৩ ব্যক্তি যারা হেফাজত ইসলামকে অর্থ দিয়েছেন, তা কি মনে হয় সম্পূর্ণ সাদা টাকা? সরকারের অনুকূল সাড়া পেলে সব কালো টাকাই একদিন সাদা হবে। মুদ্রাস্ফীতিও কমে যাবে উল্লেখযোগ্য হারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে খুদ খেয়ে পেট নষ্ট অর্থাৎ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর প্রস্তাবিত করটা আরোপ না করাটাই যুক্তিসংগত। বাজেট প্রস্তাব পেশের পর ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও কালো টাকা সাদা করার উপায় অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছে। ক্ষুদ্র ও মধ্যম শিল্পপতিরা এবং বিশেষত অনানুষ্ঠানিক খাতের বিনিয়োগকারীরা অধিক হারে অনুদান ও সহায়ক কর্মকান্ড চলমান করার আবেদন জানিয়েছেন। তাদের দাবি অযৌক্তিক নয়, কেননা তারা প্রায় ৮০ ভাগ কর্মসংস্থান করেন।

বেসরকারি খাতের শিক্ষকদের উচ্চারিত দাবি-দাওয়াও অযৌক্তিক নয়, তবে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধির কারণে তাদের গাত্রদাহ শুধু অন্যায্য নয়, অনৈতিক ও অকৃতজ্ঞতার চরম বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে না লড়লে আজকে এই বাংলাদেশকে কোথাও টর্চ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যেত না। আমাদের বিশাল অর্জনের মূলে এই যোদ্ধারা। অনেক সুস্থ-সমর্থ ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি, তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা না করলেও আমি তাদের ‘ধামড়া’ বলি। ১৯৭১ সালে তাদের যুদ্ধে জড়াতে কেউ বারণ করেনি। যুদ্ধের সুফল তাদের ভোগের কথা ছিল না। তাই মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান-সন্ততিদের ভাতার ব্যাপারে তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করেই তবে তাদের দাবির কথা জানানো উচিত। স্মরণ রাখতে হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের এক বিশালাংশ ছিল শিক্ষকতার পেশায়। আমি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। আমরা শুধু যুদ্ধে জড়াইনি, আমরা সংগ্রামে ও লড়াইয়ে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছি বলেই এত তাড়াতাড়ি বিজয়টা অর্জিত হয়েছে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে শিক্ষকদের কিছু দাবি-দাওয়া পূরণ সম্ভব এবং শিক্ষার্থীদের অনলাইন শিক্ষা-উপযোগী কাঠামো ও স্বচ্ছন্দ বৃদ্ধি সম্ভব।

যোদ্ধাদের মধ্যে অনেক কৃষক ও শ্রমিক ছিল। করোনাকালে তারা আমাদের বল-ভরসা তবে দুর্দশাগ্রস্ত, তবু এ দুঃসময়ে আমাদের খাইয়ে-পরিয়ে রাখছে। তাদের হয়ে কথা বলার খুব কম মুখই দৃশ্যমান। একটা বন্যা হলে করোনা পরিস্থিতিতে দুর্ভোগের কথা মনে রেখে কৃষি ও কৃষকের প্রতি নজর দেওয়া বাঞ্ছনীয়। কালো টাকা সাদা করার অবাধ সুযোগ দিলে এবং করভিত্তি সম্প্রসারিত করে নির্মোহভাবে তা আদায় করলে বিদেশ থেকে টাকা ধার করে বাজেট ঘাটতি পূরণের প্রয়োজন সামান্যই হবে। সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ ক্রয়সীমার ওপর উচ্চহারে সুদ নিশ্চিত করে ক্রমে নিম্নহারের কয়েকটি স্লাব সৃষ্টি করে সরকারি কোষাগারে অর্থের স্ফীতি ঘটানো সম্ভব।

কিছু কিছু ব্যবসায় করোনার কারণে রমরমা অবস্থা। আমি নয় সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিবারের কথা জানি। এ পরিবারটি কেবল করোনা টেস্ট করার জন্য ৭০ হাজার টাকা ব্যয় করেছে; ওষুধ ও ডাক্তারের খরচ বাদ দিলাম। বিবেচ্য যে সে পরিবারের যা ব্যয় তা কারও না কারও আয়। এ আয়ের ওপর করারোপ ও তা নিষ্ঠার সঙ্গে আদায় হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খুদ পরিমাণ করারোপের মাধ্যমে পাহাড় পরিমাণ সংকট সৃষ্টি অপ্রয়োজন হবে। চূড়ান্তভাবে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের প্রতিটি পদক্ষেপ সরকারি উদ্যোগেই প্রতিহত করতে হবে।

সভায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক দৈন্যের চিত্রও ফুটে উঠেছে। তারা অনুদান ছাড়াও অতীতে অবৈধভাবে আদায়কৃত কর ও ভ্যাট প্রত্যাবর্তন দাবি করেছে। আশা করি সরকার এ বিষয়টির প্রতিও নজর দেবে।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও সমাজ পরিবর্তনের লড়াকু সৈনিক।

সর্বশেষ খবর