শনিবার, ১৯ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও সচেতনতা

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও সচেতনতা

সম্প্রতি ‘করোনাসহ স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং সার্বিক সচেতনতার মাধ্যমে নিরাপদ আগামী’ শীর্ষক একটি জনসচেতনতামূলক অনলাইন আলোচনার আয়োজন করেছিল পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন। সম্মানিত জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ড. সাবিনা ইয়াসমিন আমাকে ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, সিভিল সার্জন মো. ফজলুর রহমানসহ একাধিক সম্মানিত ব্যক্তি আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা পেশা ও শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থাকায় দেশের প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে আমার ধারণা স্বচ্ছ। মূল আলোচনায় আমার অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষের জন্য তুলে ধরেছিলাম। আমার আলোচনার সূচনা করেছিলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আমাদের নির্ভরতার প্রতীক শেখ হাসিনার কর্মউদ্দীপনাবিষয়ক বক্তব্যর মাধ্যমে। দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতার পর আমি ঢাকা শহরে আসি ১৯৮৯ সালে। ওই সময় থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একজন চিকিৎসক হিসেবে তাঁকে দেখাশোনার সুযোগ ঘটে। তাঁকে সুধা সদন, গণভবন এমনকি স্পেশাল কারাগারে অবস্থানকালীন চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সুধা সদনের দ্বিতল বাড়িতে দোতালায় একটি রুমে তিনি থাকতেন। ওই রুমে বসে নিয়মিত পড়াশোনা করতেন। সেখানে আমার প্রবেশাধিকার ছিল। একবার তাঁর জ্বর হলো। তিনি বেডরুম থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি। তখন তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী। মন্ত্রী পদমর্যাদা ছিল। তাঁর রুমে খাটিয়াটার পাশে একটা জায়নামাজ দেখেছি। পাশে কোরআন শরিফ। তিনি ঘুম থেকে জেগে নিয়মিত নামাজ পড়েন। কোরআন পাঠ করেন। একেবারে সাধারণ এবং সারল্যে ভরা তাঁর জীবন। আবার কঠোর পরিশ্রমী মানুষ। তিনি সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরও তাঁর কঠোর পরিশ্রম, পাঠ্যাভ্যাস, মানবিকতা একটুও পরিবর্তন হয়নি। আমার মনে হয়েছে মানুষের সেবা করাই তাঁর জীবনের ব্রত। তিনি কঠোর পরিশ্রমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ে তোলায় দৃঢ় প্রত্যয়ী। আর আমাদের কাজ তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ পি জে আবদুল কালাম যেমনটি বলেছিলেন, ‘স্বপ্ন সেটা নয়, যেটা মানুষ ঘুমিয়ে দেখে। স্বপ্ন সেটাই, যেটা পূরণের প্রত্যাশা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চিন্তা বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে কাজ করছেন দেশের প্রশাসনসহ সব পর্যায়ের কর্মকর্তা, কর্মচারী। আমার মূল আলোচনায় ফিরে আসি। পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ‘করোনাসহ স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং সার্বিক সচেতনতার মাধ্যমে নিরাপদ আগামী’ শীর্ষক অনুষ্ঠান প্রাসঙ্গিক ও প্রশংসনীয় আয়োজন। পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক ড. সাবিনা ইয়াসমিন একজন স্বপ্নবান মানুষ। তিনি পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকারে মাঠে নেমেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, নারীর সচেতনতার মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তন সম্ভব। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তিনি ‘কন্যারত্ন’ নামে একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য, কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করা। বাল্যবিয়েকে না বলা। মাদককে না বলা। পাশাপাশি আত্মরক্ষার কৌশল ও ক্ষমতায়নের জন্য মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ। এ উদ্যোগ জেলার পাঁচটি উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ চলছে। ১৭ মার্চকে প্রতীক হিসেবে ধরে ১ হাজার ৭০০ কিশোরীকে বাইসাইকেল বিতরণ করা হয়েছে। এ উদ্যোগ তাদের আত্মনির্ভরশীল হতে ভূমিকা রাখবে। তাদের মধ্যে গড়ে দিচ্ছেন সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ। এ ছোট্ট উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই। কারণ এ উদ্যোগের মাধ্যমে নারীর আত্মনির্ভরশীলতা, মর্যাদা ও সম্মানবোধ গড়ে উঠবে। তারাই গড়ে তুলবে সোনার বাংলা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়নকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সুতরাং শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ডিসি মহোদয়ের এ প্রশংসনীয় উদ্যোগ দেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি। আমি ডাক্তার হব, আমি ইঞ্জিনিয়ার হব, আমি পুলিশ অফিসার হব, আমি ব্যুরোক্র্যাট হব, ফরেন সার্ভিসের ক্যাডার হব- এ স্বপ্নটা দেখতে হবে নিজের জন্য। আত্মমর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। সুতরাং নিজেকে তৈরির এখনই সময়। ড. এ পি জে আবদুল কালাম গুড গভর্নেন্স বইয়ে লিখেছেন- রাষ্ট্রের উন্নতি তখনই হবে যখন গ্রামের সঙ্গে শহরের যে পার্থক্যটুকু আছে সেটা সামান্য সুতার মতো হবে। পার্থক্য থেকে যাবে, সে পার্থক্যটা কমিয়ে একটা সূ²রেখার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো ব্যবধান থাকবে না। নারী, পুরুষ উভয়ই সমান অধিকার নিয়ে সমাজে কাজ করতে পারবে। ডিসি মহোদয় একা একা সব কাজ করবেন তা ঠিক নয়। এ জন্য প্রয়োজন সবার আন্তরিক সহযোগিতা। আমি আর একটা কথা আপনাদের সামনে শেয়ার করব, সেটা হলো একজন বলেছিলেন আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে। তখন আমরা ছোট ছিলাম। আমার অবশ্য এখন ৬৯ বছর বয়স। ছেলেবেলায় আমরা ছিলাম নো জেনারেশন। আর এখন আমাদের সন্তানরা হলো ইয়েস জেনারেশন। এই নো জেনারেশন আর ইয়েস জেনারেশনের পার্থক্য আছে। আমরা স্কুলে যেতাম সকালবেলায়। মা আমাদের সামান্য একটু গরম ভাত, একটু ঘি অথবা একটা ডিম সিদ্ধ দিয়ে বলতেন-এটা খেয়ে চলে যাও। যদি কখনো বলতাম না এটা খাব না, মা হয়তো বোঝানোর চেষ্টা করতেন। মায়ের ওপর রাগ দেখানো সন্তানের জন্মগত অধিকার। মায়ের ওপর যখন রাগ দেখানো হতো তখন তিনি বলতেন, কেন খাবা না? আমি বলতাম, টাকা দাও আমি স্কুলে গিয়ে কিনে খাব। তখন বাবা বলতেন-তুমি খাবা। মানে, এরপর কিছু মার খাব। আমাদের কোনো মাফ ছিল না। বাবা-মা যেটা বলেছেন, তা শ্রদ্ধায় মেনে নিয়েছি। এখন আমাদের কন্যারা ইয়েস জেনারেশন হয়ে গেছে। আমার নাতনিও যখন আমার বাসায় এসে বলে-আমি এটা খাব না। তখন আমি বলি-তুমি কি কেএফসি খাবা? তুমি কি পিৎজা খাবা। সে যা খেতে চায় সেটাই দেওয়া হয়। এর কিন্তু বিপরীত ক্রিয়া আছে। আমরা বাড়ির খাবার উপেক্ষা করে, ফাস্টফুড খেতে উৎসাহিত করছি। এতে তাদের অসুখ, বিসুখ বাড়ছে।

সারা বিশ্ব এখন করোনা মহামারী মোকাবিলা করছে। করোনাবিষয়ক টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। তারপরও চিকিৎসকরা বলছেন, নিজের স্বাস্থ্য সচেতনতা জরুরি। নিজের স্বাস্থ্য পরিচর্যা নিজেকেই করতে হবে। তাহলে আমাদের আগামী দিন নিরাপদ হবে। আমি মনে করি, যার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দুটোই নিশ্চিত সে সমাজের টপ-কোয়ালিটির মানুষ। তাছাড়া মানুষ নিয়মানুবর্তী হলে জীবনীশক্তি বাড়ে।

একজন প্রযুক্তি বিশারদ বলেছিলেন-আমরা এখন প্রযুক্তির সাগরে ডুব খাচ্ছি। প্রযুক্তি যেমন একটা অভিশাপ তেমনি এটা একটা আশীর্বাদ। এ সম্পর্কে এ পি জে আবদুল কালামের একটা মন্তব্য আছে, প্রযুক্তি হলো দুদিকে ধারালো একটা অস্ত্র। দুদিকে কাত করলে কাটবে। তার মানে প্রযুক্তি অপব্যবহার হলেই তুমি নিজের জীবনকে জীবন ধ্বংস করবে, সমাজকে ধ্বংস করবে, রাষ্ট্রকে ধ্বংস করবে। আর প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করলে তোমার চিন্তার জগৎ প্রসারিত হবে। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল যে টেলিফোনের আবিষ্কার করেছিলেন অর্থাৎ ল্যান্ডফোন সেটা ছিল মাইক্রো ভোল্টেজ ইলেকট্রিসিটি দ্বারা পরিচালিত। সেই মাইক্রো ভোল্টেজ ইলেকট্রিসিটির সঙ্গে ম্যাগনেটিক ইমপালসকে যোগ করে দিয়ে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ইমপালস করে আজকের এ প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানো হয়েছে। বিল গেটস তাঁর তিন সন্তানকে ১৬ বছরের আগে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেননি। কারণ তিনি জানতেন এ ইলেকট্র্রোম্যাগনেটিক ইমপালস মানুষের মস্তিষ্কে দীর্ঘক্ষণ ব্যবহার করার জন্য কী পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে। সভ্যতার একটি দিক সমাজকে কলুষিত করছে। এ সভ্যতা কিন্তু তার নিজেকে, তার সমাজকে, তার পরিবারকে হারিয়ে ফেলেছে। একটা বাচ্চা মোবাইল দেখে দেখে খায়। মা তাকে খাওয়াচ্ছে, আর সে মোবাইলে গেমস খেলছে। সে জানে, যতক্ষণ খাবে মা তাকে ততক্ষণ খাওয়াবে, আর সে তত মোবাইল দেখতে পাবে। এতে করে বাচ্চারা ওভারফেট হচ্ছে। উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে চাইলে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। আফ্রিকান নারী ওয়ানগারি মাথাই পৃথিবীতে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার জন্য বৃক্ষরোপণ আন্দোলন করে নোবেল জয় করেছেন। অর্থাৎ তিনি এক একটি গাছের মাধ্যমে কেবল স্বপ্ন বুনে দিয়েছিলেন। ঠিক সে কাজটি করছে কন্যারত্ন প্রজেক্ট। উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন বুনে দিয়েছেন।

১৯৬০ সালের অলিম্পিকে যে মহিলা তিনটি স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন তাঁর নাম ওইলমা রোদলফ। তাঁর তিন বছর বয়সে নিউমোনিয়া হয়েছিল, স্কারলেট ফিভার, পোলিও হয়েছিল। তিনটি রোগের কারণে তাঁর প্যারালাইডস হয়। তাঁর মাকে ডাক্তার বলেছিলেন, ‘সে লেখাপড়া করতে পারবে কিন্তু কোনো দিন পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারবে না।’ তার মা বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। ৯ বছর বয়সে তিনি পায়ের ওপর ভর দিয়ে হাঁটতে শেখেন। ১৩ বছর বয়সে তিনি স্কুলে গিয়ে তাঁর গেম টিচারকে বলেছিলেন, আমি এ স্কুলের সবচেয়ে দ্রুততম মানুষ হতে চাই। কিন্তু স্কুল লাইভে তিনি সব প্রতিযোগিতায় লাস্ট হতেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে তাঁর গেম টিচারকে বলেন- আমি বিশ্বে দ্রুততম নারী হতে চাই। তাঁর টিচার তাঁকে বলেছিলেন, তোমাকে আমি সাহায্য করব। পরে তিনি একের পর এক রেকর্ড গড়েন। আমি আত্মবিশ্বাসের কথা বলছি।

আমার বক্তব্যের শুরুতে একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের কথা বলেছিলাম। যার কারণে বাংলাদেশের মর্যাদা সম্মান সুদৃঢ় হয়েছে। আমাদের কন্যারত্নরা কঠোর পরিশ্রম, শিক্ষা, মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসে এক দিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর