রবিবার, ২০ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনার সঙ্গে সাম্প্রতিক সংলাপ

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

করোনার সঙ্গে সাম্প্রতিক সংলাপ

ইদানীং বড্ড ব্যস্ত সে। বেশ কয়েক দিন ধরে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। গেল বছর আগস্ট মাসে করোনার সঙ্গে যে ‘আলাপ আলাপন’ হয় সে সময়েই তার একটি উক্তি এখনো প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে- “কোনো কোনো দেশের প্রতি আমার একটা আলাদা টান আছে। আমি ভেবে রেখেছিলাম সে সব দেশে রয়ে সয়ে যাব, কিন্তু তারাই তো তা করতে দিচ্ছে না। যেমন ‘সবসময় পাশে থাকা’র কথা বলে সেসব জনপদের জনতাকে দৈব-দুর্বিপাকে উপায়-উপকরণ প্রতিরোধ-প্রতিষেধক ছাড়া ছুড়ে দেওয়া হয়। সর্বশক্তিমানের দয়ায় এবং সর্ব সাধারণের নিজস্ব ভূমিকা-ভোগান্তিতে যদিওবা যেটুকু সাফল্য আসে তা আবার আত্মসাৎ করে নিজেদের একক সাফল্য বলে গর্ব করার, সেটা দেখিয়ে খাই খরচে, খোলামেলা জনসমাগমে, পরিভ্রমণে, এমনকী টিকা রাজনীতিতে ব্যর্থতার ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানোর রেওয়াজ বাড়ছে। এই অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতার দোহাই দিয়ে, পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচে সবাইকে বোকা ভাবার এবং দায়-দায়িত্বহীন হয়ে পার পাওয়ার সুযোগ সন্ধান সংস্কৃতি যে সমাজে সচল, সে সমাজে মৌনতার মানসিক যন্ত্রণা করোনার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এসব দেশে আমি করোনা থাকব কি থাকব না কিংবা কত দিন থাকব সে বিবেচনার বল তো তাদের কোর্টে।’

সেকেন্ড রাউন্ডে উঠছি উঠছি বলতে বলতে নিউজিল্যান্ডের মাঠের সেই আম্পায়ারের মতো বাংলাদেশের টার্গেট নিয়ে সবাইকে ভুল বার্তা দেওয়া কেন হলো, অনেককেই নানান উৎসাহ উৎসব আয়োজনে মাতিয়ে তোলার জন্য কিনা বোঝা যায় না। ঘরে-বাইরে এখন নবউদ্যমে থলের বিড়াল বেরোতে শুরু করেছে। পাশের বাড়ির বেহাল অবস্থা দেখে, ঠিক এ সময় খোদ করোনার মতামত মনোভাব জানা জরুরি মনে করছি। কিন্তু তাকে কীভাবে ধরা যায়? যাদের মাথায় নয় কে ছয় বানানো বা তিলকে তাল করার বুদ্ধি প্রায়ই ছক্কা মারায় অভ্যস্ত তাদের ধরব কিনা এসব ভাবছি; ঠিক এ সময়, হঠাৎ, মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো, স্বয়ং করোনাকে হাসিমুখে, সংক্রমণে নয় সংলাপের জন্য সামনে হাজির পেলাম। গত বছর মার্চ-মে-তে তাকে তরতাজা যেমন দেখেছিলাম এখন দেখি সে আরও বেশি হৃষ্টপুষ্ট, তবে কিছুটা রুষ্ট মনে হলো। দুই মিটার দূর থেকেই জানতে চাইলাম, ‘কী খবর? সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বরে বেশ হালকা মনে হচ্ছিল, এখন কেমন?’ ভারী অথচ চানক্যীয় কূট-কায়দায় করোনা বললে, ‘আমাকে দেখে যেমনটা ভাবা হচ্ছে। তবে প্রথমেই ডিসক্লেমার দিতে চাই, কোথায় এবং কখন আমাদের এই সংলাপ হচ্ছে এটা প্রকাশ না পাওয়া ভালো, দেশে দেশে এমন কিছু আইন চালু আছে তাতে এই সংলাপের কিছু অংশ আবার ভাইরাল হলে বিপদ’, কোনো কোনো দেশে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর আইনের দিকে ইঙ্গিত করল মনে হলো। ঠিক আছে।’ আশ্বস্ত করলাম। না করে উপায়ও নেই, কেননা তার কাছে থেকে কথা বের করতে হবে। তাকে রিমান্ডে নেওয়াও যেমন যাবে না, ৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি তো দূরের কথা। করোনা যথাসম্ভব ভাব-গাম্ভীর্য ও সচেতন সতর্কতার সঙ্গে শুরু করল-‘এক মাঘে যেমন শীত যায় না, যুগে যুগে মহামারী যখন আসে, মোটামুটি দুই-তিন বছরের পরিকল্পনা নিয়েই আসে, ইচ্ছে করলেও সহজে যেতে চায় না বা দেওয়াও হয় না, তাকে গজেন্দ্রগামী হতেই হয়, ভোল পাল্টানোর কৌশলপত্র রপ্ত করেই সে আসে। তবে বলে রাখি অতীতের চাইতে এবার আমার গতিবিধি রীতি ও নীতি নির্মাণে ধড়িবাজি আর ব্যবসায়িক স্বার্থ বা ভেদবুদ্ধির ভূমিকা বেশি।” রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর করোনার বড় ডিগ্রি আছে মনে হলো।

জানতে চাইলাম, “দ্বিতীয় ধাক্কার প্রয়োজন ছিল কি এবং এবার ‘হঠাৎ’ করে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?” তির্যক তাকিয়ে করোনা বলে উঠল, এটাকে ‘হঠাৎ’ এবং ‘দ্বিতীয় ধাক্কা’ কেন বলা হচ্ছে তা আমার মাথায় আসছে না। আমি বহাল তবিয়তে অব্যাহত আছি, দেশ থেকে দেশান্তরে যেতে মাঝে মাঝে একটু দম নিয়েছি সত্য, অনেক দেশে ধাক্কার সিরিয়াল নম্বর নামজারি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এটা বলতে পারি ধাক্কার রকম ফের ঘটেছে দেশে দেশে ক্ষমতাবানদের স্রেফ ভেদবুদ্ধির কারণে, যখন দেখা গেছে সামনে বড় বড় ফাঁড়া, যখন মোড় ঘোরানো দরকার হয়েছে, তখন করোনা তুমি থেকে যাও না আরও কটা দিন, যাকে ধরবার তাকে ধরি আর অন্যদের একত্র হতে করতে পারি নিষেধ। আমাকে নতুন করে আসতে হয়নি, আমি যেমন ছিলুম তেমনিই আছি। নিজেদের সুখ ও স্বপ্ন পূরণের উপায় হিসেবে তারা একবার আমার এপিঠ আরেকবার ওপিঠ দেখিয়েছে।’ তাকে থামাবার পথ খুঁজছিলাম, কেননা তার কথাবার্তা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। আমার বরং জানা দরকার এখন তার আসল মতলব কী আর আমরা কীভাবে তাকে সামলাব। করোনা সশিক্ষিত, সংশপ্তক ও চতুর্বেদী, আমার কপালের ভাঁজ পড়তে পেরেই,’ অনেকে মনে করছেন আমি বেশ ভয়ংকর রূপে এবার এসেছি, আসলে তা নয়, এটি তাদের উপলব্ধির বিভ্রাট। প্রথম থেকে যে ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সবাই, সেখানে সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য যে সময় সকলে পেয়েছেন তার সদ্ব্যবহার করা হয়নি বলেই আমাকে আজ ভয়াবহ বলা হচ্ছে, মনে হচ্ছে। সংক্রমণ টেস্ট গণবান্ধব করতে না দিয়ে, হাসপাতালগুলোতে সেবা সক্ষমতা না বাড়িয়ে, চিকিৎসা-সরঞ্জাম সরবরাহসহ সবকিছুকে নিজেদের ব্যবসার আওতায় আয়ত্তে রাখতে গিয়ে, বেসরকারি খাত যারা এগিয়ে আসতে চেয়েছিল তাদের এ কথা সে কথা বলে আসতে না দিয়ে, বড়দের আয়-ব্যয়ের বাজেট অব্যাহত রাখতে গিয়ে ছোটদের পথে বসিয়ে যে কিম্ভূতকিমাকার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সেখানে আজ করোনা আমি নতুন আসামির কাঠগড়ায়...’ ‘না না তা হবে কেন, সবাই যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন, করছেনও...’, আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়েই করোনা বলল, ‘আপনাদের সমস্যা আমি জানি, বুঝি বলেই বলছি। আমি বুঝি যে কথা আপনারা বলতে পারবেন না সে কথা আমাকে বলতে হচ্ছে। যাক রাজা-উজির মেরে সময় নষ্ট না করে কাজের কথায় আসি,’ দেখলাম করোনা বিজ্ঞজনোচিত আবহে ফিরে আসছে,’ আমাকে মোকাবিলায় মনোবল বজায় রাখুন, চিকিৎসা সেবাকে জটিল করার বা ভাবার দরকার নেই, প্রতিরোধে জোরদিন প্রতিষেধকের আশায় থাকা কমিয়ে আনুন। মনে করে দেখুন কলেরা ডায়রিয়ার রোগীকে পানি খেতে দেওয়া হতো না সংক্রমণের ভয়ে, অথচ পরে প্রমাণিত হয়েছে খাবার স্যালাইনই প্রতিরোধের প্রকৃষ্ট পন্থা। করোনা প্রতিরোধ ক্ষমতা আপনার হাতেই। সবাই তিনটি বিষয় বা ‘অভ্যাস’কে মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে মেনে চলুক- সামাজিক দূরত্ব¡ বজায়, মাস্ক ব্যবহার এবং ঘন ঘন হাত ধোয়া। নিজের সুস্থতা যাচাইয়ের জন্য প্রতিদিন সকালে নিজের তাপমাত্রা মাপা, লম্বা দম নিয়ে ১০-১৫ সেকেন্ড ধরে রেখে তারপর ছেড়ে দেওয়া, এভাবে অন্তত তিন-চারবার শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করা দরকার। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ করণীয় এখন- বাসায় থাকলে দিনে একবার, একটু-আধটু বাইরে গেলে দিনে দুবার এবং বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে দিনে তিনবার ফুটন্ত পানির ভাঁপ নেওয়া।’ সামাজিক দূরত্বকে অসামাজিকতার স্তরে নিয়ে যাওয়ার যুক্তি নেই। ২ মিটার বা সাড়ে ৬ ফুট বা প্রায় ৫ হাত ‘দৈহিক দূরত্ব’ বজায় রেখে চলতে হবে। এখন উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ দুশ্চিন্তায় দুর্ভোগে ভোগার পরিবর্তে বরং বেশি মনোযোগ দিতে হবে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে, বন্ধু-বান্ধব, মুরব্বি স্নেহভাজনদের সাহস-সহানুভূতি প্রকাশ বাড়ানোতে। সবার সঙ্গে সহজ যোগাযোগের সুবাদে নিজেদের মধ্যকার অবনিবনার অভিযোগ অনুযোগের মিটমাট, ক্ষমা চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে সাংসারিক পারিবারিক সামাজিক শান্তির সন্ধান মিলবে। এর ফলে সংশয়, সন্দেহ, আক্ষেপ ও দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনার ব্যাকটেরিয়া খতম হতে পারে। নিয়মকানুন মেনেই ঘরের বাইরে যেতে হবে। কারও সঙ্গে সরাসরি বা সামনা-সামনি হয় কথা বলা এড়িয়ে চলতে হবে। বাইরে থেকে ঘরে ফিরেই হাতমুখ ধোয়া ও পরনের কাপড় পাল্টাতে হবে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়ার সময় কোনো কথা না বলা। সভা-সেমিনার সম্মেলন অনলাইনে অংশগ্রহণ, সভায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা সীমিতকরণ, সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত হওয়া এবং আলো-বাতাসের জন্য জানালা খোলা রাখা। যেসব দেশে বা স্থানে এখনো আমি আছি সেখানে ভ্রমণ না করা ভালো। বদ্ধঘর বা জায়গা, বেশি ভিড়ভাট্টা এবং কারও সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশা পরিহার করা। কোনো সংকীর্ণ জায়গায় বেশিক্ষণ না দাঁড়ানো। এসব মেনে আমার সঙ্গে সহ অবস্থানের নীতি গ্রহণ করুন, বললাম তো আমি সহজে নির্মূল নিরাময় হওয়ার অবস্থায় নেই। সবশেষ প্রেসক্রিপশন হলো যার যার সৃষ্টিকর্তার প্রতি একাগ্রচিত্ত হওয়ার বিকল্প নেই, কেননা তিনিই ত্রাতা, তিনিই নিরাময়ের নিয়ন্তা, তার কাছেই ফিরতে হবে সবাইকে।’ করোনার এহেন মহানুভবতায় বিমুগ্ধ আমি যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম তখন তথাকথিত লকডাউনে আমাদের আঙিনায় খেলাধুলায় মত্ত বিড়াল ছানাটিও মন খারাপ করে চুপচাপ বসে আছে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ খবর