রবিবার, ২০ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা
বাজেট ভাবনা

তামাকের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই

জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুল মালিক, জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান

তামাকের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগসমূহের প্রাদুর্ভাব এক চরম স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও অসংক্রামক রোগসমূহ যেমন- হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ক্যান্সার, কিডনিরোগ এবং লিভারের রোগ ক্রমেই বাড়ছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে মোট মৃত্যুর শতকরা ৬৭ ভাগই ঘটছে অসংক্রামক রোগের জন্য। এসব অসংক্রামক রোগের পেছনে অন্যতম কারণ তামাকের বহুল ব্যবহার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুসারে বাংলাদেশে প্রায় পৌনে চার কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। আর কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় তিন কোটি ৮৪ লাখ মানুষ। তামাকের ব্যবহারের এই ব্যাপকতা জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। টোব্যাকো অ্যাটলাস অনুসারে, তামাকজনিত নানা রোগে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ এবং বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা ও উৎপাদনশীলতার ক্ষতি হিসেবে প্রতি বছর ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। এসবের বাইরে তামাক চাষের ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হওয়া, তামাক প্রক্রিয়াজাত চুল্লির জ্বালানি হিসেবে বনভূমি নষ্ট হওয়াকে আমলে নিলে তামাকের ক্ষতি আরও বড় আকারে ধরা পড়বে।

তামাকজনিত নানা রোগে মৃত্যু এবং আর্থিক ক্ষতি প্রতিরোধ করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন কঠোরভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ। বিশ্বজুড়ে তামাক নিয়ন্ত্রণের বেশ কিছু পরীক্ষিত পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তামাকের দাম বাড়িয়ে সহজলভ্যতা কমানো, শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, তামাক ক্রয়-বিক্রয়ে বিধিনিষেধ আরোপ ইত্যাদি। তামাকের ব্যবহার কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্য বাড়ানো। কার্যকরভাবে কর বাড়ালে তামাকপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পায় এবং সহজলভ্যতা হ্রাস পায়। ফলে তরুণরা তামাক ব্যবহার শুরু করতে নিরুৎসাহিত হয়। পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীদের মধ্যে যারা তামাক ব্যবহার করে তারাও তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয়।

কিন্তু দুঃজনক হলো, বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরের বাজেটে তামাকপণ্যের ওপর কাক্সিক্ষত হারে কর আরোপ করা হচ্ছে না। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। সেখানে শুধু উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটে প্যাকেটপ্রতি ৫ টাকা ও ৭ টাকা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ, শলাকাপ্রতি দাম বাড়বে মাত্র ৫০ পয়সা ও ৭০ পয়সা। অপরদিকে নিম্ন ও মধ্যম স্তরের সিগারেটের কর ও দাম বাড়ানো হয়নি, যদিও সিগারেট ব্যবহারকারীদের প্রায় ৮০ শতাংশই এই দুই স্তরের সিগারেট ব্যবহার করে। একই অবস্থা বিড়ি এবং জর্দা-গুলের মতো ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যে। এগুলোর দামও অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।

গত এক বছরে জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৯ শতাংশ। এই আয় বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতিকে বিবেচনায় নিয়ে তামাকপণ্যের দাম না বাড়ানোর ফলে এসব ক্ষতিকর পণ্যের প্রকৃতমূল্য কমে গেছে। ফলে কিশোর-তরুণদের কাছে এসব আরও সহজলভ্য হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে দাম না বাড়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীও তামাক ছাড়তে নিরুৎসাহিত হবে।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার কমাতে সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে নিম্নস্তরের সিগারেটের মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা। কারণ সিগারেট বাজারের সিংহ ভাগ (৭২%) দখল করে রেখেছে এই স্তরের সিগারেট। পাশাপাশি বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়াতে হবে যাতে ব্যবহারকারীরা তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয়। তামাকপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি কর আহরণ নীতির বাস্তবায়ন আরও জোরদার করতে হবে। মনে রাখা দরকার, বিশ্বের প্রথম কোনো সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। তার এই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে প্রতি বছর তামাক ব্যবহারকারী সংখ্যা কমে এবং নতুন করে কেউ এতে আসক্ত না হন। আর সেজন্য তামাকপণ্যে কার্যকরভাবে কর বসিয়ে মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে এর সহজলভ্যতা কমানোর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুল মালিক, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এবং জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান, সভাপতি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি।

সর্বশেষ খবর