রবিবার, ২০ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

সুদ কেন হারাম?

মো. আমিনুল ইসলাম

সুদ কেন হারাম?

সুদ কী? আরবি রিবা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো বৃদ্ধি, অতিরিক্ত, বেশি ইত্যাদি। কোনো পণ্য, দ্রব্য বা অর্থের বিনিময়ে অতিরিক্ত পণ্য, অর্থ বা দ্রব্য আদায়ের কাজই হলো রিবা বা সুদ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের জন্য এ সুদকে হারাম করেছেন আর ব্যবসাকে করেছেন হালাল। সুদ হলো একটি অত্যাচারী আর নিকৃষ্টতম প্রথা। এর কারণে সম্পদ একশ্রেণির মানুষের কাছে গচ্ছিত থাকে আর সমাজে সৃষ্টি হয় শ্রেণিবৈষম্য। পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারায় আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদার লোক, তোমরা সুদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। তোমাদের কাছে আগের সুদি কারবারে যে সব বকেয়া আছে তোমরা তা ছেড়ে দাও, যদি সত্যিই তোমরা ইমানদার হও।’ আয়াত ২৭৮। পরবর্তীতে আয়াতে আল্লাহ আরও সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘আর যদি তোমরা এমনটি না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা থাকবে, যদি তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে আস তাহলে তোমরা তোমাদের মূলধন ফিরে পাওয়ার অধিকারী হবে, তোমরা অন্যের ওপর জুলুম কর না, তোমাদের ওপরও অতঃপর কোনো ধরনের জুলুম করা হবে না।’ আয়াত ২৭৯। আয়াতে পরিষ্কারভাবে এ আদেশের বিরুদ্ধাচরণকারীদের কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে এবং যদি সুদ পরিহার করা না হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণার কথা বলা হয়েছে। কুফরি ও বড় গুনাহ ছাড়া আর কোথাও এ ধরনের বড় শাস্তির কথা কোরআনে বলা হয়নি। (সূত্র : মারুফুল কোরআন)। এরপর এই আয়াতে আরও বলা হয়েছে, ‘যদি তোমরা তওবা করে ভবিষ্যতের জন্য বকেয়া সুদ ছেড়ে দিতে সংকল্পবদ্ধ হও তবে তোমরা আসল মূলধন ফেরত পেয়ে যাবে। মূলধনের অতিরিক্ত আদায় করে তোমরা কারও ওপর জুলুম করতে পার না, আর কেউ মূলধন কমিয়ে বা পরিশোধে বিলম্ব করে তোমাদের ওপর জুলুম করতে পারবে না। যদি তোমরা তওবা কর এবং ভবিষ্যতে সুদ ছেড়ে দিতে প্রতিজ্ঞা কর তবেই তোমরা মূলধন ফেরত পাবে। তার মানে, সুদ ছেড়ে দেওয়ার সংকল্প করে তওবা না করলে মূলধন ফেরত পাওয়া যাবে না।

আল্লাহ আরও বলেন, ‘যারা সুদ খায় তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না, দাঁড়ালেও তাঁর দাঁড়ানো হবে সে ব্যক্তির মতো, যাকে শয়তান নিজস্ব পরশ দিয়ে দুনিয়ার লোভ লালসায় মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে, এটা এ জন্য যে, এরা বলে ব্যবসা-বাণিজ্য তো সুদের মতোই একটা কারবারের নাম অথচ আল্লাহ ব্যবসা হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন। তাই তোমাদের যার যার কাছে তার মালিকের পক্ষ থেকে সুদ সংক্রান্ত এ উপদেশ পৌঁছেছে, সে সুদের কারবার থেকে বিরত থাকবে।’ আয়াত ২৭৫। এ আয়াতে সুদখোরদের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। তারা এখানে দুটি অপরাধ করেছে। ১. সুদের মাধ্যমে হারাম খেয়েছে ২. সুদকে হালাল মনে করেছে এবং যারা একে হারাম বলেছে, তাদের উত্তরে বলেছে ক্রয়-বিক্রয় তো সুদেরই অনুরূপ। সুদের মাধ্যমে যেমন মুনাফা উপার্জিত হয় তেমনি ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যেই মুনাফাই উদ্দেশ হয়ে থাকে। অতএব, সুদ হারাম হলে ক্রয়-বিক্রয়ও হারাম হওয়া উচিত। অথচ কেউ বলে না যে, ক্রয়-বিক্রয় হারাম। তাদের বলা উচিত ছিল যে সুদও তো ক্রয়-বিক্রয়েরই মতো। ক্রয়-বিক্রয় যখন হালাল তখন সুদও হালাল হওয়া উচিত। কিন্তু তারা বর্ণনাভঙ্গি পাল্টিয়ে যারা সুদকে হারাম বলত, তাদের প্রতি এক ধরনের উপহাস করেছে যে, তোমরা সুদকে হারাম বললে, ক্রয়-বিক্রয়কেও হারাম বল। (সূত্র : মারুফুল কোরআন)। কিন্তু আল্লাহ পরিষ্কারভাবে সুদকে হারাম আর ব্যবসাকে (ক্রয়-বিক্রয়) হালাল করে দিয়েছেন। হালাল ও হারাম কি কখনো এক হতে পারে? পরবর্তী আয়তে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন আর দান সদাকাকে বৃদ্ধি করেন। আল্লাহ অকৃতজ্ঞ ও কুফরকারীকে ভালোবাসেন না।’ আয়াত ২৭৬। এই আয়াতে আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেছেন আর সদাকাকে বর্ধিত করেছেন। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘সুদ যদিও বৃদ্ধি পায় কিন্তু তার শেষ পরিণতি হচ্ছে স্বল্পতা’। (মুসনাদে আহমদ)। অত্যাচারী জালিম, সুদখোর, তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে রসুল (সা.) বদদোয়া করেছেন। রসুল (সা.) সুদ গ্রহীতা, সুদদাতা, সুদের লেখক, আর সুদের দুজন সাক্ষীকে অভিশাপ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তারা সবাই সমান অপরাধী। (মুসলিম শরিফ, মিশকাত শরিফ)। সুদের ৭৩টি স্তরের মধ্যে সবচেয়ে নিচু স্তরটি হলো আপন মায়ের সঙ্গে ব্যভিচার করার সমতুল্য। সুদের সবচেয়ে ছোট ক্ষতি হলো মালের বরকত উঠে যাওয়া। রসুল (সা.) বলেন, ‘বাহ্যিকভাবে সুদ পরিমাণে যতই বেশি দেখা যাক না কেন প্রকৃতপক্ষে তা কম হয়ে যায়।’ (মুসনাদে আহমদ)। সুদ গ্রহণে আপাতদৃষ্টিতে টাকা পয়সা বৃদ্ধি পেতে দেখা গেলেও পরিণামে আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। সুদি কারবারি করা ব্যাংকে চাকরি করাও হারাম। কারণ এতে গুনাহর কাজে সহযোগিতা করা হয়। সুরা মায়েদায় আল্লাহ বলেন, ‘পাপ ও সীমা লঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা কর না।’ (আয়াত ২)। যে সব ব্যাংক সুদমুক্ত ব্যবসা পরিচালনা করে এবং ইসলামী শরিয়া মোতাবেক কোরআন ও হাদিসের নির্দেশ মোতাবেক পরিচালিত হয় সেক্ষেত্রে কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো দোষ নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে ইমান আনার অর্থ শুধু নামাজ আদায় আর রোজা রাখা নয়, অবৈধ সম্পদ থেকে দূরে থাকাও ইমান ও তাকওয়ার শর্ত। ইসলাম মালিকানাকে সম্মান করে কিন্তু সুদ গ্রহণ বা গরিব মানুষকে শোষণ করাকে অনুমতি দেয় না। অত্যাচার করা আর অত্যাচারিত হওয়া উভয়ই নিন্দনীয় কাজ। তাই ইসলামে সুদ গ্রহণ ও সুদ দেওয়া উভয়েই নিষিদ্ধ ও গুনাহর কাজ। তবে ধনী-গরিব নির্বিশেষে আমাদের সবার মনে রাখতে হবে সুদ সবার জন্য হারাম এবং আল্লাহর আইন মেনেই আমাদের দুনিয়ার জীবন শেষ করতে হবে তাহলেই পরকালে আমরা পাব মুক্তি নতুবা আল্লাহর আইন অমান্য করার জন্য পেতে হবে কঠিন শাস্তি। সমাজে বৈষম্য দূর করতে হলে আমাদের সবাইকে সুদের হাত থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সুদের হাত থেকে মুক্ত রাখুন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর