রবিবার, ২৭ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

অক্ষম ক্ষমতার গ্লানি

খায়রুল কবীর খোকন

অক্ষম ক্ষমতার গ্লানি

ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপির বিরুদ্ধে অবিরাম সমালোচনা করে চলেছেন। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওই দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদও একই মাত্রায় বিএনপির বিরুদ্ধে কটুকাটব্য চালিয়ে আসছেন। সরকারি দলের বাকি সব নেতা ও অন্য মন্ত্রীরাও কম যান না এ বিষয়ে। তাঁরা যতটা না নিজ দলীয় এক যুগের অধিককাল কর্মকান্ডের যথার্থ ‘সাফল্যের ফিরিস্তি’ দিতে পারঙ্গম তার চেয়ে অধিক ব্যস্ত বিএনপিকে তুলাধোনা করায়।

সর্বশেষ ১৮ জুন (২০২১) ওবায়দুল কাদের দলীয় সভায় বলেছেন ‘বিএনপির রাজনীতি ভাইরাসের চেয়েও ভয়ংকর’। প্রায় সাড়ে ১২ বছর ধরে (টানা তিন মেয়াদে) ক্ষমতায় আছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। কীভাবে ক্ষমতায় তা তো সারা দুনিয়ার মানুষই জানে। কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনে জিতে তাঁরা ক্ষমতায় নন তিন মেয়াদ ধরে। ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে ‘গায়ের জোরে’ ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ নেতারা কীভাবে বলেন এ রকম ভয়ানক কথা! ওবায়দুল কাদেরের ভাষ্য, ‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশময় খুনের রাজত্ব কায়েম হবে, নৈরাজ্যের আঁধারে ডুবে যাবে সমগ্র দেশ।’ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানকে তাঁরা খলনায়ক, এমনকি তাঁদের প্রধান নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কল্পকাহিনি বলে নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে যাচ্ছেন। আমার সিনিয়র রাজনীতিক বড় ভাই ওবায়দুল কাদেরের কাছে একটা বিনীত প্রশ্ন- সাবেক প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের সপরিবারে নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার তো আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগেই সম্পন্ন হয়েছে; তখন কেন মূল আসামিদের স্বীকারোক্তি আদায় করে জিয়াউর রহমান জড়িত থাকার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করার সুযোগটি হাতছাড়া করলেন? কেন তাঁরা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের ব্যাপারে একটা বিচার বিভাগীয় শক্তিশালী কমিশন দ্বারা তদন্ত অনুষ্ঠান করলেন না? তাঁরা কি দেখতে পেলেন না খন্দকার মোশতাক আহমদসহ আওয়ামী লীগের একটা অংশ (যাঁরা একদলীয় বাকশাল সরকারের মধ্যেই লুকিয়ে ছিলেন) তাঁদের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যায় জড়িত ছিলেন? এবং তাঁদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের যোগাযোগ থাকার কোনো প্রমাণই মেলে না। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, এ দেশের কোটি কোটি মানুষ জানে একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত হওয়ার বিষয়টি কল্পনাও করতে পারেননি। তিনি সে রকম নীতিহীন ও দুশ্চরিত্র কোনো খলনায়ক নন। শহীদ জিয়ার সমগ্র জীবনকর্ম অধ্যয়ন করলে তা যে কোনো মানুষের কাছেই নির্বিঘ্নে প্রমাণিত হবে। আমি বিনীতভাবে মেধাবী সাংবাদিক-লেখক মাহফুজ উল্লাহ রচিত ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া : রাজনৈতিক জীবনী’ গভীর মনোযোগে পাঠের অনুরোধ জানাই সবাইকে। আমরা তো ভেবে পাই না যে ১২ বছরের বেশি সময় টানা ক্ষমতায় আছে (তিন-মেয়াদে) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, তাদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা রাষ্ট্র-প্রশাসনে, লাখ লাখ কোটি টাকার বার্ষিক রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট দিয়ে তারা সরকার চালান, জনমানুষের জন্য, দেশের অবকাঠামো গড়ার সব উন্নয়নকাজ পরিচালনা করছেন, পুলিশসহ সব রাষ্ট্রীয় বাহিনী তাদের হাতে, বিরোধী দলকে রাস্তাঘাটে মাঠে-ময়দানে কথা বলার সুযোগই দেন না তারা, লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাস ছেড়ে এমনকি যখন-তখন গুলি ছুড়ে, জেলে ঢুকিয়ে অথবা নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে যে কোনো প্রতিবাদী মানুষকে। এ অবস্থায় বিএনপির এমন কী ক্ষমতা রয়েছে যে দেশের সবচেয়ে বড় দুশমন হয়ে উঠল এ দল ও দলের নেতা-কর্মীরা? কোন জাদুমন্ত্রবলে বিএনপি সেই অসীম শক্তি অর্জন করল! হ্যাঁ আছে, বিএনপির প্রতি দেশের গণমানুষের নীরব সমর্থন এখনো আছে। তা ছাড়া আর কোনো কুচক্রান্ত করার শক্তি তার নেই, থাকার দরকারও নেই।

আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষায় বিএনপি একটা ‘অপদার্থ’ রাজনৈতিক দল, তার নেতা-কর্মীরা সব অযোগ্য। তাহলে তো আওয়ামী লীগেরই সুবিধা। এ রকম অযোগ্য যদি প্রমাণিত হয় প্রধান বিরোধী দলটি তাহলে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের এতটা ভয় পাওয়ার তো কারণ নেই। প্রতিবারে ভোটের দিনের আগের রাতে পুলিশ ও প্রশাসনের আমলা গোষ্ঠীর সহায়তায় ‘সিল মারো ভাই সিল মারো, নৌকা মার্কায় সিল মারো’ এ রকম নাটক করার দরকার নেই। এবং নির্বাচনের দিন অনধিক ৫ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে এনে আরেক পালানাটক মঞ্চায়নেরও বা কী প্রয়োজন! এক নম্বর বিরোধী দল বিএনপি যখন অজনপ্রিয়, অযোগ্য একটা দল তখন আওয়ামী লীগকে সুষ্ঠু নির্বাচনে হারায় কার সাধ্য!

বিএনপি কর্র্তৃত্ববাদী সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচ- মারমুখো আক্রমণের মুখে, আর লাখ লাখ মামলা, অগণন নিপীড়ন, ক্ষমতাসীনদের লেজুড়বৃত্তি করা সহযোগী ছাত্র-যুব-শ্রমিক সংগঠনের কর্মীদের ‘মোনেম খানি-এনএসএফ কায়দার’ হামলার মুখে একটা শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে সেটা তো অস্বীকার করছে না কেউ। বরং সেটাই ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক ব্যর্থতা আর সেটা কখনো বিএনপির অপারগতা হিসেবে গণ্য করা যায় না; একটা ব্যাপার তো সত্য যে বিএনপি গণআন্দোলনের নামে কোনো নৈরাজ্য সৃষ্টির বদলে ধৈর্য ধরে জনগণের ভিতরে একটা প্রকৃত গণজাগরণের অপেক্ষায় রয়েছে। সুস্থ একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চার কারণেই বিএনপির একটা ধন্যবাদ পাওয়া উচিত। তদুপরি দেড় বছর ধরে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণেও বিএনপির আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়টি মারাত্মক বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন আমরা বিনীতভাবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের উদ্দেশে বলতে চাই- সরকারের রাষ্ট্র-প্রশাসনের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ঢিলেঢালা হয়ে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে কতখানি ঢুকে গেছে তা কি আপনারা ভেবে দেখেছেন? আমলা গোষ্ঠী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বড় কর্মকর্তাদের কাছে অসীম ক্ষমতা চলে যাওয়ার কারণে এবং তার পরিণামে সীমাহীন দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অদক্ষতার ফলে খোদ সরকারি দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্ষমতা কীভাবে ‘অক্ষম’ হয়ে পড়েছে!

বিষয়টি খুব সহজে বোধগম্য হবে না আওয়ামী লীগ নেতাদের কারণ তাঁরা এক যুগের অধিককাল টানা ক্ষমতায় থেকে ‘জনপ্রতিনিধিত্বহীন মেজাজে’ আনন্দ-উৎসবে ডুবে আছেন এক বিশেষ মোহমুগ্ধতার ঘোরে। তাঁদের মধ্যে রাষ্ট্রদর্শন, প্রকৃত গণতন্ত্রের চেতনা, সুশাসনের দর্শন সবকিছু ধুয়ে-মুছে গেছে এবং এত ক্ষমতা তবু তাঁরা নিদারুণ ‘অক্ষম’। একেই বলে অক্ষম ক্ষমতার গ্লানি।

আছে, এ গ্লানি থেকেও মুক্তির উপায় আছে। আমরা জানি, মানুষ কোনো ফেরেশতা নয়, মানুষমাত্রই ভুল করে। আর রাজনীতিবিদদের ভুল করার প্রবণতা তো যথেষ্টই থাকে। তবে তাঁদের নিজেদের শোধরানোর কোনো ইচ্ছা আছে কি না সেটাই বড় বিবেচ্য। তাঁরা এখনো পারেন একটা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে প্রকৃত নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিতে। সেটা ছাড়া কোনো মুক্তি নেই- না এ দেশের ১৭ কোটি মানুষের, না আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা-কর্মীদের। সেটাই ইতিহাসের সত্যের কাছে তাঁদের দায়বদ্ধতা- তাঁরা মানুন বা না-ই মানুন।

লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য এবং ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর