শুক্রবার, ২ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

হোলি আর্টিজান জঙ্গি দমনের টার্নিং পয়েন্ট

এ কে এম শহীদুল হক

হোলি আর্টিজান জঙ্গি দমনের টার্নিং পয়েন্ট

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে আইএসআইয়ের সংস্করণে সিরিয়াফেরত তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নব্য জেএমবি হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল বিশ্ব সম্প্রদায়কে জানিয়ে দেওয়া যে বাংলাদেশে জঙ্গি আছে, আইএসআই আছে এবং তারা শক্তিশালী ও সক্রিয়। জঙ্গিদের উদ্দেশ্য প্রাথমিকভাবে হাসিল হয়েছিল। আইএসআই হামলার দায় স্বীকারও করেছিল। এ ঘটনায় জঙ্গিরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে লিডিং নিউজের শিরোনাম হতে পেরেছিল। ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, দি ইকোনমিক টাইমস ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম শিরোনাম দিয়ে এ ঘটনার সংবাদ প্রচার করে। জঙ্গিরা ঘটনার পর আইএসআইয়ের পোশাক পরিধান করে ও পতাকা ব্যবহার করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তারা তথাকথিত বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেছিল।

ওই ঘটনায় পুলিশের একজন সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার ও একজন ইন্সপেক্টরসহ (ওসি বনানী) দেশি-বিদেশি ২২ জন নিহত হন। দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিদেশিরা বাংলাদেশে আসা বন্ধ করে দেয়। কূটনীতিকরা তাদের পরিবার-পরিজন নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো শুরু করে। গার্মেন্ট সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিদেশি ব্র্যান্ডের ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দেওয়া স্থগিত করে দেন। সার্বিকভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অবস্থা হুমকির মধ্যে পড়ে। অন্যপক্ষে জঙ্গি, ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িকতার কুশীলবরা উৎসাহিত হয়েছিল। সরকারবিরোধী একশ্রেণির রাজনীতিক সরকারকে দোষারোপ শুরু করে। সরকার বিপাকে পড়ছে বিধায় হয়তো তাদের মনে আনন্দের সুড়সুড়ি লেগেছিল। দেশের যে কী ক্ষতি হচ্ছিল সেদিকে তাদের মাথাব্যথা ছিল না। তারা মুখে মুখে জঙ্গি দমনের কথা বললেও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টারত ছিল।

ডিএমপির সিটিটিসির কর্মকর্তারা হোলি আর্টিজানে অভিযান চালানোর আগ্রহ আমার কাছে বারবার ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মোতাবেক সেনা কমান্ডো দল দ্বারা অভিযান করানো হয়। পুলিশ ও র‌্যাব তাদের সহায়তা করে। অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ মোট ছয়জন নিহত হয়।

হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর জঙ্গিদের দমন করে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা ছিল পুলিশের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। পুলিশপ্রধান হিসেবে আমি সেই চ্যালেঞ্জ সাহসের সঙ্গেই গ্রহণ করি। পুলিশের চৌকশ ও বিচক্ষণ অফিসার এবং সাহসী সদস্যদের দিয়ে জঙ্গি দমনে ডেডিকেটেড ও পেশাদার টিম গড়ে তুলি। ডিএমপির সিটিটিসি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনায় একটি পেশাদার ও সক্ষম ইউনিট হিসেবে গড়ে উঠেছিল। এ ইউনিটের প্রশিক্ষিত সোয়াত ও বোম ডিসপোজাল টিম জঙ্গি দমন অভিযানে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করে। পুলিশ হেডকোয়াটার্সের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে শক্তিশালী করা হয়। মাঠপর্যায়ে কর্মরত ইউনিট-প্রধানদের জঙ্গি দমনে অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশনায় ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। আমার মূল ও প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল পুলিশ ইন্টেলেজিন্সের মাধ্যমে পুলিশকে জঙ্গি নেটওয়ার্কের মধ্যে ঢোকানো। জঙ্গিদের যোগাযোগ নেটওয়ার্কে ঢুকতে পারলে তাদের আস্তানা, চলাচল ও গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে অভিযানের পরিকল্পনা করা যাবে। আমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সেভাবে কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করি। এ লক্ষ্যে পুলিশ হেডকোয়াটার্সের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, ডিএমপির সিটিটিসি ও বগুড়ার তৎকালীন পুলিশ সুপার বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। র‌্যাবও তাদের নিজস্ব ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে।

জঙ্গি দমনসংক্রান্ত অভিযান পরিচালনার জন্য আমি একটি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর) তৈরি করি। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও সিএমপিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে সোয়াত টিমের আদলে টিম গঠন করি। পুলিশ জঙ্গিদের মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন করে। পুলিশ ইন্টেলিজেন্স ও গোয়েন্দারা জঙ্গিদের আস্তানা বের করা শুরু করে। জঙ্গি আস্তানায় পুলিশ একটির পর একটি সফল অভিযান করে জঙ্গিদের গর্জে ওঠা শক্তি চুরমার করে দেয়। উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলায় অভিযান হয়। অভিযান হয় ঢাকা মহানগরীর কল্যাণপুর, মিরপুর, আজিমপুর ও আশকোনার জঙ্গি আস্তানায়। অন্যান্য জেলার মধ্যে অভিযান হয় ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ,  কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার, খুলনা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ইত্যাদি জেলায়। মোট কথা দেশের প্রায় প্রতি জেলায় জঙ্গি স্কোয়াড ও নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল। জঙ্গিদের অনেক আত্মঘাতী (সুইসাইডাল) টিম তৈরি হয়েছিল। এসব আত্মঘাতী গ্রুপ অভিযান করার সুযোগ পেলে জঙ্গিরা দেশ প্রায় অচল করে দিতে পারত। কিন্তু পুলিশ তাদের সে সুযোগ দেয়নি। পুলিশ ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে একটির পর একটি জঙ্গি আস্তানা খুঁজে বের করে অভিযান করায় জঙ্গিরা দাঁড়াতে পারেনি। যখনই তারা অপারেশনের প্রস্তুতি নিত তথ্য পেয়ে পুলিশ তখনই অভিযান চালিয়ে তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছিল। পুলিশ জঙ্গি দমনে দুটো পন্থা অবলম্বন করেছিল। Reactive and Proactive Approach। অভিযান, গ্রেফতার, মামলা রুজু, তদন্ত, জিজ্ঞাসাবাদ এসব কাজ রি-অ্যাকটিভ অ্যাপ্রোচের আওতাভুক্ত ছিল। প্রো-অ্যাকটিভ অ্যাপ্রোচের আওতায় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা হয়েছিল। জঙ্গিরা যেহেতু তথাকথিত ধর্মীয় মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিপথে পরিচালিত হয়েছে এবং অন্যদের এ পথে আনার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে সেহেতু আমি ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা জঙ্গিদের প্রদত্ত ধর্মের ভুল ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য দেশব্যাপী উদ্যোগ গ্রহণ করি। পুলিশ হেডকোয়াটার্সে শীর্ষ পর্যায়ের আলেমদের নিয়ে বেশ কয়েকটি মতবিনিময় সভার ব্যবস্থা করি। এক সভায় সিদ্ধান্ত হয় ১ লাখ আলেমের স্বাক্ষরে ‘জঙ্গিবাদ ইসলামে নিষিদ্ধ’ এ মর্মে ফতোয়া দেওয়া হবে। প্রখ্যাত আলেম মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদের নেতৃত্বে ১ লাখ আলেমের স্বাক্ষরে সে ফতোয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সরকারের নির্দেশে জুমার দিন মসজিদে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বয়ান করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি অনুষ্ঠানে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ও জেলার পুলিশ সুপাররা অসংখ্য জঙ্গিবিরোধী সচেতনতামূলক সভার আয়োজন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা জঙ্গিবাদে দীক্ষা নেওয়ায় সমাজে উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছিল। পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভারও আয়োজন করে।

রি-অ্যাকটিভ অ্যাপ্রোচে অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের প্রায় নির্মূল করা হয়েছিল। প্রো-অ্যাকটিভ অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সচেতনতামূলক সভা-সমাবেশ করায় ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এমনকি অভিযানের সময় নিহত জঙ্গিদের লাশ নিতেও স্বজনরা অনীহা প্রকাশ করে। সচেতনতামূলক প্রচারের কারণে নতুন করে জঙ্গি দলে নিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জঙ্গি তৎপরতাও আর তেমন একটা দেখা যায়নি।

জঙ্গি সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়। এ সমস্যা বিশ্বব্যাপী। জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের সাফল্য বহির্বিশে^ প্রশংসিত হয়েছে। ২০১৭ সালে ইন্টারপুলের বেইজিং বার্ষিক সম্মেলনে যোগদানকারী অধিকাংশ দেশের পুলিশ-প্রধান জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করেছিলেন। ইন্টারপুলের জঙ্গি দমন ডেস্কের কর্মকর্তারা পৃথকভাবে আমার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সভা করেছেন। সভায় তারা জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য ইন্টারপুলের হেডকোয়াটার্স ও আঞ্চলিক অফিস সিঙ্গাপুরের জন্য বাংলাদেশের দুজন পুলিশ অফিসারের চাহিদা দিয়েছিলেন। পরে তারা লিখিত চাহিদাও পাঠিয়েছিলেন যা সরকারের বিবেচনায় ছিল। সরকার, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, মিডিয়া এবং আপামর জনতার সহযোগিতা পাওয়ায় পুলিশের পক্ষে জঙ্গি দমন অনেকটা সহজ হয়েছিল। জঙ্গিরা ভেবেছিল হোলি আর্টিজান হত্যাকান্ডের মাধ্যমে তারা দেশে ও বিদেশে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করবে। দেশে জঙ্গিরা উৎসাহিত হবে আরও বেশি বেশি অপারেশন করতে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে যায়। পুলিশ তাদের আর দাঁড়াতেই দেয়নি। একটির পর একটি অভিযানে জঙ্গিরা পরাস্ত হয়। তামিম চৌধুরী ও সারোয়ার জাহানের নেতৃত্বে জঙ্গিরা যেভাবে সংগঠিত হয়েছিল ও শক্তি সঞ্চয় করেছিল পুলিশি অভিযানে তা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। হোলি আর্টিজন ঘটনার পর জঙ্গিদের অগ্রযাত্রার পরিবর্তে পতন শুরু হয়। তাই হোলি আর্টিজানের ঘটনা ছিল জঙ্গি দমনে একটি টার্নিং পয়েন্ট। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযানে পুলিশের মনোবল ও সক্ষমতা উঁচু মাত্রায় পৌঁছে যায়। সে ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে।

লেখক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ।

সর্বশেষ খবর