শনিবার, ৩ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

ভাবনা এক জায়গায় স্থির থাকে না

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

ভাবনা এক জায়গায় স্থির থাকে না

জীবনের আগুনে পোড়া সত্যগুলো খুব কঠিন হয়। খুব কঠিন। সত্য কখনো কখনো খুব নগ্ন হয়ে মানুষকে এমন কিছু দেখায় যা মানুষটা হয়তো কখনই ভাবতে পারেনি। একজন ঠেলা গাড়িওয়ালা কাঠের চাকার সঙ্গে যুদ্ধ করে মানুষের বোঝা টেনেছে। এতটা বোঝা মানুষ তার গাড়িতে চাপিয়েছে যে লোকটার দেহটা সেটা ঠেলতে ঠেলতে কুঁজো হয়ে গেছে। কখনো রোদে পুড়েছে। সে রোদের উত্তাপটা এমন ছিল যে তার চামড়া পুড়ে পুড়ে খসে পড়েছে। দেহ বেয়ে লবণাক্ত ঘাম মাটিতে পড়েছে। সে মাটি জানে সে ঘামের মূল্য কত। কিন্তু মানুষ তা জানে না। কখনো ঝড়, বাদল, বাতাসের বেগের বিপরীতে টানতে হয়েছে মানুষের বোঝা। রাতে শরীরটা ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে। তার ওপর বৃষ্টির ঠান্ডা পানি গায়ের উত্তাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। তীব্র ঠান্ডার অনুভূতি জাগিয়ে জরাগ্রস্ত হয়েছে সে ছোপ ছোপ প্রাচীন শরীর। তার পরও বোঝা টানা থামেনি ঠেলা গাড়িওয়ালার। কারণ সে জানে এ আগুনের উত্তাপ তাকে যত পোড়াবে তার ক্ষুধার যন্ত্রণায় বিদীর্ণ হওয়া পেটটা তত শান্তি পাবে। ছেঁড়া কাঁথায় সারা জীবন কাটিয়ে দেওয়া তার বউ, ছেলেমেয়েরা খাদ্যের জোগান পাবে। এভাবে মানুষ প্রতিনিয়ত বিপরীতমুখী জীবনধারার পদচিহ্ন মাটিতে রেখে যাচ্ছে। যেখানে স্বপ্ন আছে সাধ্য নেই, যেখানে দুঃখ আছে সুখ নেই, যেখানে মানুষ আছে মানবিক মূল্যবোধ নেই, যেখানে ঝুলন্ত সত্তা আছে, চিন্তার জায়গা নেই। অদ্ভুত এক কানামাছির খেলা যেখানে জোনাকির আলো জ্বলে আর নেভে। রুদ্ধদ্বার বৈঠক বসে মানুষ আর মানুষের ভিতরের বিপরীতমুখী সত্তার। সেটা বৃষ্টির পানি ঝরিয়ে দেখা অদেখা সত্তার ভিতর রংধনুর রং ছড়িয়ে দিতে পারবে কি না দেখার অপেক্ষায় বসে থাকে সময়, প্রকৃতি আর সাধারণ মানুষটা। গতির সূত্রের ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে সেটা কেমন যেন পাল্টে যায়। যাত্রাপথটা হয়তো একদিন হাঁটতে হাঁটতে আর বাস্তব থাকে না রঙ্গমঞ্চ হয়ে যায়।

যেমন সবাই বলে পৃথিবী একটা বিরাট রঙ্গমঞ্চ, অথচ মুখে তা স্বীকার করতে চায় না। এ রঙ্গমঞ্চে যত না মানুষ তার থেকে বেশি মুখোশ। মুখোশের আড়ালে মুখোশ। মুখের আড়ালে মুখোশ। খুব চেনা মুখটা চোখের আড়াল হলেই মুখোশ হয়ে যায়। বিশ্বাস তখন আহত পাখি হয়। ছটফট করে। মুখ থুবড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খায়। বিশ্বাস যে মুখটা এত দিন চিনেছিল সেটা তখন আর মানুষ থাকে না। মুখোশ হয়ে যায়। সে মুখোশে বিশ্বাসঘাতকতার ছোপ ছোপ রক্ত লেগে থাকে। সে রক্তে বিষ থাকে। সে বিষ সাপের বিষের থেকেও ভয়ংকর হয়। মানুষের চেয়ে মানুষের মুখোশটা চেনা তাই বেশি দরকার। আমরা যাদের মুখোশ পরা মানুষ ভাবী তাদের হয়তো মুখোশ থাকে না। কিন্তু যাদের মানুষ ভাবী তাদের মুখোশ থাকে।

সময় যতই গড়ায় মানুষের থেকে মুখোশের সংখ্যা তত বাড়ে। ক্ষণিকের জন্য হলেও মানুষ যদি আকাশ থেকে নেমে মাটিতে পা রেখে বলত- না, না আর মুখোশ নয়, এখন দরকার রক্তমাংসের মানুষ। যে রক্তমাংসে জীবনের জ্বালা আছে, জড়তা নেই। মুখোশ পরা মানুষ তবে কি ভালো অভিনেতা হয়ে ওঠে? প্রসঙ্গটা বদলে একটা ভিন্ন জায়গায় ভাবনাটা স্থির করা যায়, যদিও সব ভাবনার সমীকরণ কোনো না কোনো জায়গায় এসে মাইল যায়।

চীনের সম্রাট কিন শি হুয়াং প্রায় ২ হাজার বছর আগে দাবি করেছিলেন, আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষের মুখ দেখে তিনি তাদের মনের ভিতরের গোপন চিন্তা-ভাবনাকে পড়তে পারতেন। জার্মানদের স্নো হোয়াইট রূপকথায় এক বিস্ময়কর আয়নার কথা বলা হয়েছে যে আয়না সব সময় সত্য কথা বলত। প্রাচীন কিছু সংস্কৃতিতে ধারণা করা হতো আয়নার মধ্যে মানুষের আত্মা বা মানুষের ভিতরের প্রকৃত সত্তার ছায়া পড়ে। একজন মানুষ আয়নার সামনে দাঁড়ালেই মানুষটা সম্পর্কে যা যা সত্য আয়না সব নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারত। তখন মানুষের আর লুকানোর কিছু থাকত না। বরং আয়নার এমন অভূতপূর্ব শক্তির কাছে মানুষের আসল চেহারা যাতে বেরিয়ে না আসে সে ভয়ে মানুষ তার খারাপ আচরণগুলো ত্যাগ করত। ভালো আচরণগুলোর চর্চা করত। কারণ মানুষ সত্যকে সব সময় ভয় পায়। সত্যের ওপর জগদ্দল পাথরের বোঝা চাপিয়ে মানুষ মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরতে চায়। অথচ সেটা যে আলো নয় আলেয়া তা বুঝতে চায় না। সত্যকে যতক্ষণ মানুষ তার ভিতরের সত্তায় জাগিয়ে রাখে ততক্ষণ মানুষের ভিতর মানুষ বেঁচে থাকে।

সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব জেনেভার মিশেল মিলিনকোভিচ রং পাল্টানোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসহ এর কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, একটা গিরগিটি আরেকটা গিরগিটিকে ভয় দেখাতে কিংবা নিজের রূপ জাহির করতেই এমনভাবে রং পাল্টায়। বিষয়টা কেমন করে যেন মানুষের মনস্তত্ত্বের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। মানুষও তো তাই করছে। নিজের বড়ত্ব প্রমাণের জন্য মানুষ তার আসল চেহারাটা গোপন রেখে নকল চেহারাটা সামনে আনছে। যা বলছে তা তার মনের কথা নয়, বরং অনেকটা অভিনেতার সাজানো সংলাপের মতো। আর এ অভিনয়ের মানবিক মূল্য নেই বলে একে বস্তাপচা সংলাপ বলাটাই বোধহয় সবচেয়ে যৌক্তিক।

কেমন যেন অবিন্যস্ত হয়ে যাচ্ছে লেখাগুলো। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে উল্টো পথে যাত্রা করেছে। যে কাগজটাতে লিখব ভাবছি সে কাগজটা আর মাটিকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারছে না। যে কলমটা দিয়ে লিখব ভাবছি সে কলমটা আর ধরে রাখতে পারছি না। লেখাগুলোও কেমন যেন এবড়ো-থেবড়ো হয়ে এদিকওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে।

সব যেন নিয়ন্ত্রণহীন। তার পরও এমন প্রতিকূলতায়ও মানুষকে নিয়ে লিখতে চাই। যে মানুষ হবে কাব্য ও কবিতার। প্রকৃতি ও শিল্পকলার। মনন ও মননশীলতার। যেখানে খোলা চোখের চেয়ে বুজে থাকা চোখ কল্পনার পর কল্পনা গড়ে নির্মাণ করবে মনুষ্যত্ব। যে মনুষ্যত্ব কাচের আয়নায় বন্দী থাকবে না, বরং মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াবে তার মতো, যেমন ইচ্ছা তেমন করে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও লেখক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

সর্বশেষ খবর