রবিবার, ৪ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

কৃষকের ধারণায় টেকসই বাঁধ

ড. এস এম আতিকুল্লাহ

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আঘাত হানার পর বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত একটি সংবাদ বেশ অর্থবহ। খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর দশহালিয়া বাঁধটি হাজার হাজার গ্রামবাসী সংগঠিত হয়ে মেরামত করে। বাঁধ নির্মাণের দাবিতে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে কাফনের কাপড় পরে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষকের আবেদন-আকুতিও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সংসদ সদস্য ট্রলারযোগে বাঁধ এলাকায় পৌঁছলে গ্রামবাসী তাকে দেখে কাদা ছুড়েছেন। এ ঘটনাটি ভুক্তভোগী বানভাসি মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের সামাজিক বহিঃপ্রকাশ। বাস্তবতা হলো, দক্ষিণাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের একটিই দাবি ‘টেকসই বাঁধ’। কারণ তারা দানব সিডর ২০০৭, ভয়ানক আইলা ২০০৯, মহাসেন, কোমেন, রোয়ানো, মোরা, বুলবুলের তান্ডব দেখেছে। ঘূর্ণিঝড় আর প্লাবনে গোটা দক্ষিণ বাংলা সাগরের জলে ভেসে গিয়েছিল। একসময়ের শস্যভান্ডার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ এখন ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কারণে হতদরিদ্রতার মুখে নিপতিত। প্রশ্ন করা যায়, টেকসই বাঁধ কী? লোকমুখে প্রচলিত আছে, ‘বেড়িবাঁধ কোনো বিদেশি প্রযুক্তি নয়’। এ দেশের প্রাচীন নাম ‘বং’ বা ‘বাঙ’ শব্দের সঙ্গে বাঁধ বা জমির সীমানা ‘আল’ (আইল) প্রত্যয়যোগে ‘বাঙালা’ শব্দ গঠিত হয়েছে। দক্ষিণের চন্দ্র্রদ্বীপের রাজবংশের রাজাদের দ্বিমাত্রিক ‘টেকসই বাঁধ’ শব্দের ব্যবহারিক প্রয়োগ হচ্ছে বঙ্গোপসাগর পাড়ে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জীবনপ্রবাহ নিশ্চিত করতে জুতসই পানি ব্যবস্থাপনা। যার একটি বাহু হচ্ছে জোয়ার-ভাটা তথা ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করা (ফ্লাড কন্ট্রোল)। অন্যটি জোয়ার-ভাটা ও প্লাবনের পানি এবং সৃষ্ট জলাবদ্ধতা সুকৌশলে দূর করতে যথাসময়ে পানি সরিয়ে দেওয়া। যা বসতিদের ফসল চাষ তথা খাদ্য নিরাপত্তার সুযোগ তৈরি করে দেয়। প্রয়োজনে খাল, নদী ও বাঁধের ওপর জুতসই পরিবেশবান্ধব অবকাঠমো নির্মাণ করা। একটি নির্দিষ্ট এলাকার জনবসতি ঘিরে নির্মিত বাঁধ, কালভার্টসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে মানুষের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন পরিচালনাকে বলা হয় ‘পোল্ডার সিস্টেম’। পৃথিবীর বহু দেশ এ পোল্ডার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পানি শাসন করে আধুনিক জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলছে এবং নিয়ন্ত্রণ করছে ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিজ্ঞানীরা উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে এ টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাহলে জনগণ কেন বারবার বলছে ‘টেকসই বাঁধ’। গত শতকের ষাটের দশক থেকে উপকূলে যেমন ভোলা, হাতিয়া, স›দ্বীপ, পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনা ও সাতক্ষীরায় পানি ব্যবস্থাপনায় নির্মিত হয়েছে বেশ কিছুু পোল্ডার এবং অবকাঠামো। বর্তমানে এ অঞ্চলে নির্মিত অবকাঠামোগুলো মেরামতের অভাবে অকেজো হয়ে গেছে, নয় তো জোড়াতালি দিয়ে কোনোমতে সচল রাখা হচ্ছে। নতুন নতুন চর তৈরি হয়েছে, আবার ভাঙনের ফলে সৃষ্ট বাঁধের স্বরূপের পরিবর্তন হয়েছে। জেগে ওঠা নতুন চরে গড়ে উঠেছে বসতি। এসব এলাকার মানুষ খাদ্যের প্রয়োজনে কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলছে, রোপণ করছে গাছ, গড়ে তুলছে চরের জীবন-জীবিকা। সৃষ্ট নতুন চর অরক্ষিত, বাঁধ নেই। বসতিরা থেকে যাচ্ছে পুরনো বাঁধের বাইরে। সময়ের বিবর্তনে স্রোতের ধারা, প্রখরতা, স্রোতের দিক পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে এ বাঁধ ও অবকাঠামোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। খাল, নদী নাব্য হারিয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ইয়াসের পরে মুঠোফোনে এক চেনা কৃষককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এ ঘূর্ণিঝড় উপকূলে পুরো আঘাত করেনি। অন্যত্র প্রবাহিত হলেও দক্ষিণাঞ্চলে এত পানি কেন? উত্তরে তিনি বললেন, ভরা চাঁদ (ফুল মুন) তাই জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা, পুকুর, ঘের, জলাধার। লবণপানিতে গাছ, লতাগুল্ম, মাছসহ বাসোপযোগী পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চিহ্ন হচ্ছে সবুজ বেষ্টনী। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্য ও জীবন-জীবিকা। তাই বলা হয়, সমাজবদ্ধ উপকূলীয় জনগণ ‘দুর্বল পানি ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত বঞ্চনার শিকার’।

আধুনিক প্রচারমাধ্যম তাদের ঘূর্ণিঝড়ের সংবাদ পৌঁছে দেয়। নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে জান রক্ষা করলেও ফল-ফসল বিনষ্ট হয়। পলিমাটির আকরযুক্ত মাঠ লবণাক্ত সাদা মরিচায় পরিণত হয়। নোনা পানির কারণে গাছ মারা যায়। বাড়ন্ত সবুজ গাছে একপর্যায়ে মোচা ধারে না, নারকেল গাছে ফলন কমে যায়। হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর রোগে আয়-উপার্জন কমে যাচ্ছে। বানভাসি মানুষ বসতবাড়ি, ফসলি জমি হারিয়ে ‘ক্লাইমেট রিফিউজিতে’ পরিণত হচ্ছে।

মানুষের জানমাল রক্ষায় এর অন্যতম সমাধান ‘টেকসই বাঁধ’। মজবুত প্রকৌশলগত বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়। প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় দাতাদের সহায়তা, দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে জনগণের অংশগ্রহণ এবং জবাবদিহি, চিন্তা ও গবেষণায় একাগ্রতা। আশার কথা, বছরখানেক আগে একটি গবেষণা কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘কম্পোজিট অবকাঠামো’ নির্মাণ। বতর্মানে যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে তা অত্যন্ত ভারী লোহা। এতে মরিচা ধরে একপর্যায়ে এগুলো অকেজো হয়ে যায়। আজকাল নানা ধরনের প্লাস্টিক সামগ্রী ও সহজে পরিবহনযোগ্য হালকা যন্ত্র ও উপকরণ সহজলভ্য হচ্ছে। তাই বিকল্প অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা হচ্ছে, যা একটি আশার বাণী ও চমকপ্রদ খবর। একসময় মানুষ বাঁধ চিনত না, অবজ্ঞা করত, ভাগাড় তৈরি করত বাঁধের ওপর। এখন বলছে ‘টেকসই বাঁধ’ চাই। এটি বেশ শুভলক্ষণ! আকবরনামায় লেখা আছে, চন্দ্রদ্বীপের নবম রাজা কন্দর্প নারায়ণ বসু ঘূর্ণিঝড়ের কারণে মন্দিরের চূড়ায় উঠে জীবন রক্ষা করেছিলেন। চন্দ্রদ্বীপের রাজপরিবারের ভীতি ঘূর্ণিঝড়। অগত্যা তারা চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী কচুয়া থেকে ঠিকানা পরিবর্তন করেন। কিন্তু তাদের প্রজারা ঠিকানা বদলায়নি। তারা চরে গরু-মহিষ চরায়, রুপালি মাছ ধরে, চিকন ধান ফলায়, আম, তরমুজ, সোনা মুগডাল, ঘাড় লাল মরিচ, নারকেল, পানসহ অর্থকরী ফল-ফসল ফলায়। তাদের একটিই দাবি ‘টেকসই বাঁধ’।

লেখক : কনসালট্যান্ট (কৃষি ও পানি)

[email protected]

সর্বশেষ খবর