শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৬ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

রাজা রামমোহন রায়

সৌরেন চক্রবর্ত্তী

রাজা রামমোহন রায়

রাজা রামমোহন রায় ১৭৭২ সালের ২২ মে (মতান্তরে ১৭৭৪ সালের ২২ মে) হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সামাজিক পুনর্গঠন, ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন ও ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাঙালি দার্শনিক। তৎকালীন রাজনীতি, জনপ্রশাসন, ধর্মীয় ও শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখতে পেরেছিলেন। আমাদের সমাজে আধুনিক যুগ প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় তাঁর অসাধারণ মনীষা ও কর্মশক্তির প্রভাব উপমহাদেশের ইতিহাসে চিরচিহ্নিত রেখে গেছেন। বহু বছরের সঞ্চিত জড়ত্বের শেষটুকু অপসারণপূর্বক মুক্তির আলো প্রজ্বলিত করে, অচলায়তনের অবরুদ্ধ বাতায়ন উন্মুক্ত করে বহির্বিশ্বের অবাধ হাওয়া তাঁর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেন। প্রথম জীবনেই তিনি শিক্ষকের কাছে শাস্ত্র ও দর্শনের পাঠ গ্রহণ করেন। ১৫ বছর বয়সে জ্ঞানার্জনের জন্য সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণ করেন। ১৭৯১ সালে তিনি ও তাঁর ভাইয়েরা পৈতৃক জমিদারি দেখাশোনার ভার পান। ১৭৯৬ সালে তিনি পৈতৃকসূত্রে জমি, বাগান ও কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়ির মালিকানা লাভ করেন। রামমোহন ১৮০৫ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। সিভিলিয়ান কর্মকর্তাদের মধ্যে জন ডিগবির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল। কালেক্টর জন ডিগবির দেওয়ান হিসেবে তিনি রংপুর কালেক্টরেটে কর্মরত ছিলেন। সেখানে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানার্জন করেন। জন ডিগবি ১৮১৫ সালে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে গেলে তিনিও একই বছর চাকরি ছেড়ে কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হন এবং প্রকাশ্যে তাঁর সংস্কার প্রচেষ্টা শুরু করেন। কলকাতার বাসিন্দা হয়েই তিনি তাঁর জ্ঞান, বিশ্বাস, মত, ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিবিধানে সচেষ্ট হন। বাংলা ভাষায় বেদান্তের তিনিই প্রথম ভাষ্যকার। এই সঙ্গে একেশ্বর উপাসনার পথ দেখাতে ‘আত্মীয়সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন (১৮১৫)। এ সভাকেই পরে তিনি ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নাম ও রূপ দেন (১৮২৮)। অল্প দিনেই তাঁকে কেন্দ্র করে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরসহ বিশিষ্ট ও সমাজসচেতন বিদ্বান ব্যক্তিরা সমবেত হন। আর রক্ষণশীলরা তাঁর শত্রু হয়ে ওঠেন। প্রতিকূল অবস্থায়ও তিনি ছিলেন নির্ভয় ও প্রবল মানসিক শক্তির অধিকারী। রামমোহন বুঝেছিলেন সমাজের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও মানসিক জড়তা দূর হতে পারে শুধু শিক্ষার আলোয়। সেজন্য তিনি শিক্ষা সংস্কার ও শিক্ষা প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। উল্লেখ্য, তিনি ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে নিজ ব্যয়ে ১৮২৩ সালে স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন। রামমোহনের জ্ঞানের ভান্ডার ছিল অফুরন্ত এবং তাঁর মননশক্তিও ছিল বিস্ময়কর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষায়- ‘রামমোহন ‘সংস্কৃত, আরবি, পারসি, উর্দু, হিব্রু, গ্রিক, ল্যাটিন, ইংরেজি, ফরাসি এই নয় ভাষায় ব্যুৎপন্ন এবং বিলক্ষণ বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। যেসব ব্যক্তির সহিত তাহার মতের ঐক্য ছিল না, তাঁহারাও তদীয় বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করিতেন। রামমোহন রায় এদেশের একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন, সন্দেহ নাই।’

তিনি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়েছেন হিন্দু সমাজের সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টার জন্য। রামমোহন সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে আইনের জন্য চেষ্টা করেন। হিন্দুশাস্ত্রের প্রমাণ দাখিল করে দেখান যে শাস্ত্রে সহমরণের নির্দেশ নেই। এ বিষয়ে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সময় সতীদাহ প্রথা বিধিবহিভর্‚ত ঘোষণা করা হয়। এ বিধান সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বহাল থাকে। তিনি ১৮৩০ সালে ‘রাজা’ উপাধিসহ দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবরের দূত হিসেবে ইংল্যান্ডের রাজার কাছে গমনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। বেশ কয়েক দিন লিভারপুলে কাটানোর পর ম্যানচেস্টার হয়ে তিনি যান লন্ডনে। লন্ডনে পৌঁছে তিনি তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সফলভাবে সম্পন্ন করেন। উল্লেখ্য, রামমোহন আসলে বিলেত যাওয়ার বাসনা পোষণ করছিলেন অনেক আগে থেকেই। ১৮১৬ সালের দিকে তিনি এ ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন জন ডিগবিকে লেখা এক পত্রে। এ ব্যাপারে তাঁকে সার্বিক সহায়তা করেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। বিরাট বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ এবং অন্য দেশের সমাজ ও সভ্যতা দেখার প্রবল ইচ্ছা জন্ম নেয় তাঁর অন্তরে। সে যুগে তিনি পাশ্চাত্যের মনীষীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয় গড়ে তুলেছিলেন। বিখ্যাত মনীষী উইলিয়াম রস্কো, দার্শনিক জেরেমি বেনথাম, জেমস মিল, উইলিয়াম গডউইনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরাও তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

মনের দিক থেকে তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদী ছিলেন। স্পেনের শোষণ থেকে দক্ষিণ আমেরিকার উপনিবেশগুলোর মুক্তির সংবাদে নিজ বাসভবন আলোকসজ্জিত করেন এবং বহু বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে আপ্যায়ন করেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মানব মুক্তি-সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন সর্বদাই। ফ্রান্সে ১৮৩০ সালে বিপ্লবের সংবাদে তিনি উৎফুল্ল হন। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার স্ফুরণ ঘটে ফরাসি দেশে। ১৮৩২-এর শেষের দিকে তিনি প্যারিস যান এবং ফরাসি সম্রাট লুই ফিলিপ তাঁকে সংবর্ধনা দেন। ইংল্যান্ডে ফিরে তিনি তাঁর ইউনিটারিয়ান বন্ধু ল্যান্ট কার্পেন্টারের আমন্ত্রণে ব্রিস্টল গমন করেন। সেখানে ল্যান্ট কার্পেন্টারের কন্যা মেরির আতিথ্য গ্রহণ করেন। ব্রিস্টলের শহরতলি স্টেপলটনের বিচহাউসে মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে রাজা রামমোহন রায় পরলোকগমন করেন ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। সেখানেই তাঁকে প্রথমে সমাধিস্থ করা হয়। তবে তাঁর মৃত্যুর ১০ বছর পর প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের অর্থায়নে ও প্রচেষ্টায় ব্রিস্টলের আর্নস ভ্যাল সমাধিস্থলে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

বহু ভাষা, শাস্ত্রীয় জ্ঞান, সমাজ সংস্কারের আপ্রাণ চেষ্টা এবং বাগ্মিতার জন্য রামমোহন দেশে-বিদেশে সবার কাছে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ব্রিস্টলে এই মনীষী ও মহান সমাজ সংস্কারকের সমাধিস্থলে উপস্থিত হয়ে বিনম্র শ্রদ্ধা জানানোর।

লেখক : সাবেক সিনিয়র সচিব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর