শুক্রবার, ৯ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

হজ সামর্থ্যবানদের ফরজ ইবাদত

এম এ মান্নান

হজ সামর্থ্যবানদের ফরজ ইবাদত

হজের মাস জিলহজ আগত প্রায়। প্রতি বছর হজে ২০ লাখের বেশি হাজী অংশ নেন। কভিড-১৯ মহামারীর কারণে গত বছরের মতো এবারও ঘটছে এমন এক হজের ঘটনা যার সঙ্গে বিশ্ববাসী খুব একটা পরিচিত নয়। এ বছর হজব্রত পালিত হবে সৌদি আরবে অবস্থানরত দেশি-বিদেশি গুটিকয় লোক নিয়ে। করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ মহামারী দুনিয়াজুড়ে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ায় হজে বিদেশ থেকে হাজীদের অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। হজ পালনের স্বপ্ন লালন করেও লাখ লাখ মানুষকে আশাহত হতে হচ্ছে।

আভিধানিক অর্থে হজ শব্দের অর্থ ইচ্ছা বা সংকল্পবদ্ধ হওয়া। তবে ইসলামী বিধানে হজ বলতে বোঝায় বায়তুল্লাহ প্রদক্ষিণ করা। হজ ইসলামের পাঁচ ভিত্তির অন্যতম। হজের মাসে নির্ধারিত দিনসমূহে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বায়তুল্লাহ ও সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহ জিয়ারত ও বিশেষ কার্যাদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সম্পাদন করাকে হজ বলা হয়। হজের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস ও দীর্ঘ পটভূমি। এর প্রতিটি কাজ ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত ও তাৎপর্যপূর্ণ। জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আসার পর হজরত আদম ও হাওয়া (আ.) পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে তাঁরা একে অন্যকে খুঁজতে থাকেন। অবশেষে আল্লাহর রহমতে তাঁরা আরাফাতের ময়দানে পরস্পর মিলিত হন। তারই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আদমসন্তানরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতি বছর আরাফাতের মহামিলন প্রান্তরে সমবেত হয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করেন। তাঁরা তাঁদের হৃদয়-মন দিয়ে আল্লাহকে উপলব্ধি করার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। এভাবে সাফা-মারওয়ার মধ্যে সায়ি, মিনায় শয়তানকে কঙ্কর মারা এবং কোরবানির প্রেক্ষাপট যা হজরত ইবরাহিম (আ.) ও বিবি হাজেরা এবং তাদের পুণ্যবান সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-এর দ্বারা রচিত হয়েছে আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। এভাবে হজরত আদম (আ.) থেকে আজ পর্যন্ত আল্লাহতে নিবেদিতপ্রাণ নবী-রসুল তথা আল্লাহর নেক্কার সত্যপ্রাণ ও মকবুল বান্দাদের পরম ব্যাকুলতার সঙ্গে আল্লাহর ঘর তাওয়াফের মাধ্যমে হাজার বছরের আত্মনিবেদনে রচিত হয়েছে হজ ও জিয়ারতের সুবিশাল প্রেক্ষাপট। সাংসারিক প্রয়োজন মিটিয়ে কাবা শরিফ পর্যন্ত যাতায়াতের অর্থসংস্থানের সুযোগ যাদের রয়েছে তাদের জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ পালন ফরজ। হজ পালনকালে নিজেকে আল্লাহর দরবারে হাজির ভাবতে হয়। হজ পালনের জন্য ইহরাম অবস্থায় থাকাকালে অর্থাৎ ১০ জিলহজ পর্যন্ত স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন না করার বিধান রয়েছে। হজের প্রধান কাজ তালবিয়াহসহ কাবাঘর তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ। হজের ফরজ তিনটি। প্রথমত ইহরাম বাঁধা অর্থাৎ হজের নিয়তে মিকাত থেকে দুই খন্ড সেলাইবিহীন কাপড় পরে সব সময় বেশি বেশি তালবিয়াহ অর্থাৎ লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা-শারিকা লাক (আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির, আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই আর সাম্রাজ্যও তোমার, তোমার কোনো শরিক নেই) পাঠ করা। দ্বিতীয়ত ৯ জিলহজ ফজর নামাজের পর আরাফাতের ময়দানে অবস্থান। আরাফাতের নামরা নামক স্থানে জোহর ও আসরের নামাজ এক আজান ও দুই ইকামতসহ কসর পড়ে সম্পন্ন করা এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। তৃতীয়ত কাবা তাওয়াফে জিয়ারত করা। হজের ওয়াজিব পাঁচটি- ১. আরাফাতের ময়দান থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় মুজদালিফায় অবস্থান এবং সেখানে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায়। ২. সাফা ও মারওয়া পাহাড় দুটির মাঝে দৌড়ানো। ৩. কঙ্কর নিক্ষেপ। ৪. তাওয়াফে সদর অর্থাৎ মক্কার বাইরের হাজিদের জন্য বিদায়কালীন তাওয়াফে আলবিদা করা। ৫. মাথার চুল মুড়িয়ে ফেলা এবং মহিলাদের জন্য চুল কেটে ছোট করা। হজের কিছু সুন্নত- ১. মক্কা পৌঁছেই পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ করা। ২. সতর ঢেকে তাওয়াফ করা। ৩. মিনা ময়দানে রাতযাপন। ৪. বিভিন্ন জায়গায় মাসনুন দোয়াগুলো পাঠ। ৫. নিজে হেঁটে তাওয়াফ করা। ৬. নিজ ডান দিক থেকে কাবা শরিফের তাওয়াফ আরম্ভ করা। ৭. তাওয়াফের পর দুই রাকাত নামাজ আদায় করা ইত্যাদি। হজ পালনের জন্য কোনো মোমিন যখন নিয়ত করে তখন সে আল্লাহর পথে নিজেকে সমর্পণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। নিজের সব পাপ থেকে আল্লাহর কাছে মাফ চায়। আল্লাহ ও রসুলের নির্দেশিত পথে নিজেকে আলোকিত করার শপথ নেয়। সর্বপ্রথম হজরত আদম (আ.) বায়তুল্লাহয় হজ আদায় করেন। এরপর হজরত নুহ (আ.)সহ অন্য নবী-রসুলরা বায়তুল্লাহ জিয়ারত ও তাওয়াফ করেছেন। হাদিসে বর্ণিত আছে, বায়তুল্লাহর পুনর্র্নির্মাণের কাজ সমাধার পর হজরত জিবরাইল (আ.) ইবরাহিম (আ.)-কে এ পবিত্র ঘর তাওয়াফ ও হজ করার জন্য বললেন। এ নির্দেশ পেয়ে হজরত ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.) কাবাঘর প্রদক্ষিণসহ হজের যাবতীয় কর্মকান্ড সমাধা করেন। এরপর আল্লাহতায়ালা হুকুম করলেন, ‘হে ইবরাহিম! তুমি গোটা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা ছড়িয়ে দাও।’ কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে ও সকল প্রকার ক্ষীণকায় উটের পিঠে তারা আসবে দূরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে।’ সুরা হজ, আয়াত ২৭। তখন হজরত ইবরাহিম (আ.) একটি উঁচু স্থানে আরোহণ করলেন এবং ডানে-বাঁয়ে পূর্ব-পশ্চিমে ফিরে হজের ঘোষণা করলেন।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে হজ পালন এবং তাঁর পথে সমর্পিত হওয়ার তওফিক দান করুন।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর