শনিবার, ১০ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

পানিসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা

মো. কামরুল আহসান তালুকদার

পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ পানি কিন্তু মিঠা পানির পরিমাণ খুবই কম। তাই পানিসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা সারা বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পৃথিবীতে প্রাপ্ত মিষ্টি পানির শতকরা প্রায় ৭০ ভাগই ফসল উৎপাদনে কৃষক ব্যবহার করে। শিল্পকারখানায় ব্যবহার করা হয় ২০ ভাগ এবং শতকরা ১০ ভাগ মিষ্টি পানি ব্যবহার করা হয় গৃহস্থালির কাজে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সবুজ বুকের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে হাজারো ছোট বড় নদী। কেউ বলে নদ-নদী বাংলাদেশের হৃদপি-। কেউ বলে ফুসফুসের মতো কাজ করে। যে যা-ই বলুক নদ-নদীর গুরুত্ব অনুধাবন করতে শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এই দেশটি নদ-নদী বিধৌত পলিমাটি দিয়ে নিজেকে করেছে উর্বর, ফুল ফল আর ফসলে করেছে সমৃদ্ধ। নদী গ্রামীণ জনপদকে কর্মচঞ্চল রাখতে একদিকে যেমন অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে তেমনি গতিময় শহুরে জীবনকে আরও বেগবান করতে নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে, অন্যদিকে অপরিশোধিত ও পয়ঃবর্জ্য ফেলে ভয়াবহ পানিদূষণ করা হচ্ছে। গত এক যুগে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হলেও প্রতি বছর বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতির কারণে দেশের সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে পানিসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি। পানিসম্পদের সুষ্ঠু সংরক্ষণ এবং বছরব্যাপী বহমানতা বজায় রাখতে পারলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা শুধু নয় বিপুল পরিমাণ খাদ্য উদ্বৃত্ত রাখা সম্ভব। বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ ও নিষ্কাশন, নদীতীর ভাঙন প্রতিরোধ, ব-দ্বীপ উন্নয়ন, ভূমি পুনরুদ্ধার প্রভৃতি বিষয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যারাজ, রেগুলেটর, সøুইস, খাল, বেড়িবাঁধ, রাবার ড্যাম, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ ও খাল খনন-পুনঃখনন করে সেচ, জলাবদ্ধতা নিরসন, বন্যা প্রতিরোধ, নদীর ভাঙন প্রতিরোধ, ভূমি পুনরুদ্ধারে কাজ করছে।

বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনে সেচধর্মী প্রতিটি প্রকল্পে সেচ সম্প্রসারণ, ফসল উৎপাদন, এরিয়া বৃদ্ধি এবং ফসল উৎপাদনের নিবিড়তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। টেকসই ও নির্ভরযোগ্য ফসল উৎপাদনের জন্য আধুনিক কৃষি-ব্যবস্থার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সেচ। সেচের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে সেচের পানির প্রধান দুটি উৎস- ক. ভূপৃষ্ঠস্থ পানি এবং খ. ভূগর্ভস্থ পানি। ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লবণ ও রাসায়নিক দ্রব্য দ্রবীভূত থাকে। এসব লবণ ও রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমাণ বেশি হলে তা গাছের জন্য ক্ষতিকর। রাসায়নিক পদার্থগুলোর মধ্যে রয়েছে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, কার্বনেট, বাই-কার্বনেট, সালফেট ইত্যাদি। সোডিয়াম কার্বনেট যৌগ পানিতে বেশি পরিমাণ থাকলে ফসল তা সহ্য করতে পারে না। সেচের পানি ঘোলা হলে তা মাটির রন্ধ্র আটকে দিয়ে মাটি শক্ত করে ফেলে। সেচের পানিতে বিষাক্ত আর্সেনিক, ক্যালসিয়াম, সিসা ইত্যাদি থাকে যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর।

নদী ভাঙন, জলাবদ্ধতা, বন্যা ও পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে ছোট-বড় নদী-নালা-খাল-ডোবা ড্রেজিং করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ৪ হাজার ৮৭ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ের মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজের কমান্ড এলাকার ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এরিয়া পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প সম্প্রতি একনেকে পাস হয়েছে। এ প্রকল্পের কমান্ড এরিয়া ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে পানি সরবরাহ করা হবে। তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকের সেচের পানি সরবরাহ করতে ৭৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সেকেন্ডারি ও টারসিয়ারি ক্যানেল নির্মাণ করা হবে। সেচ সুবিধার কারণে ফসলের নিবিড়তা ২৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। অতিরিক্ত ১ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হবে এবং অন্যান্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়বে প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন।

প্রতি বছর বাংলাদেশের নদীগুলোয় বিপুল পরিমাণ বালু ও পলি জমা হয়। এসব বালু ও পলি নিয়মিত অপসারণের জন্য নিয়মিত ড্রেজিং দরকার। শুধু প্রকল্পভিত্তিক ড্রেজিং করে এ বালু ও পলি অপসারণ করা সম্ভব নয়। নদী সংস্কার ও পরিচর্যার গুরুত্ব বিবেচনা করেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বছরব্যাপী নদী খননের নির্দেশনা দিয়েছেন। নদীর পানিপ্রবাহ ঠিক রাখা এবং ভাঙন প্রতিরোধে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পুরো বছরের পরিকল্পনা থাকতে হবে। বোরো মৌসুমে ১ কেজি ধান উৎপাদনে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এ পানির জোগান আসে ভূগর্ভস্থ পানির উৎস থেকে। সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় পানির স্তর দিন দিন নেমে যাচ্ছে। পাম্পের মাধ্যমে পানি তুলতে গিয়ে চাপ বেড়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের ওপর। হাজার কোটি টাকার জ্বালানি ব্যয় হয়। এ দেশের কৃষক সেচের পেছনে মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৬২ শতাংশ খরচ করে যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। অনেক দেশ ভূগর্ভস্থ পানি কৃষিকাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। ভারত, চীন ও ভিয়েতনাম সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি সীমিত করেছে। পানির স্তর যত নিচে নামবে উৎপাদন খরচ ততই বাড়তে থাকবে।

লেখক : গবেষক।

সর্বশেষ খবর