রবিবার, ১১ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

থ্রি নট থ্রি

মাকিদ হায়দার

থ্রি নট থ্রি

‘ভূতলে পড়িয়া শশী খান গড়াগড়ি’ প্রবাদটি যদিও খুব প্রাচীন, তবে প্রবাদের বাক্যগুলো অতুলনীয়। সম্ভবত প্রাচীনকালেই ভারতীয় কেউ একজন ওই অসামান্য কথাটি বলেছিলেন। পৃথিবীতে অর্থ আছে যার তিনি সমাজে ধনী ব্যক্তি রূপে গণ্য হয়ে থাকেন। আমেরিকার বিল গেটস পৃথিবীর অন্যতম ধনীর একজন। দিন কয়েক আগে দাম্পত্য জীবনের ইতি টানলেন। ২৭ বছর একসঙ্গে ঘর করার পর স্বামী-স্ত্রী দুজনই সিদ্ধান্ত নিলেন উভয়ের একসঙ্গে বসবাস করা অসম্ভব। বড় মেয়েটির বয়স ২৫। আরও দুটি সন্তান তাদের থাকলেও বিল ও মিসেস বিলের বিচ্ছেদের প্রধান বিষয়টি হলো, দুজনেরই অঢেল সম্পদ, বিল বিয়ের আগে প্রেম করেছিলেন সাত বছর। পরে বিয়ে। তার পরে এ বিচ্ছেদ। মাইক্রোসফটের মালিক না হয়ে যদুমধু হলে ওই দম্পতির কোনো খবরই পেত না পৃথিবীর পত্রপত্রিকার পাঠক। এমন ঘটনা বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিনই হচ্ছে, প্রেম করে বিয়ে, বিয়ের পরই প্রেমিকপ্রবরের আচার-আচরণ এবং মানসিক অত্যাচারে প্রেমিকা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না- আমার প্রেমিক বিয়ের আগে হাজার রকমের কথা বলতেন। কথাগুলো শ্রুতিমধুর হতো। যখন আষাঢ়-শ্রাবণের অল্পস্বল্প বৃষ্টিতে দুজনাই বাংলা একাডেমির গেট থেকে রিকশায় চেপে ধানমন্ডির দিকে যেতে যেতে প্রেমিকপ্রবর শোনাতেন ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, প্রেম দেব মেপে’। প্রেমিকা চাকরি করতেন একটি সাপ্তাহিকে, তাই তার ছুটি ছিল রবিবার। আর সে রবিবারেই প্রেমিকাকে সঙ্গ দিতে হতো, হুডতোলা রিকশায়, আষাঢ়-শ্রাবণের টিপটিপ বৃষ্টির ভিতরে। যৌবনের রীতিনীতি সবকিছু ভিজে যেত, ভেসে যেত দুজনার অন্তরঙ্গ মুহূর্তে- এটাই হলো যৌবনের ধর্ম। তারপর একদিন দুই পক্ষের কাউকে কিছু না জানিয়ে অতি উৎসাহী বন্ধু-বান্ধবীদের সহযোগিতায় গিয়ে পৌঁছালেন মগবাজারের কাজী অফিসে। পরে একদিন দুজনাই জানিয়ে দিলেন পরিবারকে। আমরা বিয়ে করেছি, ছেলেটি জানিয়েছিল তার ভগ্নিপতিকে। মেয়েটি তার মামাকে। ভগ্নিপতি জানতে চেয়েছিলেন মেয়েটির নাম, ঠিকানা, পড়ালেখা। সবশেষে বলেছিলেন, ঢাকায় বাড়ি আছে কি না? আর্থিক সংগতি অর্থাৎ বিত্তশালী কি না? ভগ্নিপতির বিবিধ প্রশ্নের উত্তর শেষে রোকন আলী শেখ জানিয়েছিলেন শামীমার বাবার বাড়ি আছে লালমাটিয়ায়। তৃপ্ত ভগ্নিপতি তৃপ্তির সঙ্গে বলেছিলেন, সব ঠিক আছে। অনুরূপভাবে শামীমার মামা, রোকন আলী শেখের ভগ্নিপতির প্রশ্নগুলোই করেছিলেন তার অতি আদরের ভাগ্নিকে। ভাগ্নি শুধু জানিয়েছিলেন, ঢাকায় বাড়িঘর নেই, বাড়িঘর পাবনায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে ওর পিতা আহত হয়ে দীর্ঘদিন ছিলেন হাঙ্গেরিতে। সুস্থ হওয়ার পর দেশে ফিরলে পাবনা শহরের বাণী সিনেমা হলের পাশে একটি চায়ের দোকান দিয়েই সংসার চলত। সে আয়ের ওপর নির্ভর করেছিল দুই ভাইবোনের পড়ালেখা। রোকন অসম্ভব ভালো ছাত্র হওয়ার সুবাদে পাবনা জিলা স্কুলে বিনা পয়সায় মাধ্যমিক দিয়ে ভর্তি হয়েছিল শহীদ বুলবুল কলেজে। উচ্চমাধ্যমিকে রাজশাহী বিভাগে নবম হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। রোকন আলীর এক দূর সম্পর্কের চাচা ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন বাংলা বিভাগে।

গত ২৫ এপ্রিল রবিবার বাংলাদেশ প্রতিদিনে সম্পাদক নঈম নিজামের একটি লেখা অনেকেরই দৃষ্টি কেড়েছে। লেখাটির শুরুতেই নঈম নিজাম জানিয়েছেন এক হৃদয়বিদারক প্রেমকথা। তিনি অধিকাংশ লেখাতেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখে থাকেন। গান, নাটক, সিনেমা কোনো কিছু বাদ পড়ে না। উদাহরণ শেষে তিনি পাঠকদের নিয়ে যান মূল বক্তব্যে। যেমন ওই রবিবারের লেখাটির নাম দিয়েছেন ‘রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রীদের কাজটা কী’। শুরুটা করেছেন আমার প্রিয় লেখক বিনয় কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের একটি অসামান্য গ্রন্থ ‘দৃষ্টিপাত’ থেকে। লেখক ব্যবহার করেছেন ছদ্মনাম যাযাবর। নঈম নিজাম শুরু করেছেন যাযাবরের অসাধারণ সেই কলমের গাঁথুনির কথা। যা এখনো ঝাঁকি দেয় আমাদের। যাযাবরের দৃষ্টিপাতের দুটি লাইন এখনো মনে গেঁথে আছে- ‘প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কী? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কান্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুবাক আধারকার।’ রোকন আলী শেখের পরিবার গরিব হওয়ার সুবাদে একদিন শামীমা বিদায় নিয়েছিলেন। তার প্রেমিকপ্রবরকে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে ফেলে। অনেকটা আধারকারের মতোই।

ওপরের ওই কয়েকটি লাইন পড়ার পর মনে হয়েছিল লেখক বোধকরি প্রেমবিষয়ক জ্বালা-যন্ত্রণা নিয়েই তার ওই লেখাটি লিখেছেন। আমি লেখকের নিয়মিত পাঠক। লেখাটির ভিতরে অন্য প্রসঙ্গ এসেছে। অতুলনীয়। অন্যরা নিয়মিত লিখছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনে, তাদের লেখাগুলো যে মানোত্তীর্ণ অন্তত আমার কাছে পাঠক হিসেবে অনেক সময় গ্রহণযোগ্যতা পায় না। আবার অনেকের লেখা যেমন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা আমাকে কমপক্ষে বার দুয়েক পাঠ করতে হয়। স্যারের একাধিক গ্রন্থের ভিতরে আমি একটি গ্রন্থ বেশ অনেকবার পাঠ করার পর নিজেকে আশ্বস্ত করেছি এই ভেবে যে, একজন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হয়ে তিনি চমৎকারভাবে পাঠকদের উপহার দেন কঠিন বাংলা ভাষায়। যা সাধারণ পাঠকের বুঝে উঠতে কষ্ট হয়। যেমন হয়েছিল আমার। তাঁর ১৫টি প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থটির নাম ‘স্বাধীনতার স্পৃহা সাম্যের ভয়’। প্রথম প্রবন্ধটির ‘নাম সাম্য ও স্বাধীনতা’ এবং শেষ প্রবন্ধটির নাম ‘দয়া ও মায়া’। মাঝের ১৩টি একাধিকার পাঠান্তে তৃপ্ত হয়েছি আমি। স্যার, কিন্তু মূল বিষয়টিতে আসেন অনেক আগেই। আমি আজকে ওইরকমই চিন্তা করেছি। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে এমনকি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। তিনিও তাঁর লেখায় মূল বক্তব্যে ফেরার আগে একটি ভূমিকার অবতারণা করেন। ফলে তাঁর লেখায় শেষাবধি পাঠককে নিয়ে যেতে বাধ্য করেন। যেমন আমাকে করেন। সিদ্দিকীকে প্রথম দেখেছিলাম ১৯৭২ সালে মোহাম্মদপুরে। একটি খোলা জিপে। দূর থেকে তাঁকে শ্রদ্ধা, সালাম দুটোই জানিয়েছিলাম। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতার সপরিবারে নৃশংস হত্যার পর ভারতে দীর্ঘদিন অবস্থান করেছিলেন ওই হত্যার প্রতিবাদকারী কাদের সিদ্দিকী। ইতিমধ্যে একাধিক পুস্তকের রচয়িতা তিনি। তাঁর অগ্রজ আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, তাঁকেও চিনতাম। তবে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল তিনি যখন পাটমন্ত্রী ছিলেন। তবে তার অনেক আগেই তাঁর স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল বাংলাদেশ বেতারে। লায়লা সিদ্দিকী অনেক কবির চেয়ে ভালো কবিতা লিখতেন। এখন লিখেন না কেন জানি না। তবে তাঁর একটি প্রকাশনা সংস্থা আছে, ‘নান্দনিক’। সেই নান্দনিক থেকে আমার গোটা চারেক কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত বই চারটির ‘রয়্যালটি’ পাটমন্ত্রী মহোদয় নিজের হাতেই দিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন ঈর্ষণীয় অর্থ। যেটি আমি কল্পনা করতে পারিনি। শ্রদ্ধেয় লতিফ সিদ্দিকী আমেরিকায় গিয়ে ধর্মবিষয়ক কিছু কথা বলায় পরে তিনি আর মন্ত্রী তো রইলেনই না, এমনকি আওয়ামী লীগের সঙ্গেও না। তবে সুখের বিষয় বেশ কিছুদিন আগে সম্ভবত গত বছর জনাব কাদের সিদ্দিকী আমাকে ফোন করেছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি লেখা পাঠান্তে। তিনি যে কেন আওযামী লীগ থেকে দূরে গেলেন সে বিষয়ে আমি অজ্ঞ। এমনকি ড. কামাল হোসেন। যদি জানতাম কৃতার্থ হতাম। যদিও দল ত্যাগ করা তাঁদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাতের পর আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা খুনি খন্দকার মোশতাকের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছিলেন, সঙ্গে পেয়েছেন উপঢৌকন মন্ত্রীর চেয়ার। শুধু চার জাতীয় নেতা খুনির প্রলোভনে ধরা না দেওয়ায় ওই বছরের ৩ নভেম্বর নির্মমভাবে জেলখানার ভিতরেই নিহত হয়েছিলেন। তবে মাস কয়েক যেতে না যেতেই খুনি মোশতাককে আরেক ষড়যন্ত্রকারী জিয়াউর রহমান বুটের গুঁতো দিয়ে নামালেন। নিজেই বাংলাদেশের স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হয়ে বিভিন্ন দল থেকে নেতা, পাতিনেতা ভেড়ালেন নিজ দলে। আওয়ামী লীগের কিছু নেতাও যোগ দিলেন তার সঙ্গে। মুন্সীগঞ্জের দুজন, নোয়াখালীর জনাকয়েক এমনকি সমগ্র বাংলাদেশ থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে গঠিত হলো মন্ত্রিসভা। শাহ আজিজুর রহমান হলেন প্রধানমন্ত্রী। জয়পুরহাটের খুনি আবদুল আলীম হলেন মন্ত্রী। শাহ মোয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান, মওদুদ আহমদসহ আরও অনেকে নাম লেখালেন নতুন দলে। নামগুলো লিখলে কয়েক পৃষ্ঠা হয়ে যাবে। তবে ১৯৭৯ সালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে জামায়াতের নেতা যিনি পূর্ব পাকিস্তান উদ্ধার করতে পাকিস্তান থেকে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে উপস্থিত হওয়ার কিছুকাল পরই ১৯৭৫ সালে সেই ১৫ আগস্ট এলো বাংলাদেশে। অন্যদিকে ১৯৭৬ সালে মায়ের অসুখের অজুহাতে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে গোলাম আযম এসে উঠলেন তার হারানো পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ আমরা যখন ১৯৭১ সালে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, কামারুজ্জামান এবং আরও জনাকয়েককে সঙ্গে নিয়ে নিয়াজি-টিক্কা খানের সঙ্গে মিটিং করেছেন, কীভাবে মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের নৃশংসভাবে হত্যা করা যায়। গোলাম আযম গংদের কুবুদ্ধিতে রাজাকার আলবদর আলশামসের জন্ম হয়েছিল এ দেশে, মুক্তিযুদ্ধের বছরে। রবিবার ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে আমাদের দোহারপাড়ায় প্রথম শহীদ হয়েছিলেন শেখ উজ্জ্বল। রাজনীতিতে দলবদল খুবই স্বাভাবিক। যেমন ঈশ্বরদীর হাবিবুর রহমান হাবিব, পাবনার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল। হাবিব বিএনপিতে, ইকবাল গেলেন জাসদে। একদা যারা আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় ছিলেন, ছিলেন তথ্যমন্ত্রী তাদেরই একজন পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার সাবেক অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। ওই রকম আরও অনেক আঁতেল লোকের নাম বলা যায়। যখনই ওইসব রাজনীতিবিদ নিজ দলে সুবিধা পান না তখনই দল ত্যাগ করেন। অধ্যাপক সাইয়িদ আওয়ামী লীগ ছেড়ে অভিমানে যোগ দিয়েছিলেন ড. কামাল হোসেনের গণফোরামে। সেখানে গিয়ে সুবিধা করতে না পেরে অন্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। যারা একদা বাংলাদেশের আকাশে নিজেদের শশি ভাবতেন আজকে তারাই ভূতলে পড়িয়া ধুলোতে খান গড়াগড়ি।

এবার থ্রি নট থ্রির কথা বলা যেতে পারে। আমার জানা মতে, পাকিস্তান আমলে অনেক জাঁদরেল সিএসপি ছিলেন যাঁদের ছায়ার ওপর দিয়ে চলাফেরা করা যেত না। সেসব সিএসপির কেউ কেউ মতিঝিলে কয়েক কাঠা জমির ওপর নির্মাণ করেছেন কয়েক তলা ভবন। পাবনার বিখ্যাত কন্ট্রাক্টর মনছের আলী বিশ্বাসকে বিশাল একটি কন্ট্রাক্ট দিয়ে পাবনার মধ্যষাটের এক জেলা প্রশাসক বানিয়ে নিয়েছেন মতিঝিলের ভবনটি। আরেকজন সিএসপি প্রায় ২০-২৫ বিঘা জমি সাভারে কিনেছিলেন উৎকোচের টাকায়। এবং মৎস্য অধিদফতরের একজন পরিচালক শামসুল হক তিনিও পড়েছিলেন থ্রি নট থ্রিতে। তিনি বিখ্যাত খুনি মেজর ডালিমের পিতা। বাড়ি গুলবাগে।     

লেখক :  কবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর