রবিবার, ১১ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

রথযাত্রা

ফণীন্দ্র সরকার

রথযাত্রা

সনাতন ধর্মের অনুসারী হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিভিন্ন উৎসবের অন্যতম একটি প্রধান উৎসব রথযাত্রা। আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে এ উৎসবটি শুরু হয়। এক সপ্তাহ পর ফিরতি রথযাত্রার মধ্য দিয়ে উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে। মহাধুমধামের এ উৎসব সামাজিক অনন্য বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত। এর একটা প্রাকৃতিক রূপরেখা রয়েছে। জ্যোতির্বিদ্যায় দেখা যায়, মহাকাশে বিষুবরেখা থেকে সূর্য একবার উত্তরে এবং একবার দক্ষিণে বার্ষিক পরিক্রমণ করে। সূর্য সপ্তঅশ্ব চালিত রথে উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন পরিক্রমণ করে। মূলত সূর্যের বিষুবরেখার উত্তর ও দক্ষিণের পরিক্রমণের সঙ্গে রথযাত্রা এবং ফিরতি রথযাত্রার মিল রয়েছে। এ দুটো যাত্রা হয়ে থাকে আষাঢ়ে। উল্লেখ্য, হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে সূর্যও দেবতা। কার্যত প্রকৃতি উৎসারিত সবকিছুই পরম সৃষ্টিকর্তার লীলাবিধৌত। ধর্মীয় বিশ্বাসের এক অনুপম সৌন্দর্যবোধ থেকেই বিভিন্ন উৎসবের উৎপত্তি। রথযাত্রা তেমনি একটি সামাজিক সৌষ্ঠবমন্ডিত উৎসব। পুরাণে এর নানা বিশ্লেষণ রয়েছে। পৌরাণিক কাহিনির আলোকে রথযাত্রার ব্যাপক বিশ্লেষণ অপরিহার্য। তবে এই ছোট লেখায় তা সম্ভব নয়। এর অনুভূতি নিয়ে দুটি কথা লিখছি। বর্তমানে রথযাত্রা উৎসবটি পুরনো প্রচলিত সর্বজনীন মঙ্গলময় উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশেই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এ উৎসব পালন করে থাকেন। তবে ভারতের ওড়িশা রাজ্যের পুরীর রথযাত্রা মূল কেন্দ্র। সমুদ্রতীরের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশবেষ্টিত পুরীর জগন্নাথ মন্দির। পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব বিশ্ববাসীর অজানা নয়। মতভেদে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে থেকেই ধর্মীয় উৎসব হিসেবে রথযাত্রা পালিত হয়ে আসছে। স্কন্দপুরাণমতে বিশ্বকর্মা নিম গাছের টুকরো দিয়ে জগন্নাথদেবের মূর্তি তৈরি করেন। বিঞ্চুর প্রতিবিম্ব হিসেবে স্বয়ং ব্রহ্মা এর পূজা করেন। সমুদ্রতীরে দৈবযোগে প্রাপ্ত নিম গাছের টুকরো থেকে জগন্নাথ মূর্তি নির্মিত হয় বিধায় জগন্নাথকে দারুব্রহ্ম নামেও অভিহিত করা হয়। জগন্নাথের মূর্তির আকার সম্পর্কে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। ওড়িয়া সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা যায় উৎকলে (ওড়িশা) একসময় বৌদ্ধধর্মের প্রাধান্য ছিল। ওড়িয়া সাহিত্যবিশারদরা রথ উৎসব নিয়ে নানারকম সাহিত্য রচনা করেন। সেই সাহিত্যের আলোকে বৈষ্ণবধর্মের প্রখ্যাত পন্ডিত ও দার্শনিক রামানুজের মতবাদের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। রামানুজের মতানুসারে জগন্নাথের বিগ্রহ বুদ্ধ, রামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণের সমন্বিত মূর্তি। রথোৎসব চলমান মন্দিরে বিগ্রহের পূজানুষ্ঠান। সাধারণত স্থিতিশীল মন্দিরে পূজানুষ্ঠান হয়। মন্দিরাভ্যন্তরে পূজানুষ্ঠানে ব্যাপকভাবে সাধারণের অংশগ্রহণ সম্ভব নয়। কিন্তু রথযাত্রা উৎসবে ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এর সর্বজনীন আধ্যাত্মিক একটা ভাবও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রথোপরি একপাশে প্রভু জগন্নাথ, মাঝখানে সুভদ্রা এবং বাঁয়ে বলভদ্র আসীন থাকে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলভদ্র সম্পর্কে ভাইবোন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণই জগন্নাথ হিসেবে রথে আরোহণ করেন। রথ হচ্ছে চাকাবিশিষ্ট স্থাপত্য। ধর্মীয় বিশ্বাসে অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী পুণ্য সঞ্চয়ের লক্ষ্যে রথ সড়কপথে টেনে নিয়ে যান। রথের মাঝে শিল্পিত মোটা রশি বাঁধা থাকে। সে রশি ধরে ভক্তরা টানতে থাকেন এবং রথে আসীন দেবমূর্তি দর্শন করেন গভীর ভক্তিসহকারে। এ রথোৎসব ধর্মীয় সংস্কৃতিকেও বিকশিত করেছে। আর প্রকটতম আধ্যাত্মিক বিষয়টি হচ্ছে, রথ আমাদের শরীর বা দেহ যন্ত্র। রথ এ দেহেরই প্রতীক। আত্মা হলো রথী বা রথের মধ্যে অবস্থানকারী। বুদ্ধি হলো সারথি বা চালক। মন হচ্ছে লাগাম। মানবদেহের ইন্দ্রিয়গুলো হচ্ছে ঘোড়া। ঘোড়ায় যেমন গাড়ি বা রথ টানে তেমনি আমাদের দেহকেও টেনে নিয়ে যায় ইন্দ্রিয়শক্তি। পার্থিব এ জগতে যতরকম ভোগ্য বিষয় রয়েছে সেগুলো দেহধারী রথের গমনপথ। ঘোড়া যদি ভালো এবং সুনিয়ন্ত্রিত হয় তবে সারথি রথটি সঠিকভাবে লক্ষ্যপথে পৌঁছে দিতে পারবে। আর যদি দুষ্ট হয় তবে রথ কোথায় টেনে নিয়ে যাবে বলা দুষ্কর। তেমনি ইন্দ্রিয় যদি সংযত হয়, সুনিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে মানব তার কল্যাণপথের সন্ধান পেয়ে সার্থক জীবনের স্বাদ অনুভব করবে। তাই রথ হচ্ছে একটি অনুভূতির নাম। এ কভিড সংক্রমণকালে রথযাত্রা উৎসবটির ব্যাপকতা না থাকলেও অনুভূতি সর্বদা দেদীপ্যমান। দেহরথের ইন্দ্রিয় সংযত হোক এটাই কামনা।

সনাতন ধর্মের প্রাণপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাবিলাসের অনবদ্য একটি অনুষজ্ঞ রথযাত্রা উৎসব। বহু মানবের মিলন ক্ষেত্র রথোৎসব ভগবদ্প্রেমের পীঠস্থান। প্রভু শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর অনুগত ভক্তদের অবাধ মানবীয় ভালোবাসার সুযোগ সৃষ্টি করে রথযাত্রা উৎসবকে মহিমান্বিত করেছেন। এ উপমহাদেশে রথযাত্রা উৎসবটি সামাজিকভাবে ব্যাপক মর্যাদা লাভ করেছে।

পুরীর জগন্নাথদেবের রথ উৎসবের আমেজে ভরপুর ছিল বাংলাদেশের ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলা। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ধামরাই মফস্বল শহরের প্রধান সড়কে রথের মহোৎসব হতো জাঁকজমকভাবে। প্রায় ৫০০ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করা ধামরাইয়ের রথটির কথা সবাই জানত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি জান্তা বাহিনীর নেতৃত্বে এ-দেশি রাজাকারদের সহযোগিতায় শৈল্পিক স্থাপত্য বিশাল আকারের রথটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় এক মাস রথটি দগ্ধ হচ্ছিল, তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের হৃদয়মন্দিরটিই যেন জ্বলছিল। ধামরাইয়ের প্রধান সড়কটি কয়লার পাহাড়ের রূপ ধারণ করছিল। যা হোক, দেশ স্বাধীন হলো, স্বাধীনতার এত বছর পরও অনুরূপ একটি রথ নির্মাণ সম্ভব হয়নি। বরং রথোৎসবের নির্ধারিত জায়গাও সংকুচিত হয়ে আসছে দিন দিন। ভূমিদস্যুদের কবলে পড়ে রাধামাধবের মন্দিরের জায়গাও বেদখল হয়ে গেছে। রথোৎসবে নেই আগের জৌলুশ। হিন্দু সম্প্রদায়ের আবেগের গুরুত্ব দিনে দিনে ম্লান হলেও এর ঘনত্ব এতটুকু কমেনি।

হিন্দু ভক্তদের মনের গভীরে রথোৎসবের রসধারা প্রবাহিত হয় আপন গতিতে। কেননা রথে আসীন জগন্নাথদেবের দারুবিগ্রহ চলমান রথে জীবন্ত বিগ্রহেরই প্রতীক হিসেবে বহমান। এভাবে বিশ্বব্রহ্মান্ডের বার্তা সব ভক্তের সামনে উপস্থিত হন। ভক্তরা ভাবগাম্ভীর্যে প্রার্থনা জানাতে সমবেত হন উৎসবে।

 

                লেখক : কলামিস্ট।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর