শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

কৃষি খাত ও ই-কমার্স

শাইখ সিরাজ

কৃষি খাত ও ই-কমার্স

২০১৯ সালের মার্চের শেষ দিকে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর একটি পর্বের আয়োজন করা হয়েছিল গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। অনুষ্ঠানে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশেদ নামে এক শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘এ এলাকায় প্রচুর সুপারি গাছ আছে। সেখানে প্রচুর সুপারি পাতার খোল হয়। আমি অনলাইনে দেখেছি এই সুপারির খোল দিয়ে থালা-বাটি তৈরি করা যায়। আমিও এমন একটি উদ্যোগ নিতে চাই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি থালা-বাটিগুলো বিক্রি করব কোথায়?’ উত্তরে বলেছিলাম, ‘তুমি বিষয়টি সম্পর্কে জেনেছ অনলাইন থেকে, তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানছ অনলাইন থেকে, বিক্রিও তো তুমি অনলাইনেই করতে পার।’ অনলাইন মার্কেট বা ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের বাজারে প্রবেশ সহজ করে দিয়েছে। আগে নতুন একটা পণ্য নিয়ে বাজারে প্রবেশ করা ছিল খুব কঠিন। কিন্তু সময় পাল্টেছে। অসংখ্য তরুণ মাথাভর্তি স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে। তারা কিছু একটা করতে চায়। শুধু একটু ধাক্কা দিয়ে পথটা ধরিয়ে দিলেই অসম্ভব সম্ভব করে ফেলতে পারে। যেহেতু আমি কৃষির মানুষ কৃষিকে ঘিরেই আমার কাজকর্ম। এসএমই বলেন আর ই-কমার্স বলেন, মগজে সবকিছুই আমার কৃষিকেন্দ্রিক। এক তরুণের গল্প দিয়েই আমি লেখাটি শুরু করছি। তরুণের নাম সাইফুল্লাহ গাজী। সাইফুল্লাহ গাজীর জীবনের গল্পটা যেন সিনেমার মতো। ১৯৯৬ সালে এসএসসি পরীক্ষার আগেই অভাবের তাড়নায় ভাগ্যের সন্ধানে নামতে হয় তাকে। চলে যান ভারতে। সেখানে এক গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। এক ছুটির দিনে ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পান একটা এলাকায় ‘প্রবেশ নিষেধ’ সাইন। কৌতূহল জন্মে তার। কেন সেখানে প্রবেশ করা যাবে না? কী হয় সেখানে? কৌতূহল থেকেই সেখানকার একজনের সঙ্গে গড়ে তোলেন বন্ধুত্ব। তারপর ভিতরে গিয়ে অবাক বনে যান, সে তো রঙিন মাছের ভুবন! ধীরে ধীরে সেই বন্ধুর কাছ থেকেই শিখে নেন কীভাবে রঙিন মাছ ব্রিড করতে হয়। ১৯৯৯ সালের শেষ দিকে ভারত থেকে ফিরে আসেন দেশে। অভাব তখনো তাড়া করে ফিরছে। ঢাকায় এসে কাজ শুরু করলেন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে। অল্প বেতনের চাকরিতে সংসার চালানো কঠিন। তার পরও বেঁচে থাকার তাগিদে চালিয়ে যেতে থাকলেন জীবিকার সংগ্রাম। ফ্যাক্টরিতে যেতে-আসতে চোখে পড়ে একটি রঙিন মাছের দোকান। সাইফুল্লাহ তখন জানালেন তিনি জানেন রঙিন মাছ থেকে কীভাবে বাচ্চা ফোটায়, জানেন এর প্রজনন প্রক্রিয়া। ২০০৪ সালের কথা। ৬২৫ টাকা পুঁজি করে নেমে গেলেন রঙিন মাছের ভুবনে। গ্রামে ফিরে একটা চৌবাচ্চায় শুরু করলেন রঙিন মাছের ব্রিডিং। সেই রঙিন মাছই রাঙিয়ে দিল তার জীবন। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১০ বছরে ৬২৫ টাকার রঙিন মাছ সংসার খরচ বাদে গিয়ে দাঁড়াল অর্ধ কোটিতে। যেন এক সোনার ডিম পাড়া হাঁসের গল্প। এখান থেকে পৌঁছে গেছে ২০টি পুকুরে। বড় বড় পুকুরে জাল ফেলছে আর সেই জালে রুই কাতলা মৃগেলের পরিবর্তে উঠছে শৌখিন রঙিন সব মাছ। বড় মনোরম সে দৃশ্য! বলা যায়, অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন সাইফুল্লাহ।

কৃষি খাতে এমন উদ্যোক্তা আছেন অগণিত। আমি মনে করি প্রতিটি কৃষকই আসলে উদ্যোক্তা। তাদের হাত ধরেই তৈরি হচ্ছে আগামীর অর্থনীতি। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে দেশে ৭৮ লাখের বেশি এসএমই প্রতিষ্ঠান রয়েছে, জিডিপিতে যাদের অবদান ২৫ শতাংশ। এসএমই খাতের এ অবদান ২০২৪ সালের মধ্যে ৩২ শতাংশে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এ বছর বাজেটে ফসল, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ উপখাতে বরাদ্দ হয়েছে ১৯ হাজার ৩০ কোটি টাকা। গেল বছরের তুলনায় ২ হাজার ৪৯ কোটি টাকা বেশি। কিন্তু কৃষি খাতের সবচেয়ে দুর্বল দিক বিপণনব্যবস্থা। এ নিয়ে বাজেটে কোনো নির্দেশনা নেই। আমদানিনির্ভর কৃষি যান্ত্রিকীকরণে দেওয়া ভর্তুকি আপাতত ইতিবাচক মনে হলেও স্থানীয় কৃষিশিল্প বিকাশ জরুরি। কৃষি খাতে এসএমই যেমন রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, পাশাপাশি ই-কমার্স প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে কৃষক সহজেই বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন। ই-কমার্সের সরকারি নীতিমালায় এসএমইর জন্য ১৩২টি খাতের উল্লেখ আছে, যার প্রথমটি হচ্ছে কৃষি ও কৃষির উপখাত। অথচ এসএমইতে অন্য খাতগুলোর উপস্থিতি যেমন লক্ষণীয়, কৃষিসংশ্লিষ্ট খাতসমূহের উপস্থিতি তার চেয়ে ম্লান মনে হয়। করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতি ওলট-পালট করে দিলেও পৃথিবীজুড়েই ই-কমার্স খাত সমৃদ্ধ করেছে। লকডাউন উঠে যাওয়ার পরও অনেক মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে অনলাইনে কেনাকাটা। বাংলাদেশে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় গেল বছর অনলাইনে কেনাকাটা বেড়েছে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ, অনলাইনে বেচাকেনা হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। অনলাইনে বেচাকেনার কথায় ২০০৮ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ল। তখনো অনলাইনে পণ্য বেচাকেনা সেভাবে শুরু হয়নি।

ঈশ্বরদী থেকে কৃষক ময়েজ আমাকে ফোন দিলেন। বললেন, ‘আপনার ইমেইল নম্বরটা দেন (তখনো গ্রামের মানুষ দূরে থাক আমরাও ইমেইল আইডি বলতে শিখিনি)।’ ঘণ্টা চারেক পর ময়েজ আমাকে বললেন, ‘স্যার, আপনার ইমেইল চেক করে দেখেন সব পাঠিয়ে দিয়েছি।’ ইমেইল খুলে দেখি গরুর ছবি, ওজন, দামসহ সব তথ্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। বিস্মিত আমি। ময়েজ জানতেনও না একদিন ই-কমার্স বা অনলাইন মার্কেটিং শুরু হবে, নিজের হাতের মোবাইল ফোনটি নিজের অজান্তেই ব্যবহার শুরু করেছিল অনলাইন মার্কেটিং। কেউ ময়েজকে শিখিয়ে দেয়নি, এটি তার আনকোরা আইডিয়া। এভাবেই কৃষক তার নিজের বুদ্ধি -বিবেচনায় উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন কৌশল নিজের মতো করে প্রয়োগ করছে।

গত বছর সরকারসংশ্লিষ্টরা যখন ঘোষণা করলেন স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে বরাবরের মতোই কোরবানির পশুর হাট বসানো হবে, তখন আমি করোনার সার্বিক পরিস্থিতি উল্লেখ করে তাদের বিকল্প পথ খোঁজার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। চ্যানেল আইয়ের নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘টু দ্য পয়েন্ট’-এর এক আলোচনায় বলেছিলাম কোরবানির পশুর অনলাইন বাজারব্যবস্থা শক্তিশালী ও কার্যকরের জন্য। প্রতিটি ইউনিয়নেই ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে। সরকার চাইলে এ জনশক্তি ও অবকাঠামো ব্যবহার করে সহজেই কোরবানির পশুর অনলাইন মার্কেট চালু করতে পারে। এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম আইসিটি-বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। তাঁরা তখন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় এ বছরও অনলাইনে কোরবানির বাজার বসেছে। ঈদুল আজহা সামনে রেখে অনলাইনে ও ডিজিটাল পশুর হাট এরই মধ্যে জমে উঠেছে। সময়ের প্রয়োজনেই ই-কমার্স প্ল্যাটফরমগুলো পৌঁছে গেছে কৃষকের কাছে। কৃষক এখন খেত থেকেই ফসল অনলাইনে বিক্রি করে দিচ্ছে। যে বিষয়গুলো আগে দেখে এসেছি উন্নত দেশে। মনে পড়ে ২০১৭ সালে চীনের জংশানের শিনশিং কাউন্টির এক প্রত্যন্ত গ্রামের ড্রাগন বাগান মালিক লিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার এত ড্রাগন কোথায় বিক্রি কর? সে বলেছিল তাদের উইচ্যাট গ্রুপে উৎপাদিত ফলের পরিমাণ ও দাম লিখে দেয়। অনলাইনেই বিক্রি হয়ে যায় মুহূর্তে। গত মে মাসে নাটোরে সে দৃশ্যই দেখলাম। ড্রাগন চাষি রবিউল বলছিলেন তার খেতের ড্রাগন বিক্রি হয়ে যায় ফেসবুকে। সেই কক্সবাজার থেকে কিনে নেয় বিভিন্ন হোটেল। চ্যানেল আইয়ের আমাদের সহকর্মী অপু মাহফুজ টেলিভিশনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের নিয়ে ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’ শুরু করেন। জনপ্রিয় এ অনুষ্ঠানটি পরে ‘উদ্যোক্তা’ নামে প্রচারিত হচ্ছে। টেলিভিশনে তুলে ধরা উদ্যোক্তাদের নিয়ে অপু শুরু করেন ‘ঐক্য’ নামের ই-কমার্স প্ল্যাটফরম। সেখানে এখন ৪৯৮ জন উদ্যোক্তার ১৯ হাজারের বেশি পণ্য বেচাকেনা হচ্ছে। তিলের তেল থেকে শুরু করে ধান মাড়াইয়ের মেশিন সবই পাওয়া যায়।

আমাদের দেশে ই-কমার্স পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হওয়ার আগেই কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য ই-কমার্সের প্রতি মানুষের একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। একসময় যেমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল চীনের প্রোডাক্ট, গ্যারান্টি নেই। তেমনই নতুন একটা ধারণা তৈরি হচ্ছে ‘অনলাইনে কেনা জিনিসের কোনো ভরসা নেই’। ছবিতে রাজহাঁস, হাতে আসে পাতিহাঁস টাইপ বিষয়। ই-কমার্সের জন্য নেতিবাচক বিষয়গুলো হচ্ছে সময়মতো পণ্য না পৌঁছানো। পণ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য না দিয়ে ভুল তথ্য দেওয়া। নকল/কপি পণ্য সরবরাহ।

ই-কমার্সে যে বিষয়টি সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তা হচ্ছে মার্কেটপ্লেস। অ্যামাজন, আলিবাবা কিংবা দারাজ যা-ই বলি না কেন, ওইসব মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীর যে চক্র আমরা ভেঙে ফেলতে চাই তা কি সম্ভব হবে? কারণ আমি যদি বুস্ট না করি আমার পণ্য মার্কেটপ্লেসের সামনের কাতারে আসবে না। ফলে আমার বেচাকেনা বাড়াতে প্রতিনিয়ত টাকা ঢালতে হবে। প্রতিটি উদ্যোক্তাই যেন ব্র্যান্ড হয়ে উঠতে পারেন তেমন একটা প্ল্যাটফরমের কথা ভাবা যায় কি না দেখতে হবে। সরকার নানা উদ্যোগের মাধ্যমে তরুণ উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে, স্টার্টাপ লোন, ইনোভেশন আইডিয়াকে বাস্তবায়নে সহায়তা। কৃষি ও কৃষকের জন্য একটা আন্তর্জাতিক অনলাইন বাজার তৈরির ক্ষেত্রেও সরকার যদি কাজ করত তাহলে আমাদের তরুণ কৃষক আরও বেশি উদ্যোগী হতো।

২০২৪ সাল নাগাদ কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের বিশ্ববাজার হবে ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের। সেখানে আমাদের বর্তমান উপস্থিতি মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলারের। ই-কমার্সের যে স্রোত বাংলাদেশে শুরু হয়েছে সেই মূল স্রোতে সারা বাংলাদেশে তৈরি হওয়া অগণিত কৃষি উদ্যোক্তাকে যুক্ত না করতে পারলে এ বিশাল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ কঠিন হয়ে উঠবে। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষিপণ্যের বাজার। যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোগ। তরুণ উদ্যোক্তারা নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছেন অনলাইন বাজার। বাজার মানেই প্রতিযোগিতা, আর প্রতিযোগিতাপূর্ণ স্থানেই থাকে প্রতারণার আশঙ্কা। ফলে এ ক্ষেত্রে শুরু থেকেই প্রয়োজন সুপরিকল্পনা ও মনিটরিং। যাতে সহজ সরল কৃষক প্রতারিত হয়ে সম্ভাবনাময় এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয়।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর