শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

এম আবদুল আলীম

জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত, ছিলেন ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান ভাষাবিদ। মৃত্যুর তিন বছর আগে লাহোরের লিঙ্গুইস্টিক রিসার্চ গ্রুপ অব পাকিস্তান তাঁকে ‘দ্য গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যান অব পাকিস্তান লিঙ্গুইস্টিকস’ বলে অভিহিত করে। বাস্তবেই তিনি ছিলেন ভাষাশাস্ত্রের সেরা পণ্ডিত; যাঁকে শুধু পাকিস্তান নয়, দক্ষিণ এশিয়ার ভাষাশাস্ত্রের অন্যতম ‘গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যান’ বললেও অত্যুক্তি হয় না। অতি শৈশবেই তিনি ঝুঁকেছিলেন ভাষা শিক্ষার দিকে; পারিবারিক পরিসর থেকে শেখেন আরবি-ফারসি আর স্কুল থেকে সংস্কৃত ভাষা। পরীক্ষার বৈতরণী পার হতে নয়, বলা যায় ভাষা শিক্ষা ছিল তাঁর বাতিক। ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও পঠন-পাঠন সূত্রে বিভিন্ন ভাষায় গভীর জ্ঞান যেমন অর্জন করেন, তেমনি করেন প্রাচীন সাহিত্যের স্বরূপ অন্বেষণ।

কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের সান্নিধ্য এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সাহচর্য তাঁকে প্রাচীন সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি বিশেষভাবে আগ্রহী করে তোলে। এর ফলে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি রচনা করেন ‘ভরত কণ¦ ও বিশ^ামিত্র’, ‘শ্রীমদ্ভাগবতগীতার একটি পাঠান্তর’, ‘গীতা ও শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব’ প্রভৃতি প্রবন্ধ; যা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া সেকালের সাহিত্য সম্পর্কে রচনা করেন ‘বৌদ্ধ গান ও দোহা’, ‘ভুসুকু’, ‘মালিক মুহম্মদ জায়সী ও তাহার পদ্মাবতী’, ‘সিদ্ধ কানুপার দোহা ও তার অনুবাদ’, ‘বিদ্যাপতির পদাবলীর সংস্করণ’, ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’, ‘গোরক্ষ বিজয়’, ‘কৃত্তিবাসের গৌড়েশ^র কে?’, ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের কয়েকটি পাঠ বিচার’, ‘কবি সৈয়দ আলাওলের পদ্মাবতী’, ‘সৈয়দ আলাওলের গ্রন্থাবলীর কাল-নির্ণয়’, ‘ময়নামতির গান’, ‘মহাকবি সৈয়্যিদ সুলতান’, ‘চণ্ডীমঙ্গলের একটি পুঁথির পরিচয়’, ‘মদন বাউল ও লালন শাহের গানে আত্মনিবেদনের সুর’, ‘শ্রীকর নন্দী কবীন্দ্র পরমেশ^র’ প্রভৃতি প্রবন্ধ। কেবল প্রাচীন সাহিত্য নয়, আধুনিক সাহিত্য নিয়েও তিনি লেখনী সঞ্চালন করেন; কায়কোবাদ, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখের সাহিত্যের বিশ্লেষণ করে লিখেছেন অনেক প্রবন্ধ; কবি ইকবালকে নিয়ে তো রচনা করেছেন স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থ। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রাচীন সাহিত্যের স্বরূপ অন্বেষণ করেছেন। সংস্কৃত পঞ্চতন্ত্রের গল্পের সঙ্গে গ্রিক ভাষার ইশপের গল্পের তুলনামূলক বিচার করেছেন। বৌদ্ধজাতক এবং মহাভারত থেকে বিভিন্ন কাহিনি এনে তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছেন। তিনি গ্রিক ও ভারতীয় গল্পের তুলনা করে দেখিয়েছেন ভারতের গল্পই প্রাচীনতম, বিশেষ করে পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলো। বৌদ্ধ গান ও দোহার ভাষার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে লক্ষ্য করেছেন উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। বিদ্যাপতির পদাবলি এবং শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের একাধিক পুঁথি পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন লিপিকর এবং গ্রন্থকারের পুঁথির পার্থক্য বিস্তর। লিপিকর মূল গ্রন্থের কপি প্রতিলিপি করতে গিয়ে গোচরে-অগোচরে অনেক কিছু যুক্ত করেন, যার ফলে ঘটে পাঠবিকৃতি। আলাওলকে তিনি সেকালের শ্রেষ্ঠ মুসলমান কবি অভিহিত করেছেন। এও বলেছেন, ‘তাহার স্থান ভারতচন্দ্র অপেক্ষা কিছুতেই হীন নহে।’ স্বজাতি, স্বসমাজ এবং স্বধর্মীদের কাছে এই কবির সমাদর না হওয়ায় তিনি মর্মাহত হয়েছেন। ময়নামতির গানে ভবানী দাস নামক এক কবির ভণিতা যুক্ত হলেও আসলে তিনি তার রচয়িতা নন বলে শহীদুল্লাহ্ মনে করেন।

ড. শহীদুল্লাহ্ বলেন, মুসলমান লেখক ছাড়া এমন মুসলমানি ভাব ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। তিনি চণ্ডীদাস সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হাজির করেছেন। একইভাবে নানা যুক্তি-প্রমাণ তুলে ধরে দৌলত কাজীর আবির্ভাবকাল নির্ণয় করেছেন ১৫৬০ থেকে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। ধর্মীয় দলিল-প্রমাণে বাউলদের কর্মকাণ্ডকে ‘ইসলামের গণ্ডির বাইরে’ ফেললেও তিনি এ সত্য মেনেছেন যে বাউলরা যা ভাবে তার মূলে রয়েছে খোদাভক্তি। তিনি বলেন, মদন বাউল, লালন শাহ এবং তাঁদের অনুসারীরা হিন্দুধর্ম, ইসলাম ধর্ম এবং বৌদ্ধধর্মের নানা তত্ত্ব এবং সাধন-ভজন পন্থা গ্রহণ করে এক আলো-আঁধারি ভাবের নিজস্ব সাধনপ্রণালি গড়ে তুলেছেন। এভাবে তিনি প্রাচীন সাহিত্যের স্বরূপ অন্বেষণ করেছেন। বিভিন্ন ভাষা ও ধর্মশাস্ত্রে জ্ঞানার্জন করেছিলেন বলেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রাচীন সাহিত্যের জহুরি হতে পেরেছিলেন। নিজের গভীর সাধনা, অধ্যয়ন ও তপস্যায় নানা পণ্ডিতের সান্নিধ্য-সাহচর্য তাঁকে অসামান্য সাফল্য এনে দেয়। দেশি পণ্ডিতদের মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দীনেশচন্দ্র সেন এবং বিদেশি পণ্ডিতদের মধ্যে এমিল বভনিস্ত, জ্যুল ব্লক এবং আঁদ্রে মেইয়ে তাঁকে প্রভাবিত করেন; শেষোক্ত তিনজন ছিলেন তাঁর শিক্ষক।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রাচীন সাহিত্যের বিচিত্র ভুবনে বিচরণ করে বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দি, আরবি, ফারসি, গ্রিক প্রভৃতি ভাষায় তাঁর বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। ‘রকমারী’ নামে তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ রয়েছে, শিশুতোষ গ্রন্থ রচনায়ও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ধর্ম নিয়ে লিখেছেন বিস্তর। পারিবারিক ঐতিহ্যে পাওয়া পীরবাদ এবং ধর্মবিশ^াস থেকে নিজেকে কখনো বিচ্যুত করেননি। সময় সময় ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন হলেও সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা দ্বারা নিজের চিত্তের আকাশটিকে কখনো ঢেকে দেননি। তিনি ছিলেন মনে-প্রাণে অসাম্প্রদায়িক। ছিলেন সংকীর্ণতামুক্ত এবং উদার। মানুষ হিসেবে ছিলেন মহৎপ্রাণ। যাকে বলে ‘পূর্ণমানব’। হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিরোধ তিনি পছন্দ করতেন না। উভয় সম্প্রদায়ের মিলনে নানাভাবে কাজ করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙ্গালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’ সাহিত্য-সাধনা ও ব্যক্তিজীবনের কর্ম সর্বত্র এর প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনত্ব বিচার, যুগ বিভাগ, চর্যাপদের কালনির্ণয় ও তত্ত্ব বিশ্লেষণ, ভাষা-সাহিত্যের বিচিত্র দিকের গভীর অধ্যয়ন-অন্বেষণ এবং বাংলা আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রণয়নসহ বিভিন্ন দুরূহ কাজ করে তিনি অমর হয়ে আছেন। সমাজ ও জাতির নানা প্রয়োজনে ব্যস্ত থাকায় তিনি যে মাপের পণ্ডিত তাঁর কাছে সে মাপের আকরগ্রন্থ আমরা পাইনি বটে; তবে তিনি যা দিয়েছেন তার মূল্যও কম নয়। জন্ম-মৃত্যু মাসে এই মহান জ্ঞানসাধককে জানাই শ্রদ্ধা।

লেখক : শিক্ষক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর