রবিবার, ১৮ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

হাওরাঞ্চলের মানুষ ও একটি অভিজ্ঞতা

নাফিসা বানু

হাওরাঞ্চলের মানুষ ও একটি অভিজ্ঞতা

হাওর দেখার শখ সব সময়ই ছিল। বিয়ে হলো হাওর এলাকার মানুষের সঙ্গে। কিন্তু হাওর দেখা হয়নি। অবশেষে ২০০৯ সালে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে প্রথমবারের মতো হাওরে বেড়াতে যাই। এ ছিল হাওরে আমার প্রথম ভ্রমণ। পরে আরেকবার হাওরের ওপর দিয়ে খালিয়াজুরী গিয়েছিলাম বেড়াতে। সেখানে কয়েক ঘণ্টা থেকে আবার সন্ধ্যার আগেই ফিরে এসেছিলাম। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে মোহনগঞ্জে আমার স্বামী কয়েকটি প্রোগ্রামে যাবেন। আমি, ছেলে, শাশুড়িসহ সবাই তাঁর সঙ্গে গেলাম, সেখানে ঠিক হলো ২২ সেপ্টেম্বর হাওরের ওপর দিয়ে খালিয়াজুরী উপজেলার অন্তর্গত বল্লী গ্রামে বেড়াতে যাব (আমার দাদিশাশুড়ির বাপের বাড়ি)। সেখানে বর্তমানে আমার স্বামীর এক চাচাতো ভাই স্থায়ীভাবে বাস করেন। তার নাম জুয়েল চৌধুরী। এলাকায় তিনি মোটামুটি পরিচিত ব্যক্তি। কথা ছিল আমরা দুপুর ১২টার দিকে রওনা দিয়ে বল্লীতে তার বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ সেরে আবার সন্ধ্যার আগেই মোহনগঞ্জে ফিরে আসব। কিন্তু দেখা গেল অন্য প্রোগ্রাম শেষ করে বল্লীর উদ্দেশে রওনা হতেই বেজে যায় দুপুর আড়াইটা। তেঁতুলিয়া ঘাট থেকে স্পিডবোটে উঠি। তেঁতুলিয়া যেতে মোহনগঞ্জ থেকে সম্ভবত ২০-২৫ মিনিট লাগে গাড়িতে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন ইউএনও সাহেব, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বাবু দিলীপ দত্ত এবং কয়েকজন পুলিশ সদস্য। এ ছাড়া আমার ছেলে, ননাস আকিকুন্নেছা চৌধুরী, দেবর আমীরুল ইসলাম চৌধুরী (বাবু)সহ সব মিলে আমরা ১২-১৩ জন।

স্পিডবোট চলা শুরু করলে চালকের কাছ থেকে জানতে পারলাম পানি কমে যাওয়ায় কিছুটা ঘুরপথে যেতে হবে গন্তব্যে। স্পিডবোটটি বেশ শক্ত এবং আসনব্যবস্থা খুবই সুন্দর। স্থানীয়ভাবে একে সবাই ‘ক্রুজ বোট’ বলে। ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটি একটু পরেই বর্ণনা করছি।

জুন, জুলাই, আগস্টে হাওর পানিতে পরিপূর্ণ থাকে। সেপ্টেম্বর থেকে পানি সাধারণত কমতে থাকে। হাওরের দৃশ্য আসলেই অপরূপ। চারদিকে সমুদ্রের মতো পানি। এপার-ওপার দেখা যায় না। শুধু থইথই পানি চারদিকে। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজারের কিয়দংশ নিয়েই প্রধানত আমাদের ভাটিবাংলা। এখানে অবারিত মাঠ ভরে ফসল উৎপাদন হয় শুকনো মৌসুমে, আবার বর্ষাকালে এ অবারিত ধু-ধু মাঠ পানিতে টইটম্বুর হয়ে সাগরের আকার ধারণ করে। এর বাইরেও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাওর ও বিল দেখা যায়। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, কুড়িগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলেও কিছু কিছু বৃহৎ জলাশয় আছে। সেগুলোকেও হাওর বা বাঁওড় বলা হয়। মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুরেও বাঁওড় দেখতে পাওয়া যায়। হাওর শব্দটি বাংলা কি না নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। আমাদের দেশে হাওর-বাঁওড় শব্দ দুটি একসঙ্গে উচ্চারণ করা হয়। বাঁওড় শব্দটির একটি অর্থ বাংলা পুরনো অভিধানে পাওয়া যায়। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, নদীর বাঁক যেখানে স্রোতবদ্ধ হয় সে জায়গাটিকেই বাঁওড় বলে। কথিত আছে, বাঁওড়ের আকার যখন অতি বিস্তৃত হয় তখনই এ বাঁওড় হাওরে পরিণত হয়। হাওর শব্দটি অনেকের মতে সাগর শব্দের একটি স্থানীয় বা আঞ্চলিক রূপান্তর। গানের ভাষায় সাগরকে অনেক সময় সায়র উচ্চারণ করা হয়। এ সায়র থেকেই শব্দটি রূপান্তরিত হয়ে হাওরে পরিণত হয়েছে। তবে বর্তমানে হাওর বলতে কী বোঝায় তা সম্ভবত বাংলাদেশের সমস্ত মানুষই বোঝেন। কেননা আমাদের দেশের খাদ্যশস্য বিশেষ করে ধান উৎপাদনের ২০-২২% আসে এ কয়েকটি জেলার হাওরাঞ্চল থেকে।

বাংলাদেশের উত্তরে গারো পাহাড়। সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড় থেকে হিমালয় বেশ কাছেই। ওখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। এ অতি উঁচু হিমালয় থেকে যখন বরফ গলা শুরু হয় এবং ভারতের মেঘালয় ও আসামে ভারী বর্ষণ হয় তখন বর্ষণের ঢল আর হিমালয়ের বরফ গলা পানি নেমে এসে বাংলাদেশের নদ-নদীতে প্রবেশ করে। নদীর বাঁক যেখানে স্রোতবদ্ধ হয়ে গেছে সেখানে যখন পানি এসে জমা হতে থাকে তখনই দিগন্তবিস্তৃত মাঠ জলমগ্ন হয়ে থইথই করতে থাকে। এ বিশাল জলরাশি যখন আবদ্ধ থাকে বা দীর্ঘদিন জমে থাকে তার চেহারা তখন (বর্ষাকালে) সাগরের মতো রূপ নেয়, এ সাগররূপী জলরাশিই হাওর। বাংলাদেশের অগণিত হাওরের মধ্যে টাঙ্গোয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, দেখার হাওর, শনির হাওর, ডিঙ্গাপোতার হাওর উল্লেখযোগ্য। উত্তরবঙ্গের চলনবিলও হাওর পর্যায়েরই জলাশয়। এগুলো আকারের দিক থেকে বিশাল। টাঙ্গোয়ার হাওর এখন পাখি ও মাছের অভয়াশ্রম। এ হাওরের রূপ শুনেছি অপরূপ। অবশ্য আমার সেখানে কখনো যাওয়া হয়নি। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় সম্ভবত হাকালুকি হাওরের অবস্থান। একবার কুলাউড়ায় চা-বাগানে বেড়াতে গিয়ে হাকালুকি হাওর দেখে আসার সুযোগ হয়েছিল। শুনেছি চাঁদনিরাতে হাওরের রূপ খুব সুন্দর। তবে অবলোকনের সুযোগ আমার কখনো হয়নি। একবার সপরিবারে জোছনারাতে টাঙ্গোয়ার হাওর পরিদর্শনের ইচ্ছা আছে। এ তো গেল হাওরের সুন্দর রূপের কথা। এর এক ভয়াল রূপও আছে। যা আমি নিজে একবার প্রত্যক্ষ করেছি।

স্পিডবোটে ৩০-৪০ মিনিটের জায়গায় প্রায় আড়াই ঘণ্টায় বল্লী গ্রামে পৌঁছি। তখন বাজে বিকাল ৪টা ১৫ (আনুমানিক)। তাড়াহুড়া করে আমরা জুয়েলের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবারও স্পিডবোটে উঠি মোহনগঞ্জের উদ্দেশে। তখন বিকাল ৫টা বেজে গেছে। রওনা হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়। খালিয়াজুরীর ইউএনও ও পুলিশ কর্মকর্তা এবং অন্য সরকারি কর্মকর্তারা অন্য একটি স্পিডবোটযোগে আমাদের স্পিডবোটটিকে খালিয়াজুরীর সীমানা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যান। প্রচন্ড বৃষ্টিতে স্পিডবোটটি চালাতে চালকের খুব কষ্ট হচ্ছিল। সে বারবার বলছিল স্পিডবোট চালাতে তার কষ্ট হচ্ছে। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন। বৃষ্টির দাপট ক্রমেই বাড়ছে। দমকা হাওয়ার দাপটে মনে হচ্ছিল বোটটি উল্টে যাবে। অনেক চেষ্টার পর মোহনগঞ্জের গাগলাজুর বাজারের ঘাটে এসে চালক স্পিডবোটটি থামাতে সক্ষম হয়। মোহনগঞ্জের ইউএনও সাহেব এবং আমাদের সঙ্গে থাকা অন্য লোকজন গাগলাজুরে লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। ইতিমধ্যে ঝড়বৃষ্টির মাত্রা বাড়তে থাকে। তার পরও গাগলাজুর বাজারের অনেক লোক এগিয়ে আসেন আমাদের সাহায্যের জন্য। সম্ভবত তারা জানতে পেরেছেন এ স্পিডবোটে আমার স্বামী বিচারপতি জনাব ওবায়দুল হাসানসহ আমরা অনেকেই আছি। যারা আমাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন তাদের প্রায় প্রত্যেকেই আমাদের তাদের বাড়িতে থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। আমার সঙ্গে যে ননাস ছিলেন তাঁর বড়বোনের শ্বশুরবাড়িও গাগলাজুর। খবর পেয়ে তারাও তাদের বাড়িতে আমাদের রাখার জন্য ব্যবস্থা করেছিলেন। আমি কোনো দিন এ ধরনের অবস্থার সম্মুখীন হইনি। আমার স্বামীর হয়তো কিছু না কিছু ধারণা ছিল। ছেলেকে মনে হলো লেশহীন, সম্ভবত ভাটি এলাকার সন্তান বলে তার ভিতরে সহজাতভাবেই সাহস জন্মেছে। কারণ সেও কখনো এর আগে এ রকম পরিস্থিতির কবলে পড়েনি। যা হোক কিছুক্ষণ পর আমার স্বামী ইউএনও সাহেবের কাছে জানতে চাইলেন হাওর দিয়ে না গিয়ে নদীপথে মোহনগঞ্জ যাওয়া যায় কি না। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাগলাজুরের স্থানীয় লোকজন একটি বড় ইঞ্জিনচালিত নৌকার ব্যবস্থা করে দেন। সে নৌকাটি সামনে থেকে একটি প্লাস্টিকের মোটা দড়ি দিয়ে এ বোটটি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই-ই স্বস্তিবোধ করছিলাম। আমরা যখন হাওর এলাকাটিতে ছিলাম তখন বাতাসের যে ঝাপটা, ঝড়ের তান্ডব ও সমুদ্রের গর্জনের মতো ঢেউয়ের আওয়াজ অনুভব করছিলাম নদীতে ঢোকার পর সে তান্ডব আর তেমন অনুভব করিনি। লোকজন বলছিল নদী যেহেতু দুই দিকে পাড় দ্বারা বেষ্টিতে এবং দুই পাড়েই কাছাকাছি গ্রাম ও গাছপালা আছে তাই বাতাসের দাপট ছোট নদীতে এতটা অনুভব হয় না। আমরা ধীরে ধীরে ধর্মপাশার দিকে এগোতে থাকি। প্রায় ৪ ঘণ্টা নদীপথে স্পিডবোটটি টেনে নেওয়ার পর রাত প্রায় ১২টার সময় ধর্মপাশা (সুনামগঞ্জ) উপজেলার মোহদীপুর ঘাটে স্পিডবোটটি এসে থামে। সেখান থেকে নেমে আমরা সেখানে অবস্থানরত আমাদের গাড়ি করে রাত ১২টা ২০ মিনিটের দিকে মোহনগঞ্জে নিজ বাসায় পৌঁছি। ভয়ে কুঁকড়ে থাকা আমার শাশুড়ি নাতিকে জড়িয়ে ধরেন। মোহদীপুর ঘাটে ধর্মপাশা এবং মোহনগঞ্জ উভয় থানার পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্য অনেক লোকজন উপস্থিত ছিলেন। সবার চেষ্টায় বিশেষ করে নৌকার মাঝিদের অপরিসীম সাহসিকতায় সেদিন আমরা রাতে বাসায় পৌঁছাতে পেরেছিলাম। নইলে হয়তো ওই রাতে স্পিডবোটে অথবা গাগলাজুরে কারও বাড়িতে থাকতে হতো। আমরা পরে জানতে পারি ওই দিন আবহাওয়া অফিস থেকে ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত ঘোষণা করা হয়েছিল যা আমরা জানতাম না।

আমি খুব অভিভূত হয়েছিলাম ভাটি অঞ্চল তথা হাওরাঞ্চলের মানুষের সাহস ও আন্তরিকতা দেখে। এ ঝড়বৃষ্টির মধ্যে অগণিত মানুষ গাগলাজুর বাজারের পন্টুনে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের সাহায্য করার জন্য। তারা তাদের চেষ্টায় একটা নৌকা জোগাড় করে আমাদের মোহনগঞ্জে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। এদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমার স্বামী নৌকার মাঝিদের বকশিশ দিতে চাইলেও তারা কোনোভাবেই তা গ্রহণ করেননি। সম্ভবত এটি আমাদের পরিবার ও আমার স্বামীর প্রতি তাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। পরদিন ২৩ সেপ্টেম্বর বিকালে নৌকা চালিয়ে যারা আমাদের মোহনগঞ্জ পৌঁছতে সাহায্য করেছিলেন তারা আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন আমাদের বাসায়। তাদের চা-নাশতা খাওয়ানোর পর তারা শুধু আমার স্বামীর সঙ্গে একটি ছবি তুলতে চাইলেন। এটুকুই তাদের চাওয়া। কি অকৃত্রিম ভালোবাসা তাদের। আমার শ্বশুর ও স্বামীর কাছে শুনেছি ভাটি অঞ্চলের মানুষ সাধারণত উদার প্রকৃতির ও পরোপকারী। আজ নিজেই তা দেখলাম। হাওরের রূপ যেমন অপূর্ব, এর ভয়াল রূপও তেমনি ভয়ংকর। আবার হাওরাঞ্চলের মানুষের হৃদয়ও বিশাল। ভাটি অঞ্চলের মানুষের আন্তরিকতা, মায়া ও মমত্ববোধ আমার স্মৃতিপটে চিরজাগরূক থাকবে।

লেখক : সদস্য (অর্থ), নির্বাহী বোর্ড, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ।

সর্বশেষ খবর