মঙ্গলবার, ২০ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

ভারত পাকিস্তান শ্রীলঙ্কা পারলেও বাংলাদেশ পারল না কেন!

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

ভারত পাকিস্তান শ্রীলঙ্কা পারলেও বাংলাদেশ পারল না কেন!

বিশ্বব্যাপী দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা করোনা মহামারী জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিক্ষা, যোগাযোগসহ প্রায় সবকিছুই ওলট-পালট করে দিয়েছে। যেসব সরকার বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে তার দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সংকট মোকাবিলায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে যুক্ত করতে পেরেছে তারা মহামারী মোকাবিলায় ততটা সফল হয়েছে। বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞদের মতামত শুনে বা না শুনে, অর্ধাংশ বা খন্ডাংশ শুনে আমলাতান্ত্রিকভাবে যেভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বারবার। সম্প্রতি সাহস করে বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদসহ কয়েকজন জাতীয় সংসদে তাঁদের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

জাতীয় সংসদ, গণমাধ্যম ও সুশীলসমাজের কাছ থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পুরো স্বাস্থ্য বিভাগ প্রচন্ড সমালোচনার সম্মুখীন হলেও তাঁদের কোনো লজ্জা, শরম ও হায়া আছে বলে মনে হয় না। দিন কয়েক আগে ভারতে কভিড পরিস্থিতি মোকাবিলায় নয় মন্ত্রীর পদত্যাগ এবং বিএনপির তরফ থেকে ক্রমাগতভাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সরকার বেশ অস্বস্তিতে আছে মনে হয়। এত কিছুর মধ্যেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একক চেষ্টায় টিকা আমদানি ও বিনামূল্যে গণটিকা কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় কিছুটা ভরসা ও স্বস্তি আছে। কিন্তু আমাদের নয় মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা, আরএমজিওলাদের খাই খাই এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশাসহ ‘কমিউনিটি ইনভলভ্মেন্ট’ না থাকায় মহামারী মোকাবিলায় কাক্সিক্ষত ফল দূরের কথা, বাংলাদেশের নৈরাজ্যিক লেজে-গোবরে অবস্থা হয়েছে। এর মধ্যে শোচনীয় অবস্থা স্বাস্থ্য খাতের আর শিক্ষা খাতের অবস্থা শোচনীয়তর! স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতি, অনিয়ম, ও ঘাটতির কথা প্রতিনিয়ত আলোচিত হলেও শিক্ষা খাতের ভয়ংকর সংকটের কথা সেভাবে আলোচিত হচ্ছে না।

দুই.

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ১৫ জুলাই এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসে জানান, মধ্য নভেম্বরে এসএসসি ও সমমান এবং ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা গ্রহণের পরিকল্পনা করছে সরকার। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি অনুকূলে এলে এবার এসএসসি ও এইচএসসি উভয় ক্ষেত্রেই গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা নেওয়া হবে। প্রতি ১০০ নম্বরের পরিবর্তে ৫০ নম্বর এবং তিন ঘণ্টার পরিবর্তে দেড় ঘণ্টার পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে।’

মানবিক, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থী এবং কারিগরি ও মাদরাসার শিক্ষার্থীদের নৈর্বাচনিক যেসব বিষয় রয়েছে সেগুলোর গ্রুপভিত্তিক তিনটি বিষয়ের (ছয় পত্রে) পরীক্ষা হবে। আবশ্যিক বিষয় বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ গণিত, আইসিটি ও ধর্ম বিষয়ে পরীক্ষার্থীদের আগের পাবলিক পরীক্ষার সাবজেক্ট ম্যাপিং করে মূল্যায়নের মাধ্যমে নম্বর দেওয়া হবে। অর্থাৎ নৈর্বাচনিক বিষয়ে প্রাপ্ত পরীক্ষার নম্বর ও আবশ্যিক বিষয়ে আগের পরীক্ষার সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে একজন শিক্ষার্থীর চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে।

শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এসএসসি ও সমমান পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা জেএসসি বা জেডিসি পরীক্ষায় আবশ্যিক বিষয়গুলো (যেমন বাংলা, ইংরেজি, আইসিটি ও ধর্ম) অধ্যয়ন করেছে। অনুরূপ এইচএসসি ও সমমান পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় আবশ্যিক বিষয়গুলো অধ্যয়ন করেছে। ওই বিষয়গুলোর মূল্যায়ন হয়েছে এবং সেগুলোর নম্বর সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু নৈর্বাচনিক বিষয়গুলোর মূল্যায়ন বোর্ডগুলো করেনি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যেহেতু গ্রুপভিত্তিক বিষয়গুলো মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে সে কারণেও এই গ্রুপভিত্তিক বিষয়ের মূল্যায়ন জরুরি। যেমন বিজ্ঞান গ্রুপের ক্ষেত্রে পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর আবশ্যিক বিষয়ে পরীক্ষা নিতে গেলে স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়বে।

সম্প্রতি ইউনিসেফ ও ইউনেসকোর স্কুল খুলে দেওয়ার আহ্বানের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘দেশে এখন সংক্রমণের যে হার এবং মৃত্যুর যে সংখ্যা তাতে এ মুহূর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই।’

তিন.

দেড় বছর ধরে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন ও ফলপ্রসূ শিক্ষা নিয়ে যেমন অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে তেমন তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও উৎকণ্ঠিত হওয়ার যৌক্তিক কারণ তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত আছে সেশনজট, শিক্ষার ফলাফল (লার্নিং আউটকাম), বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা গভীর বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে করোনা মহামারীর সময়ে পর্যায়ক্রমে পোশাকশিল্প, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, দোকানপাট, শপিং মল, মসজিদ-মন্দিরসহ সব জনপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। অথচ শিক্ষার ব্যাপারে আমরা সরকারের কাছে অধিকতর দায়িত্বশীলতা ও কর্মতৎপরতা আশা করেছিলাম।

আমরা আশা করেছিলাম করোনা মহামারীর ভয়াবহতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজানো হবে, কিন্তু সে ধরনের কোনো পরিকল্পনা দৃশ্যমান হলো না। গত দুটি বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ কিছুটা বাড়ানো ও ১০ হাজার টাকা করে থোক বরাদ্দ দেওয়া হলেও স্বাস্থ্য খাতের লাগামহীন দুর্নীতি দমন, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বরাদ্দ টাকার যথাযথ ব্যয়, বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সীমাহীন বাণিজ্য এবং মাস্ক, স্যানিটাইজার ও ওষুধপথ্যের অতিরিক্ত মূল্যের ব্যাপারে সরকারি সংস্থাগুলো কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এর সঙ্গে ছিল ভ্যাকসিন আনা নিয়ে নানা অনিয়ম, অস্বচ্ছতা ও বিভ্রান্তি।

করোনা মহামারীর সময়ে সবচেয়ে বেশি দুর্দশার শিকার হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ১৫ মাস ধরে কী কারণে এবং কোন যুক্তিতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হলো তা সুস্পষ্ট নয়। করোনা মহামারী যে ভয়াল চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের মার্চে যে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয় আমরা তা সঠিক সিদ্ধান্ত মনে করি। ওই সময়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্তটিও যথার্থ ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। শিশু, কিশোর ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ; কেননা তারাই সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নাগরিক। তাদের ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা প্রত্যাশিত ও কাম্য।

করোনা মহামারীর ভয়াবহতার কারণে প্রথম দিককার হতবিহ্বল ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা কাটিয়ে উঠে তিন থেকে চার মাসের মধ্যে সবই খুলে দেওয়া হলো। তখনো আমরা মনে করেছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের বেলায় আরও ভেবেচিন্তে ও সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত এবং এ ব্যাপারে সরকারি কর্মতৎপরতা যৌক্তিক ও সন্তোষজনক বলে মনে হয়েছে। কিন্তু আট থেকে নয় মাস অতিক্রান্তের পরও যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হলো না তখন আমরা শঙ্কিত হতে শুরু করলাম। এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফে আগের পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ২০২০ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের অটো পাসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, যা ছিল পুরো জাতির জন্য আত্মঘাতী।

এক দশক ধরে কোমলমতি শিশুদের শিক্ষা নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট, মানের চেয়ে সংখ্যার ওপর গুরুত্ব প্রদান, পিইসি, জেএসসি, এসএসসিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা তহবিলের ঘাটতিসহ নানা কারণে শিক্ষা খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। উপরন্তু করোনাকালে শিক্ষার ব্যাপারে সরকারের নির্বিকার মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে ১৫ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার মধ্য দিয়ে। বর্তমানে অনলাইনে ক্লাস চালু থাকলেও বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ডাটা প্রদান করা হয়নি, যদিও এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী ও প্রযুক্তিমন্ত্রী কয়েকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

চার.

দেড় বছর ধরে বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শুধু হতাশা নয় বিষণ্ণতায় আমার মন মলিন হয়ে আছে। শেষে নিরুপায় হয়ে ইন্টারনেটে অনুসন্ধান শুরু করলাম যে অন্যান্য দেশের সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে কী করেছে? আমি অবাক হয়ে দেখলাম চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা তাদের বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলো খুলে দিয়েছে। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে পর্যায়ক্রমে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হয়। পাকিস্তানেও কয়েক হাজার স্কুল ও কলেজ খুলে দেওয়া হয় ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা চার মাস পরই অর্থাৎ জুন/জুলাইয়ে তাদের সব স্কুল খুলে দেয়। উল্লেখ্য, পরিস্থিতি খারাপ হলে এসব দেশ স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে, আবার পরিস্থিতি ভালো হলে খুলে দিয়েছে। কিন্তু তারা একনাগাড়ে ১৫ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখেনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে স্কুল-কলেজ খুলে দিতে পারলেও আমরা পারলাম না কেন?

লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর